পাত্র নির্বাচন
পাত্র নির্বাচন
মৌসুমী ময়ূর রঙা কাঞ্জিভরম শাড়িটা পড়তেই হিমসিম খাচ্ছে তখনই কামিনী দেবী ঘরে ঢুকে আবার টিপস্ দিতে শুরু করল,"শোন মৌ তুই যেমন তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামা ওঠা করিস ওভাবে ওদের সামনে চলিস না কিন্তু।দামী চিনামাটির কাপ-ট্রের সেটটা নামিয়েছি,দয়া করে সাবধানে নিয়ে যাস।আর একান্তে কথা বলার সময় ছেলের সাথে বেশী কথা বলিস না একদম,যা জিজ্ঞেস করবে শুধু তাই ই......"।না,না কামিনী দেবী এত তাড়াতাড়ি থামতেন না,মৌ ই উঠে চলে গিয়েছে তাই বিরতি পড়ল।
''উফ্,এই মেয়ের জ্বালায় আর বাঁচব না,কথা পর্যন্ত শোনে না,তাই তো মার কথা আর কেন শুনবে"....ঘরের দেওয়াল,পাখা,খাটদের কাছেই মনের দুঃখ বলতে বলতে তিনিও রান্না ঘর সামলাতে গেলেন।ঘরে কাজের অন্ত নেই কিনা।ছেলেপক্ষ আধ ঘন্টার মধ্যেই হাজির হবে মৌকে দেখতে।একমাত্র মেয়ে মৌকে নিয়ে চিন্তা করে বেচারি কামিনী দেবীর ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে দিনদিন।স্বাভাবিক তো।স্কুলে-কলেজে প্রেম করেনি,এখন ১বছর চাকরী পেয়েও তার হেলদোল নেই,সত্যিই বড্ড চিন্তার ব্যাপার।জিজ্ঞেস করলেই বলে,"মনের মতো ভালো ছেলে পাই,তবে তো বানাবো তোমার জামাই"।অথচ না যায় বন্ধুদের সাথে ঘুরতে,না যায় বিয়ে বাড়িতে৷কাজের সময়টুকু ছাড়া একমিনিটও কোথাও থাকে না।সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট নামেই আছে তার।তাই কামিনী দেবী বুঝে গেছে মেয়ের মন জোগানোর ছেলে তাদেরকেই খুঁজতে হবে এবার।মৌ প্রথমে আপত্তি করলেও মায়ের মানসিক অত্যাচারের কাছে পরাজিত হয়েছে।
এবার আসা যাক মৌ এর কথায়।জীবনে একটা ভালোলাগা আসেনি এমনটা সত্যি নয়।ভাললাগা এসেছিল বহুবারই,তবে ও নিজেই চায়নি এগিয়ে যেতে,বরং দু পা পিছিয়ে এসেছে প্রতিবারই।প্রত্যেকবারই অজুহাত তো কিছু ছিলই৷না,সামনে উচ্চমাধ্যমিক,এখন প্রেম করলে হবে না।সেকেন্ড ইয়ারে প্রেম!না না,ফাইনালটা মাটি হয়ে যাবে।চাকরিটা হোক আগে, লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে সারাজীবন শুধু খুন্তিই হেলাতে হবে।এত যুক্তিবাদী মেয়ের কি আর প্রেম হয়! তাছাড়া বন্ধু-বান্ধবের তিক্ত প্রেম সম্পর্কের অভিজ্ঞতা দেখে আরো ভয় পেয়েছে এটাও খুব সত্যি।নিজের চোখে দেখেছে অলকেশের পিয়ালীকে নিয়ে সবসময় সন্দেহটা৷বেচারি পিয়ালী একবারের জন্যও ওকে না বলে কোথাও যেতে পারত না,আবার সময় নিয়েও জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হত ওকে,ছেলে বন্ধুও রাখতে পারত না ও।মৌ জানে শ্বাসরোধ করা কোনো সম্পর্কেই থাকতে পারবে না ও।তবুও সম্বন্ধের বিয়েতে 'চায়ের কাপে জীবনচর্চা' বিষয়টা ও একেবারের জন্যও মেনে নিতে পারে না।ও ভাবে একনজরে প্রেম তো দূর প্রাথমিক চেনা জানাটাই হয় না।ভালো-খারাপ বুঝতে একে অপরকে অনেকটা সময় নিয়ে চেনা প্রয়োজন।তারপরই বিয়ের মতো জীবনের বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
