অবয়ব
অবয়ব
নিকষ কালো মেঘে আকাশটা ঢেকে গেছে।আমার মোটেও ভালো লাগে না রাস্তাঘাটে হঠাৎ প্যাচপেচে বৃষ্টি।যদিও আগে ভালো লাগত।সেদিনও আকাশটা এমনিই ছিল।আকাশের বুক চিরে ঝুপঝুপ নেমে গেল বৃষ্টি।ছাতা ছিলনা সাথে।অফিস থেকে বেরিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি।বৃষ্টি দেখেই ছুটে গিয়েছিলাম চায়ের দোকানের টিনের চালের আশ্রয়ে।প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা মেয়ে শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে চালের নীচে দৌড়ে এল।মেয়েটা আমার থেকে দুহাত দূরে প্রায়।জোর বৃষ্টি বলে মেয়েটা আংশিক ভিজে গেছে।ব্লাউজটা ভিজে পিঠে আটকে গেছে।শাড়ির যেই আঁঁচলটা মাথা বাঁচাচ্ছিল এতক্ষণ সেটাকেই গায়ে চাদরের মতো জড়িয়ে নিল প্রাণপণ।এই সময়েই মেয়েটা হাত তুলতেই কোমরের সোনালী রঙটা আমার চোখে আটকে গেল।দেখতে অতীব সুন্দরী বলা না গেলেও মেয়েটার মুখটা মায়ামাখানো,একটা আকর্ষণ অনুভব করছিলাম আমি।তারপর বৃষ্টিতে শরীরে শিরশিরানি ধরছিল।এরমধ্যে মেয়েটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে দেখলাম।ভয় লাগলো,"এই রে!বলে যদি অমন হাঁ করে কি দেখছেন?দেখে তো ভদ্রলোক ভাবছিলাম।"মেয়েটা এগিয়ে এসে বলল,"ফোনটা একেবারে ডেড,আপনার ফোনটা যদি..."।আমার না করার প্রশ্ন ছিল না।এগিয়ে দিলাম নোকিয়ার বোতাম টেপা ফোন।তখনও অ্যান্ড্রয়েড কিনতে পারিনি।মন তোলপাড় করে একটা প্রশ্নই ঝড় তুলেছিল,'শেডের নীচে তো অনেকে,কেন বা মেয়েটা আমার কাছেই!'যাই হোক ভগবান এতটা সাহায্য করেছে।বাকিটা নিজেকেই করতে হবে ভেবে নেমে পড়লাম মাঠে।
"আপনাকে আগে তো এই চত্বরে দেখিনি!"
"এই এক সপ্তাহ ধরে আসছি।ঐ যে একতলা প্রাইমারি স্কুলটা দেখছেন!ওখানেই আমি পড়াচ্ছি।"
"ওওও,বেশ বেশ।আমার অফিস ঐ সবুজ বিল্ডিংটা।"
বাস আসতেই আমরা বাসে উঠলাম।
"আমার বাড়ির পাশে এক বৌদি বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করতে চাইছে।কত কি জানতে চাইছিল,আমি ঠিকঠাক বলতে পারিনি।তোমার নম্বরটা যদি..."
"হ্যাঁ,নাও।তবে এটা তোমাকেই দিচ্ছি।বৌদিকে সরাসরি স্কুলে আসতে বলো,সব হয়ে যাবে।"
আমি এভাবে ধরা পড়ে গিয়ে বেশ লজ্জা পেলাম।অনেকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।জানলার বাইরে বৃষ্টি কিছুটা ধরেছে।নামার সময় বলে গেল,"আমি কঙ্কনা,রাত ৯ টার পর ফোন করতে হলে কোরো।তখন নিজের নামটাও বোলো কেমন৷"
রাতে ৯ টার আগে থেকেই ফোন হাতে নিয়ে বসেছিলাম।৯ টা বাজতেই ফোন করলাম।ওপ্রান্ত থেকে মিষ্টি গলা ভেসে এল।
"আমি অমিয়"
"আমার নামটা ভুলে যাওনি তো!"
