তিয়াশা, রজত আর রক্তকরবী
তিয়াশা, রজত আর রক্তকরবী


' ফোনটা কি গেছে না আছে? কাল সন্ধ্যে থেকে ট্রাই করে যাচ্ছি, কোনো রিং হচ্ছে না!’
ঝড়ের মতো একনিমেষে কথা গুলো বলল তিয়াসা। রজত ভাবল একবার বলে ফোনটা আছে বলেই তো তুই পেলি। কিন্তু তিয়াসার রকমফের বোঝা মুস্কিল । হয়তো রেগেই যাবে।
‘কাল সন্ধ্যে বেলা দেখলাম সিস্টেম আপডেট নোটিফিকেশন এলো। তাই আপডেটে দিলাম। কিন্তু এতোক্ষণ লাগবে বুঝিনি। ’ রজত বলল ।
‘তোর সবই বুঝতে দেরী লাগে। এই যেমন তোকে আমি কতো কথা বলি,তোর মনে থাকে কিছু? সবই তো ভুলে যাস্, কি যাস্ না?’ তিয়াসা খানিক খোঁচা মারার ভঙ্গিতে বলল।
‘নাহ্, মোটেও তা নয়। তোর শমীককে পছন্দ। তোর শমীক তোকে হেনরী থোরৌউয়ের জায়গায় নিয়ে যাবে। তোরা কাঠের কেবিনে থাকবি। তোর সামনে থাকবে প্রকান্ড এক লেক। লেকের জলে ওক পাইন আর ম্যাপেলের ছায়া পড়বে। তুই লম্বা এক বল্গাহীন কবিতা লিখবি। এসব আমার দিব্যি মনে আছে। ’ রজত খানিক স্বপনালু আবেশ নিয়ে বলে ফেলল ।
‘ আরো কিছু বল্? ব্যস্ এইটুকু? কেন রে এটা বলতে পারিস্ না যে শমীকের সাথে না তুই আমার সাথে থাক্। এটা বলতে কি তোর খুব আটকায় যে শমীক নয় আমি তোর সাথে থাকি?’
তিয়াসা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো।
‘না তা বলতে আমি পারিনা। তোর বাবা মা বোন সবাই মিলে এই সমন্ধটা ঠিক করেছে। তুইও তাতে মত দিয়েছিস্। আর তা ছাড়া হেনরী থোরৌউয়ের দেশে তোকে আমি কোনোদিন নিয়ে যেতে পারবোনা। কেন মিছিমিছি তোর স্বপ্ন ভাঙবো আমি? বল্?’
‘সেই তো। তুই তা বলবি কেন? কিন্তু তুই একটা কথা বল্ তোর সাথে না কথা বললে আমার ভালো লাগে না। তোর গলার স্বর, তোর কবিতার ঢেউ, তোর লেখা গল্প, তোর হারিয়ে যাওয়া মন আর তাতে আমার নিজেকে দেখা, এগুলো নিয়ে কি করি?’
‘ওটা তোর ছেলেমানুষি । কেটে যাবে। চিন্তা করিস্ না। ’
রজত খানিক আশ্বস্ত করল তিয়াসাকে।
‘হবে হয়তো। আচ্ছা এমন হয় না তুই ও থাকলি আর শমীক ও থাকলো। হয় না?তুই তো বলেছিলিস্ তুই আমার এমন বন্ধু যে আমার সব কিছুর সঙ্গী । আমার নিছক ছেলে বন্ধু নোস্। তুই আমার মেয়ে বন্ধুও । ধর তুই যদি সত্যিই মেয়ে হতিস্ তাহলে তোর মেল্ ইগো কি কাজ করতো? শমীকের ব্যাপারে? তুই কি এক মেয়ে হয়ে আমার কথা বুঝতি না?’
তিয়াসা জিগ্গেস করলো।
রজত কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। ওর ঘরের জানলা দিয়ে ও রক্তকরবী গাছটা দেখছিলো। লাল গোলাপী রঙে সেজে গাছটা মাথা দোলাচ্ছে ।
‘কি জানি? অতো সহজে কি পুরুষের সত্বা বিসর্জন দেওয়া যায়? তুই বল্?’