ছেলেপক্ষ বাড়িতে এলে কামিনী দেবী তাদের এমনভাবে আপ্যায়ন করতে লাগলেন যেন বাড়িতে প্রধানমন্ত্রী এসে পড়েছে।উপরের ঘরের জানালা দিয়ে এসব দেখে মৌ বেশ বিরক্ত হল।একজন শিক্ষিতা চাকুরীরতা মেয়ের মা হলেও ছেলের পরিবারের সামনে মেয়ের পরিবারের এই 'বাধিত করেছেন এসে' ভাবটা ঠিক চলেই আসে হেঁটে।মায়ের কথা মতো চায়ের কাপ নিয়ে এসে মৌ পাত্রপক্ষের কাছে ইন্টারভিউ দিতে বসল।ছেলের নাম সৌমাভ,সে আবার নামী ফাইনান্স কোম্পানিতে ভালো পোস্টে চাকরীরত।বাবা-মার সাথেই এসেছে সে।চা খেতেই খেতেই প্রথম প্রশ্ন এল ছেলের মায়ের তরফ থেকে 'রান্না-বান্না ভালো পারো তো?খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আমরা বড্ড সচেতন'।মৌ ভাবল বলেই দেয়,"ফাইভস্টারের রান্না লাগলে ফুড কর্পোরেশন এর ফুড ডিপার্টমেন্ট হেডের সাথে ছেলের বিয়ে দিন, শিক্ষিকা দেখতে এলেন কেন!" তাও মায়ের মুখ চেয়ে বলল 'পারি একটু-আধটু'।আবার প্রশ্ন এল উড়ে ছেলের জ্যেঠিমা গোত্রীয় এক মহিলার থেকেই,"তা স্কুল থেকে ৬ টার মধ্যে বাড়ি আসতে পারো তো?আজকালের যা অবস্থা বাবা!"মৌ ভনিতা না করেই সটান উত্তর দেয়, '৬:৩০ টা'।ছেলের বাবা এবার বলেই বসে,"চাকরিটা আর বেশিদিন করে কি হবে!বাবু বেশ ভালোই মাইনে পায়।"মৌ কিছু বলতে যাবে তার আগেই মা এসে কাঁধে হাত রাখল ওর।"তা ওরা একটু কথা বলে নিক নিজেরা কেমন!",কামিনী দেবী বেশ কথা ঘুরিয়ে দিলেন।সবাই এক বাক্যে মত দিল এতে।
দুজনেই বারান্দায় এসে বসল এবার।মৌ চুপ করেই ছিল।
সৌমাভ- আপনার হবি কি!নাচ-গান এসব?
মৌসুমী-না, সুযোগ হয়নি এসব শেখার।
-আপনি তো বাড়ির এক মেয়ে!খুব আদর তাই না!
-এসব কথায় সময় নষ্ট করলে আসল প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেসই করতে পারবেন না কিন্তু।
-আসল প্রশ্ন!সেটা কী?আমার তেমন প্রশ্ন নেই তো।
-ও বেশ।তবে আমিই আমার প্রশ্ন করি।
-নিশ্চয়ই,করুন,করুন।
-আচ্ছা,বলুন আপনার এই ৩০ বছরের জীবনে কটা মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছিল?
-কি!কি যা-তা বলছেন!
-যাহ্,এতে যা-তা কি পেলেন!এটা তো একটা প্রশ্ন কেবল।
-তাহলে তো আমিও এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করতেই পারি!
-পারেন তো,তবে আপনিই বললেন আপনার কোনো প্রশ্ন নে
ই।এবার মানে মানে না করেন ঝটপট উত্তরটা দিয়ে দিন তো দেখি।
-গার্লফ্রেন্ড ছিল একজন,শারীরিক সম্পর্ক ঐ মানে আর কি...মানে সিনেমা হলে একটু আধটু...
