তোমারি হউক জয়
তোমারি হউক জয়
-"বাট বাবা, বিএসএফেই কেন?"
-"আমার স্বপ্ন যে তুমি একজন সৈনিক হবে, দেশের জন্য লড়াই করবে, গর্ব করে বলতে পারব আমার ছেলে দেশের হয়ে যুদ্ধ করে| তার জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি এখন থেকেই প্রয়োজন...আশা করি আমি তোমায় বোঝাতে পেরেছি|"
-"ইয়েস বাবা, আই উইল ডু মাই বেস্ট!"
-"গুড্, মুভ অন|"
এরপর, সময় বহিয়া যায় আপন স্রোতে, বাবা অনিরুদ্ধর স্বপ্ন সফল করতে ছেলে সমুদ্র বহুদিন ঘরছাড়া| ট্রেনিং শেষ করে চাকরি পেয়েছে সে, সেই সামরিক বাহিনীতেই| মায়ের মন কখনোই চায়নি, একমাত্র ছেলেকে জেনেশুনে এমন বিপদে ঠেলে দিতে| কিন্তু অনিরুদ্ধর ব্যক্তিত্বের সামনে মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারে না নন্দনা| সমুদ্র বরাবরই মা-বাবার, বিশেষত বাবার বাধ্য সন্তান| তবে শুধুই ভক্তি নয়, বাবাকে বেশীটা ভয়ই পায় সে| আড়ালে নিজের বাবাকে হিটলারও বলে, আর ভাবে বাবার আচরণে এত বৈপরীত্য কেন?
ছেলেবেলা থেকেই দেখছে, বাবা একজন পেশাদার আর্টিস্ট, পরে আর্ট কলেজের প্রফেসরও হন| বেশভূষা, চলনবলন, চেহারা সবেতেই বাবার মধ্যে এক শিল্পসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ| এক ঐ গাম্ভীর্যটুকু বাদ দিলে বাবার পরিবারে চোদ্দপুরুষেও কারো কোনো মিলিটারি সংযোগ নেই| সমুদ্র মনেপ্রাণে চাইত সে বাবার মত হবে, অথচ বাবা তাকে একটা অন্য মানুষের ছাঁচে গড়তে চাইতেন? কেন এরকম হল? এই প্রশ্নটা সমুদ্রকে অস্হির করে তুলতো|
এরমধ্যে নন্দনা খবর দেয় সমুদ্রকে, তার মা মানে সমুর দিম্মা খুব অসুস্হ| দিল্লির বাড়িতে সমুকে ডাকছেন তিনি, ছুটির সময় সরাসরি কলকাতা ফেরার প্ল্যান বাতিল ক'রে সে যেন দিল্লি ঘুরে আসে| সমুও ছুটির শুরুতেই দিল্লি রওনা দেয়, দিম্মার বড় আদরের নাতি সে| এখানে দিম্মার শরীর এখন মোটামুটি ভালোই, দুজন লোক সবসময় থাকেই, এখন একজন নার্সও থাকেন| একদিন দুপুরে খাওয়ার পর ছাদের ঘরে গেল সমুদ্র| কত পুরোনো জিনিস, কত স্মৃতি দিম্মা এখনও আগলে রেখেছে, দিম্মার অবর্তমানে সমু এগুলো কলকাতায় রাখবে ঠিক করল| এটা-ওটা ঘাঁটতে গিয়ে পুরোনো একটা ফটো অ্যালবামে চোখ আটকালো তার, মায়ের নানা বয়সের ছবি...কয়েকটা পাতা ওল্টানোর পর তিনটে অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের ছবি, মেয়েটা তো মা সমু দেখেই চিনল| পাশে দাঁড়িয়ে বাবা, সেই চশমা...চুলটাও একই আছে, কিন্তু ঐ হাসিমুখের সুপুরুষ ছেলেটা কে? মুখটা খুব চেনা, কোথায় দেখেছে একে? ঐ চওড়া বুকের ছাতি, সরল হাসি, টিকালো নাক, কানের লতিটা অবধি সমুকে কেন প্রশ্ন করছে- কী, চিনতে পারলে না? ছবিটা পকেটে ভরে নিল, আর নিল একটা ডায়েরি, মায়ের লেখা| দিম্মা একটু সামলে ওঠায় কলকাতা ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল সমুদ্র| ফ্লাইটে পুরো সময়টায় ডায়েরীটা পড়ে শেষ করল সে, অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে সে, শুধু একটা বাদে...যেটার উত্তর শুধু বাবা দিতে পারে|
গাড়ি থেকে নেমে সোজা ছুটে এল সমু বাবার কাছে, সৈনিক ছেলের চোখে ভর্তি জল, অনিরুদ্ধ কেমন দিশাহারা হয়ে পড়ল, সমুর মুখে একটাই প্রশ্ন- "কেন বাবা?"...কিসের কেন, কি হয়েছে ছেলের নন্দনা কিছুই বুঝতে পারে না| পকেট থেকে ছবিটা বের করে বাবার হাতে দেয় সমুদ্র, আর ডায়েরিটা মা'কে...নন্দনা পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়|
-"বাবা, এত ভালবাসতে তুমি তাকে?"
