শক্তি রূপেন সংস্থিতা
শক্তি রূপেন সংস্থিতা
কপালে চন্দন, ছোট্ট লাল টিপ
গলায় রজনীগন্ধার মালা,
পরনে টুকটুকে লাল বেনারসী...
কি অপূর্ব সুন্দরী লাগছে রে তোকে বোন,
বলে বোঝাতে পারবো না!
কিন্তু সেদিনের সেই সদাহাস্যমান মুখটা আজ বড্ড মলিন !
কিন্তু একি! এমন সাজে তুই শুয়ে আছিস কেন?
এ সাজে তো আর দুদিন পর তোর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল।
তাহলে এখন এমন সাজলি কেন বল?
শায়িত মাথার দুদিকে এত ধূপ জ্বলছে কেন?
নেত্রপল্লবে তুলসী পাতা কেন?
নাকের মধ্যে তুলো দেওয়া কেন?
এই, কেউ সরাও এগুলো..
ওর যে কষ্ট হবে!
বোন,তুই তো এত চুপচাপ থাকিস না,
এই বোন ওঠ না, বোন রে ওঠ না
একবার ক্ষ্যাপা পাগলা বলে আমায় ক্ষেপিয়ে,
আমার কানটা মুলে দে না।
সারাদিন কত বকবক করে,
কান ঝালাপালা করে দিস,
এখন কেন মুখে কুলুপ এঁটেছিস?
ওঠ না রে বোন, ওঠ না
একবার দাদা বলে ডাক না!
একি! ঠোঁটটা ফাটা কেন?
লিপস্টিক-এর বদলে জমাট বাঁধা শুকনো রক্ত কেন?
গলায় নখের আঁচড়ের গভীর ক্ষত,
বুকের কাছে চাপ চাপ রক্ত!
ওমন নির্মল কোমল মেয়েটাকে
কারা যেন খুবলে খুবলে খেয়েছে!
সবাই বলে তুই নাকি ধর্ষিতা!!
আমি পারছি না তোর এই রূপ দেখতে,
ভগবান আমাকে অন্ধ করে দাও।
আমি যে তোকে বধূবেশে দেখার কত স্বপ্ন বুনে ছিলাম !
সব আশা শেষ করে দিল,
সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দিল, ওই মাংসলোভি পাষণ্ডগুলো।
যখন অয়নের সাথে কেনাকাটি করে
বাড়ি ফিরতে চাইলি একা,
অয়ন চেয়েছিল তোকে বাড়ী পৌঁছে দিতে,
কিন্তু তুই রাজি হোসনি,
তুই যে বড্ড স্বাধীনচেতা।
তুই ভাবতিস মেয়েরা অবলা নয়,
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মেয়েরা সব পারে!
পাগলী রে, কতবার বুঝিয়ে ছিলাম তোকে
সবাই যতই গলা ফাটিয়ে,চিৎকার করে বলুক
নারী পুরুষ সমান সমান কিন্তু
দিনশেষে নারীরা বড্ড একা,অসহায়
এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানুষরূপি কিছু জানোয়ারের কাছে।
মেয়েরা যে কোথাও সুরক্ষিত নয় পাগলি,
কতবার বলেছি তোকে...
বাইরের দুনিয়ার হাজার লোলুপ দৃষ্টি রমনীয় কায়া গিলে খায়,
ঘরের মধ্যেও
শ্বদন্তধারী কিছু হিংস্র অমানুষ ওৎ পেতে বসে থাকে নারীশরীর ছিঁড়ে খাওয়ার অপেক্ষায়।
সুযোগ পেলেই যে ওরা ওদের পৌরুষ্য জাগিয়ে,
পুরুষত্ব দেখানোর বিধ্বংসী খেলায় মেতে ওঠে!
কত করে বুঝিয়ে ছিলাম রে বোন আমার,
ওদের কাছে যে দিনরাত সবসমান,
৮মাসের শিশুকন্যা থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধা,
কেউ রেহাই পায় না ওদের কুনজর থেকে।
কেন বুঝলি না রে আমার কথা!
সেই ছোট্টবেলা থেকে মা তোর কপালে এঁকে দিতো কালো টিপ,
যাতে না কারোর কোনো কূনজর তোকে লাগে।
কিন্তু পারলাম না রে ঐ মাংসলোভি পিশাচদের কুদৃষ্টি থেকে তোকে বাঁচাতে!
ওরা যে শুধু,
তোর পার্থিব শরীরটার ধর্ষণ করেছে তা নয়,
ওরা ধর্ষণ করেছে -
তোর প্রানোচ্ছল হাসিকে,
তোর মনের অদম্য ইচ্ছাকে,
তোর সদা চঞ্চল প্রাণশক্তিকে,
অয়নকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করার
হাজার রঙ্গীন স্বপ্ন গুলোকে....
আমাকে ক্ষমা করে দিস বোন,
আমি তোর অপদার্থ দাদা!
যেই হাত দিয়ে ভাই ফোঁটা দিতিস,
পারিনি সেই হাত ধরে রাখতে।
যে হাত দিয়ে রাখীর বাঁধনে বাঁধতিস
পারিনি সেই বাঁধনে আগলে রাখতে তোকে,
পারিনি তোকে রক্ষা করতে।
তোকে ছুঁয়ে আমি শপথ করছি বোন...
ছিঃ ছিঃ একি করছি আমি!
জীব্বদশায় তোকে করা শপথ আমি রাখতে পারিনি,
আজ আবার কোন স্পর্ধায় তোর মরদেহ ছুঁয়ে শপথ করছি!
আমাকে শুধু একবার আগের মতো তুই ব্যাঙ্গমার ভঙ্গিতে বল -
তথাস্তু বৎস! আপনি যাহা চাইবেন তাহা পাইবেন, ক্ষ্যাপা দাদার মনস্কামনা পূরণ হোক!
এইটুকু শেষ বারের মতো আশীষ দে আমায়,
যারা আজ তোর মুখ থেকে দাদা ডাক শোনার অধিকার কেড়ে নিলো,
যারা তোর সাথে খুনসুটি,ঝগড়া,আবদার করার অধিকার কেড়ে নিলো,
যাদের জন্য আজ তোকে এইভাবে নববধূর সাজে শেষবারের মতো দেখতে হল আমায়,
যাদের জন্য আর জীবনে কখনো শুনতে পাবোনা -
"ভাই-এর কপালে দিলাম ফোঁটা, যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা "
যাদের জন্য আমার এই হাত খালি থাকবে প্রত্যেক রাখী বন্ধনের দিনে,
যাদের জন্য অকালে চলে যেতে হলো তোকে
তাদের যেন যোগ্য শাস্তি দিতে পারি আমরা।
এমন দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হোক যেন
কখনো কোনো নারীর দিকে কুনজর দেওয়ার আগে যেন নজরে পড়ে
মা দুর্গার চন্ডীরূপিনী মহিষাসুরমর্দিনী..
যেন নজরে পড়ে
মা কালীর রুদ্ররূপিনী মুন্ডমালিনী..
যেন কখনো ভুলে না যায় যে
নারীশক্তি অপরিমেয়, ক্ষমতা অপার।
নারীই সৃষ্টি নারীই সংহার।
চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে
চিতা থেকে ওঠা কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়া !
দূর থেকে কোথাও কানে ভেসে আসছে -
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা।