-হ্যাঁ সেই,পার্ক পাবেন কোথায় এই ছোট্ট মফস্বলে।একটু আধটু মানে কি!কিসে'ই শেষ নাকি এধার ওধার!
-উফফ্,অন্য কথা বলি এবার!
-ওওও,আচ্ছা আচ্ছা।আপনি বিরক্ত হচ্ছেন দেখছি।তা সেই মেয়েটাকে বিয়ে করলেন না কেন?
-ও আমাদের পরিবারের যোগ্য না।বাড়িতে রাজি হত না।
-ও আচ্ছা।এবার তাহলে ভালো প্রশ্ন করবো,এটা আমার ফেভারিট একদম।
আপনার দিল্লির নির্ভয়া কান্ড নিয়ে মতামতটা বলুন।
-যাহ্,সে কি!দিল্লির নির্ভয়া এল কোথা থেকে!
-আরে জানেন না নাকি, রেপ ক্যাপিটাল বলে দিল্লিকে।ঘটনাটা বলতে হবে, তাই তো?আপনারা হয়তো সময়-টময় পান না এসব খবর রাখার।
-না না, সে জানি ব্যাপারটা।তবে বিয়ের কথায় এসব আসছে কেন তাই ভাবছি।
-ও মা!সে কি!আরে আপনি অত ভাবছেন কেন!শুধু মতামতটা রাখুন আপনার।
-কি আবার! কিছু অশিক্ষিত মানুষদের অমানবিক অত্যাচার,সত্যিই ভাবলেও লজ্জা হয়।তবে মেয়েটাও বা কেন অত রাতে বন্ধুর সাথে ঘুরবে বলুন!এইজন্যই তো মামিমা আপনাকে জিজ্ঞেস করল আপনি বাড়ি ফেরেন কখন৷
-ওওও বেশ বেশ,আর পোশাক!মেয়েটা আবার জিনস পরেছিল তাই না!
-তাই তো,তাহলে তো হবেই বলুন।মেয়েরা যে কেন পোশাক নিয়ে স্বাধীনতা দেখাতে আসে কে জানে!আপনি চুড়িদার পড়েন দেখেই তো আপনাকে পছন্দ হল আমাদের।
-ওওওও, বেশ বেশ।আপনি খাসা বলেছেন কিন্তু।তা চার বছরের বাচ্চার রেপ নিয়ে কি বলবেন আপনি!
-আরে ধুর ধুর,ওসব হয় নাকি!মা-বাবার সাথে শত্রুতার জন্য বাচ্চাকে মেরে ফেলে অপরাধী।তারপর বাকিটায় মিডিয়া রঙ মাখিয়ে পরিবেশন করে।কটা বাচ্চাদের সত্যিই রেপ করা হয় তা সন্দেহ।
-আচ্ছা,আচ্ছা বুঝলাম।চলুন ১০ মিনিটের জায়গায় কুড়ি মিনিট হয়ে গেল।
মৌ ঘরে ঢোকার আগেই শুনল ছেলের মার বক্তব্য..."এমনি তো আমরা দেওয়া নেওয়ায় বিশ্বাস করিনা।ভগবান সব দিয়েছে আমাদের।ছেলের শুধু একটা হীরের আংটি আর বি.এম.ডাবলিউ গাড়ির সখ।তাছাড়া গাড়িতে তো আপনার মেয়েই চড়বে।"মৌ আর সৌমাভ ঘরে এল।মৌ রেগেই গেছে এতক্ষণে।"গাড়ি চড়াবেন!কেন বলুন তো?যাতে বৌকে কেউ দেখতে না পারে?সবসময় বন্ধ কাচঘরে বন্দী রাখা যায় তাই জন্যে!",মৌ একটানা বলে থামল।ওপাশ থেকেই কেউ উক্তি করল,"মেয়ের মুখে আগল নেই যে"।মৌ সৌমাভের মার দিকে তাকিয়ে বলল,''না মাসিমা,আমি রাঁধতে পারি না।আসলে আমার রান্না করতে ভালোই লাগে না একদম।চাকরী আর অবসরে লেখালেখি করেই দিন কেটে যায়।