সুতো
সুতো
আজও রাতে বাড়ি ফিরল না আসিস । এখন মাঝে মাঝেই এমন করে ।আগে তা হলেও সর্বানি কে ফোন করে বলে দিত এখন সেটুকু করে না ।
আর পারছে না সর্বানি। দিনের পর দিন , এরকম মানসিক অত্যাচার আর কতদিন চলবে ! লোকে নানা রকম কথা বলে ওর রাতে বাড়ি না ফেরা নিয়ে । এরমধ্যে আবার নন্দার কথাও ওঠে । অনেকের কথায় , নন্দার বারুইপুরের ফ্ল্যাটটাই এখন ওর রাতে থাকার জায়গা।
তবে সর্বানির একথায় বিশ্বাস নেই, ওর মনে হয় যতই অপমান করুক , তবু আসিস ওকে ছেড়ে যাবে না। হাজার হোক , একদিন তো ওর ওই কালো চোখের মায়াতেই ওকে ভালবেসেছিলো । তবু সর্বানির এখন মাঝে মাঝে মনে হয় , এ আসিস বোধহয় সেই আসিস না। সেই আসিস মিষ্টি করে কথা বলতে জানতো রাগ ভাঙাতে জানতো, হাত ধরে কাছে টানতে জানত । কিন্তু এ আসিস এসব জানে না । শুধু জানে , ওর কালো রং নিয়ে খোটা দিতে, ওর প্রতি উদাসীনতা ভরা মন নিয়ে রোজগার কাজগুলো করে যেতে ।
কিন্তু সর্বানি তো সেই একই আছে, । এখনো ওর কাল কপালে টিপ পরে, আসিস এর জন্য , এখনও ওর কালো হাত দুটো দিয়ে লাউ চিংড়ি রান্না করে । কিন্তু যখন আসিস অফিস থেকে ফিরে দূর থেকে "খেয়ে এসেছি " বলে দিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় ,তখন সর্বানিরও অন্য কেউ হতে ইচ্ছে করে । ও ভুলে যায়, ও সেই কাটোয়ার কাল হাতে লাল চুড়ি পরা সর্বানি , যে কিনা একদিন আসিস এর সাথে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল ।
বেশ ধনী ঘরের মেয়ে ছিলো ও । বাবা রুলিং পার্টি পলিটিকাল লিডার । কালো হলেও দিব্যি বিয়ে হয়ে যেত ওর । কালো , অসুন্দর , এগুলো শুনতে শুনতে আর উপেক্ষা পাওয়ার অভ্যাস নিয়ে বেশ ছিল ও । কিন্তু হঠাৎই ওর জীবনে ঝিরঝির বৃষ্টির মত এল আসিস ।কাটোয়া ব্যাংকের ক্লার্ক ছেলেটা যখন ওকে বলল - কালো হলোও তোমাকেই ভালোবাসি সর্বানি, তখন প্রথম শুনল ওকেও কেউ ভালবাসতে পারে । সেই ভালোবাসার জোরে থেকে ঘর থেকে পালিয়ে ছিল ।
আজ আজ সর্বানি রাখুন সব সময় মনে হয় ওরা একটা তালাতে বন্ধ। দুজনেরই যাওয়ার কোন জায়গা নেই ।তাইতো সব সময় আসিসও চেষ্টা করে ওর সাথে ভালবাসার অভিনয় করতে । সর্বানি জানে ওদের সম্পর্কটা এখন একটা সুতোয় ঝুলছে ।তালাবন্ধ সম্পর্কটার চাবিটা হারিয়ে গেছে কোথায় ! সর্বানি কে ও
র মা এখনো মাঝে মাঝে ফোন করে । বলে, ফিরে আসতে । কিন্তু কি করে যাবে, এই তালাবন্ধ সম্পর্কটাতে বেরোনোর চাবি তাই তো তার নেই, আসিস এর ভালোবাসাটাই তো আর নেই ।
ও স্পষ্ট মনে আছে, পালাবার আগে ওর এক দিদি ওকে বলেছিল -"ওটা ওর মোহ।ও তোকে ভালোবাসে না ।"
ঠিক তাই । মোহ ভাঙতেও বেশি সময় লাগেনি । 5 বছরের মাথায় আসিস আবিষ্কার করে ও খুব হ্যান্ডসাম । সর্বানি কালো আর ওর অফিসের সহকর্মী মন্দা অনেক বেশি সুন্দরী । কিন্তু মানুষ হিসেবে খারাপ নয় । তাই বিবেকের তাড়নায় কখনো ডাইরেক্ট বলেনি সে কথা।
বিপ বিপ ফোনটা কেটে দিলো। সর্বানি আর ফোন করে না । শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নেয়। আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে । আর না , আজ তাকে মুক্তি পেতেই হবে এই তালা বন্ধ ঝুলন্ত সম্পর্কটা থেকে।
বারুইপুর বেশি দুর না । রেডি হয়ে , রাস্তায় নামে । রাত প্রায় দশটা । অটো পেতে একটু দেরি হয় । রাত দশটার সময় একা অটো করে কোথাও যাবে এত সাহস ছিল না সর্বানীর ।কিন্তু পরিস্থিতি মানুষকে সাহসী করে তোলে।
বারুইপুরের 10 নম্বর ফ্ল্যাটের দরজায় দুবার কলিং বেল টিপতে সাড়া আসে । হাত কাটা নাইটি পড়ে বেরিয়ে আসে নন্দা । সামনে সর্বাণীকে দেখে চমকে যায় । ওকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায় সর্বাণী । বেড রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে থাকা আসিসের দিকে চেয়ে বলে - "বলে আসতে পারো না ,এখানে এসেছ? সত্যিটা কেন বলছো না আসিস? বলো না যে , আমাকে ভালোবাসো না, বলো না প্লিজ । আমাকে মুক্তি দাও । আর ভালো লাগে না তোমার এই অভিনয়।
ধীরে ধীরে আসিস বলে -" না সর্বানি, সত্যি ভালোবাসতে পারি না তোমাকে । আর ভালোবাসি না ।
" প্লিজ, কাল সকালে আমি ডিভোর্স পেপার পাঠানোর আগে বাড়ি ফিরবে না , প্লিজ ।" কান্না অবরুদ্ধ গলায় বলে সর্বাণী ।তারপর বেরিয়ে যায় ধীরে ধীরে ।কোথাও যেন তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে । আর কোনো ভালোবাসি অভিনয় নেই , তালাবন্ধ সম্পর্ক নেই , ভারি ভালো লাগছে । মুক্ত হওয়ার আনন্দে রাতের কলকাতায় পথ চলতে চলতে ওর মনে হয় , আজও নিজের হাতে ছিড়ে দিয়েছে সম্পর্কের সুতোটা। মাটিতে ছুড়ে দিয়েছে তালাটা। চাবি নেই বলে খুলতে পারবে না এটা ঠিক, তবে তা বলে মাটিতে আছড়ে, আঘাতের পর আঘাত দিয়ে ভাঙতেও কী পারবে না ???