"কঙ্কনার পরেরটুকু জানি না"
"খুব দরকার কি!কঙ্কনাটুকুই তো আসল,বাকিটা তো পাওয়া।"
দুজনেই বাঙালি।কথা বলার জন্য এর বেশি কিছু দরকার বলে মনে হয়নি আমারও।
"না,না,দরকার নেই।"
তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই দেখা করতাম আমরা।সম্পর্কটাতে কোনোরকম প্রতিশ্রুতি ছিল না।একে অপরের ভাললাগা,খারাপ লাগাকে ভাগ করে নিয়ে আমরা তখন খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম।আমি মুখে ওকে কোনো ইঙ্গিত না দিলেও মনে মনে ওর সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর।সবে চাকরি তখন,ছোটো বাড়িতে ভাড়া থাকি।মায়ের অসুখ, ওষুধপত্রেও বেশ খরচ।একটু গুছিয়ে না নিয়ে বিয়ে করা যায় না।আমি কঙ্কনাকে কোনো অনিশ্চয়তাতে ফেলতে চাইনি।ও আমাকে বেশ বুঝত বলেই হয়ত ওকেই দরকার ছিল আমার জীবনে।একদিন কড়া রোদে মলে গেছি ওর সাথে ওকে কেনাকাটাতে সাহায্য করতে।
"এই বাদামী রঙেরটা কেমন?"
"হুম,ভালোই।"
"আর এই হলুদটা?"
"এটাও ভালো।"
"আচ্ছা,চলো আগে চা খেয়ে আসি।"
"কেন?"
"তোমার মাথা ব্যথা তাই।"
"আমার!না না।"
সত্যিই ধরেছিল মাথাটা।তবে ধরা পড়াতে লজ্জা পেলাম।
"কিছু খেয়েও আসি।তুমি সকাল থেকে কিছু খাওনি তাই না!"
না খেয়েছিলাম সেটা কি করে বুঝল তা আমি সত্যিই আজও জানি না।
তারপর একদিন ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেলাম।কমলা রঙের একটা সুতির শাড়ি পড়েছিল ও,চোখে একটু কাজল,কপালে একটা ছোটো কালো টিপ।আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখেই যাচ্ছিলাম ওকে।মা বারণ করলেও মার সঙ্গে হাতে হাত করে দিল।মা তো খুব প্রশংসা করল ওর।বলল,"বাবু,মেয়েটা কিন্তু খুব ভালো,বেশ মিষ্টি।তোর পাশে ভালো মানাবেও।কি বলিস?"
একদিন খুব তাড়াহুড়ো করেই ডাকলাম রেস্টুরেন্টে।আমি সেদিন বলেই দিলাম ভালবাসি।ওর মুখটা হঠাৎ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল পলকে।বলল ও আমাকে কবে বলেছে ভালবাসে!সত্যিই তো আমিই ভেবে নিয়েছিলাম অনেকটা।বাড়ির রংটা যখন ওর পছন্দের করেছিলাম তখনও তো বোঝাইনি আমি,অপছন্দের নীল রঙে যখন ওয়াড্রব ভরিয়েছি তখনও তো বোঝাইনি আমি,ওর মন খারাপে আমার মন কষ্ট পায় সেটাও তো বোঝাইনি আমি।দোষ তো ওর কিছুই ছিল না।বন্ধুত্বকে আমিই ভালবাসা ভাবার ভুল করেছি।সেদিন বড্ড রেগে চলে গিয়েছিল কঙ্কনা।আমিও আর আটকাইনি।পরে একদিন ফোন করেছিল ও নিজেই।
"কেমন আছো?"
"যেমন থাকার কথা।তুমি কেমন আছো?"
"ভালো,আসলে একটা কথা বলতে ফোন করেছিলাম।"
আগে হলে বলতাম আমার কাছেও তোমার অনুমতি লাগে নাকি!তবে তখন আমিও ভাবছিলাম যে ৬ মাস পর ও কি এমন কারণে ফোন করল!