এভাবেই বাকিটা জীবনও কাটাতে চাই।আর আমরা হীরের আংটি দিয়ে বর কিনতে বিশ্বাসী নই,আপনার ছেলেকে নিয়ে আপনি অবশ্যই ব্যবসা করুন,এত খরচ করেছেন সারাজীবন যখন।আমি বিক্রয়যোগ্য নই।আর এই যে জ্যেঠিমা না মাসিমা যাই হোন,আমি ৬:৩০ টায় বাড়ি ফিরি এটা ঠিকই।তবে মাসে এক-আধদিন ১০ টাতেও ঘুরেফিরে বাড়ি ঢুকি।আপনাদের ছেলে হয়তো রোজ ১০ টা অবধি আড্ডা দেয় পাড়ার মোড়ে,আপনাদের দরদ উথলেও পড়ে,'আহা রে,ছেলেটা সারাদিন যা খাটে!'বিশ্বাস করুন মেয়ে বলে খাটনিটা আমাদের কম হয় না।তবুও কত ভালোমানুষ দেখুন আমরা!নিজেরাই সেই অনুপাতটা ১:৩০ রেখেছি,মানে আমরা ১দিন আর ছেলেরা ৩০ দিন।এই যে কাকু,আমি চাকরীটা ঠিক কোনোদিনই ছাড়ব না।আমার বর ৫০ হাজার রোজগার করুক বা ৫ কোটি... বিশ্বাস করুন কিছুই যায় আসবে না সেই সিদ্ধান্তে।আর এই যে সৌমাভবাবু....আপনাকে বিয়ে করতে পারব না আমি।আপনি তো ধর্ষক।আরে সবাই অবাক হবেন না!ধর্ষিতা কি আর একবার ধর্ষিত হয় নাকি!এই সমাজের কিছু মানুষরা নিজের মন্তব্যে তাকে বারবার ধর্ষণ করে।আমিও মেয়ে,এমন অ্যাক্সিডেন্ট সবার সাথেই হতে পারে জানি বলেই আপনাকে অহেতুক প্রশ্নগুলো করছিলাম।আর আপনার ঐ বাইকটা ছেড়ে মাঝে মাঝে বাসে করে অফিস যাবেন একটু।আপনাকেও যখন কোনো বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ সেইভাবে ছোঁবে তখন নিজের অফিস যাওয়ার ড্রেস আর সময় মিলিয়ে দেখবেন না হয় একবার।আর যার সাথে সিনেমার হলে যেতে পারেন তাকে বাবা-মার সামনেও নিয়ে যাওয়ার সাহসটাও রাখবেন।যৌনাঙ্গ দিয়েই শুধু পুরুষ হওয়া যায় না কিন্তু।''
ছেলের বাবা এবার হুংকার দিয়ে উঠল "আমরা আর এক মুহূর্তও এখানে বসব না''৷ "আরে কাকু সে তো একশো বার,নয়তো আমিই বলতাম আপনাদের বেরিয়ে যেতে",মৌ হেসেই বলল।
ওরা সবাই চলে গেলে কামিনী দেবী খুব কান্নাকাটি করেন,পুরো একদিন মুখ ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান।তবে মা তো,কতক্ষণ আর রাগ করে থাকতে পারেন!বাপ মরা মেয়েকে একা হাতে মানুষ করেছেন তিনি।চিন্তা তো এখনো আছে মৌকে নিয়ে।সত্যিই ওর মনের মতো ছেলে জোগাড় করা বিশাল চাপের ব্যাপার।তবে সেই ঘটনার পর তিনিও বুঝেছেন তার মেয়ে ব্যতিক্রমী,তাই ব্যতিক্রমী জামাই খুঁজতে এবার তিনি মেয়েকে আরেকটু সময় দেওয়াই ঠিক মনে করেছেন।মাকে পাশে পেয়ে মৌ এর মনোবলটাও দ্বিগুণ হয়েছে।