-"বা রে, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল ঋষি, ডায়েরিতে পড়িসনি বুঝি?"
-"কিন্তু সব জেনে আমাকে মেনে নিলে কি ক'রে বাবা? আর তার মতই বা গড়ে তুললে কেন আমায়?"
-"আমরা তিনজনে বন্ধু ছিলাম, তবে নন্দনা আর ঋষির সম্পর্ক নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো খেদ ছিল না| আমি বরাবরই মুখচোরা ছিলাম রে, সেখানে ডানপিটে ঋষিকে নিয়ে খুব গর্ব ছিল আমার...আমার বন্ধু সৈনিক, সে দেশের জন্য লড়াই করে| ওদের বিয়েটাও স্হির হয় তাড়াহুড়োতেই, তোর আসার খবরটা জানামাত্রই| কিন্তু বিয়ের আগেই জরুরি ডিউটিতে চলে যেতে হয়েছিল ওকে| হয়ত বুঝতে পেরেছিল, তাই যাওয়ার দিন আমায় বলেছিল-
"...অনি, আমাদের জীবনের কোনো গ্যারান্টি নেই| হয়ত এবারই খবর পাবি বর্ডারে ঋষিরাজ লাহিড়ী শহিদ হয়েছে| তোর কাছে কিছু গোপন নেই ভাই, তাই বলছি, আমার কিছু হলে নন্দনা আর বাচ্চাটার দায়িত্ব তোর...তোর পরিচয়েই বড় করিস তাকে| আর ছেলে হোক বা মেয়ে, তাকে এমনভাবে তৈরী করিস যেন দেশের হয়ে লড়াই করতে পারে, তাহলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে!"
থমথমে ঘরটায় যেন বাজ পড়ল অনিরুদ্ধর গলাখাঁকারিতে, কঠিন স্বভাবের মানুষটা জীবনে প্রথমবার ছেলের মাথায় হাত রেখে বলল, "আমি তোর বাবার শেষ ইচ্ছেটা শুধু পূরণ করেছি, এই কঠিন খোলসওয়ালা বাবাটাকে ভুল বুঝিস না সমু|"
সমুদ্রের আলিঙ্গনে বাবার চোখেও জল নেমেছে ততক্ষণে, "তুমি প্রমাণ করে দিলে, জন্ম না দিয়েও বাবা হওয়া যায়, তুমি জ্যোতির্ময় বাবা, তোমার জ্যোতিতে নিভে যাওয়া প্রদীপও জ্বলে ওঠে|
পুনশ্চ: দেশমাতৃকার পায়ে যে বীর সৈনিকরা নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেন, তাঁরা প্রত্যেকে আদর্শ নিজের উত্তরসূরীদের কাছে...তাই ভারতে একটি পরিবারে একজন শহিদ হলেও অন্য কোনো সদস্য প্রস্তুত হয় নিজেকে সমর্পণ করার জন্য...জয় হিন্দ|