"হ্যাঁ,বলো।"
"আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অমিয়,কার্ডটা তোমার ঠিকানাতে পাঠিয়ে দিয়েছি।এসো পারলে।"
কিছু বলতে পারিনি তখন।কান দুটো গরম হয়ে গিয়েছিল।হঠাৎ খুব অস্বস্তি হচ্ছিল আমার।
"অমিয়!শুনছো?"
"হুম শুনেছি।"
"অমিয় তুমি খুব ভালো,দেখবে একদিন তুমি আমার থেকেও ভালো একজনকে জীবনসাথী হিসাবে পাবে।তখন দেখবে আমাদেরকে আলাদা করতেই পারছ না।"
হাসিও পেল ওর সান্ত্বনা পুরষ্কার দেওয়ার ভঙ্গি দেখেই।হয়তো বা নিজের উপরেই পেল হাসিটা।
"তোমার সাথে কাউকে এক করা সম্ভব নয়।"
''না হয় ভেবে নেবে আমিই এসেছি তোমার কাছে অন্যরূপে।"
"কঙ্কনা এসব থাক,আই ইউশ ইউ অ্য ভেরি হ্যাপি ম্যারেড লাইফ।"
কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যেই তাড়াহুড়ো করে ফোনটা রেখে দিলাম।সত্যি বলতে বিরক্ত লাগছিল আমার নিজের উপরেই।
বৃষ্টিতে মাথা বাঁচানো দূরহ এখন।চায়ের দোকানটা উঠে গিয়েছে অনেকদিন।বাড়ির বাইরের সামান্য শেডে হেড বাঁচে না।কোনোমতে ফাইল ব্যাগ দিয়ে মাথা বাঁচিয়ে বাসে উঠলাম।বৃষ্টিটা আরও জোর বাড়ালো নিজের কৃতিত্ব দেখাতে।বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি ভিজে পান্তা।তরী আমাকে ওভাবে দেখে প্রায় ছুটেই এল।একটু ভারী গলায় বলল,"ছাতাটা ব্যাগের পাশেই রেখে গিয়েছিলাম।"অভিমান না অধিকারবোধ কি ছিল ওতে তা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।তরী আমার বিবাহিতা স্ত্রী হলেও আমাদের মাঝে এখনো দূরত্বের প্রাচীর তোলা।মেয়েটার যদিও কোনো দোষ নেই।আমিই ওকে এড়িয়ে চলি একটু।কঙ্কনাকে ভেবে তরীকে আদর করলে ওর নারীত্বকে ঘোর অপমান করা হয় না কি!অথচ এতটা অপমান তো ওর কোনোভাবেই প্রাপ্য নয়।কোনোমতে অল্প খেয়ে আমি ঘুমাতে গেলাম।বৃষ্টিতে ভিজে আমার বেশ জ্বর এসে গেছে।চাদর গায়ে দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে পড়লাম।কঙ্কনা কখন আমার ঘরে এসে হাজির হয়েছে তা আমি টের পাইনি।কাছে আসছে না,দূরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।সেই টিয়া রঙের শাড়িটা পড়েছে যেটা ওকে জন্মদিনে দিয়েছিলাম টাকা বাঁচিয়ে।আমি হাত বাড়ালাম ওর দিকে।বুকের খুব কাছে ও।ওর ঘনঘন নিশ্বাস পড়ছে আমার চোখে-মুখে।বুকের উপর হাত পড়তেই লোমশ বুকে আন্দোলন হল।বড্ড কাছে এসে মুখ নামিয়ে বলল,"শরীর খারাপ করছে নাকি!"ভালো করে দেখলাম ওকে।হঠাৎ তরীর মুখটা সামনে চলে এল কেমন করে!তরী আমাকে ঠেলছে ,"এই তোমার শরীর তো তাপে পুড়ে যাচ্ছে,ওঠো ওষুধ খাও।"এই প্রথম আমি তরীকে বুকে টেনে নিলাম।ও কিছু বলল না।জড়িয়ে ধরল আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে।কঙ্কনা বলেছিল অবয়বরা মিলেমিশে যায়,তাহলে কি সত্যিই তাই!
#ভালবাসা
#love