‘ না যায় না। কিন্তু তুই পারতিস্। একমাত্র তুই। কারণ তুই লিখিস্। তুই মেয়েদের নিয়ে লিখিস্। তুই আমার সব জানিস্। আমার নষ্ট হয়ে যাওয়া। আমার শরীরের ওপর যতো আচোঁড়। সব জানিস্। তবু তুই আমাকে দূরে দূরে রাখিস। স্বার্থপরের মতো। শমীককে আমি বিয়ে করবো না। শুধু তুই একবার বল্। বল্ না প্লিজ্। ’
তিয়াসার আবেগঘন কণ্ঠস্বর রজতকে আরো একবার দুর্বল করে দিচ্ছিল। রজত টের পাচ্ছিল ওর গলার কাছে কেমন যেন দলা পাকিয়ে আসছে কান্নাগুলো।
তার পরই মনে পড়লো তিমীরবরণের হুঙ্কার । ওর ফোনে।
মাস খানেক আগে।
সেদিন অফিসের কাজ সেরে বাড়ি ফিরে অসুস্হ বিধবা মায়ের কাপড় জামা কেচে, ওনাকে রাতের খাবার দিয়ে নিজের জন্যে রাখা সকালের একমুঠো ভাত আর বিস্বাদ হয়ে যাওয়া তরকারী কোনোক্রমে গলাধ:করণ করে ও সবে বারান্দায় বসেছিল।
জ্যোৎস্না রাতের মায়াময় আকাশের দিকে চেয়ে তিয়াসার কথাই ভাবছিলো। আর তখনই তিমীরবরণের ফোনটা এসেছিল। একটা আন্নোন নাম্বার থেকে।
‘শোনো হে ছোকরা। কবে থেকে এলাইনে আছো তুমি আমি জানিনা। তবে যদি ভেবে থাকো কোনো বড়োলোক বাড়ির মেয়েকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করে তুমি রাজকন্যা আর রাজত্ব পাবে তবে জেনে রাখো আমিও জানি কি করে তোমার মতো ছোকরাদের শায়েস্তা করতে হয়। তুমি আমার মেয়েকে ফোন করবে না। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আশা করি আমার কথাটা মনে রাখবে। আর ছোটলোকের মতো যদি তুমি আমার মেয়েকে এই ফোনকল্ নিয়ে কিছু বলো তোমার ব্যবস্হা আমি করবো। জেনে রেখো আমি তিমীরবরণ রায়। তোমার পাড়ার সব ক্লাবেই আমি চাঁদা দিই। আর থানা পুলিশ ও সব আমার পকেটে থাকে। ’
‘আপনি নিশ্চিন্তে আপনার মেয়ের বিয়ে দিন। আমি ফোন করবো না আপনার মেয়েকে। ’
এই বলে ফোনটা কেটেছিল রজত।
জ্যোৎস্না রাতের চাঁদ তাকে দেখেছিল শুধু। তার চোখের কোণায় জমে থাকা চিক্ চিকে রুপালী রঙ ।
ঘরের ভেতর থেকে মায়ের ডাক এসেছিলো ঠিক তখন।
‘খোকা আমার বেডপ্যানটা একটু দে। ’
‘যাই’
বলেছিলো রজত।
‘কি রে? হঠাৎ চুপ করে গেলি যে? কি ভাবছিস্?’তিয়াসা জিগ্গেস্ করলো অবাক হয়ে। ‘কোথায় আবার হারিয়ে গেলি?’
‘শোন্ তুই শমীককে বিয়ে কর। আমি আসলে তোকে কোনোদিনই ঠিক বন্ধু ছাড়া কিছু ভাবি নি। আর তুই বলছিলিস্ না তোর মেয়ে বন্ধু হতে, তাই আমি আরো বলছি শমীকের থেকে তুই অনেক ভালোবাসা পাবি। জীবনের নানা রং পাবি। অনেক দেশ তুই ঘুরতে পারবি। অনেক অনেক কবিতা তুই লিখতে পারবি। তুই সাতরঙা রামধনু পাবি। মেঘেদের সাথে ডানা মেলে প্লেনে চড়ে নীল আকাশে ভাসতে ভাসতে শমীকের ঘাড়ে মাথা রেখে এক নিশ্চিন্ত জীবনের আস্বাদ পাবি সবচেয়ে বড়ো কথা তুই এক দারুণ লাইফ্ পাবি। আ লাইফ্ উইথ্ নো রিগ্রেট্স্। '
এই বলে ফোন রেখেছিলো রজত।
রক্ত করবীর গাছটিকে তারপর বেশ খানিকক্ষণ ধরে দেখেছিলো সে।
চলে যাওয়া বসন্তের শেষ হাওয়া গায়ে মেখে রোদ্দুরে একাকী গাছটি যেন রজতের কথা শুনে মাথা নাড়ছিলো। তা সম্মতির না অসম্মতির তা রজত বুঝতে চায়নি