Ashesh Sengupta

Romance Tragedy Classics

4.0  

Ashesh Sengupta

Romance Tragedy Classics

সূর্যাস্ত (পুজো সংখ্যা)

সূর্যাস্ত (পুজো সংখ্যা)

5 mins
223



আজ বিকেলের আড্ডাটা বেশ জমিয়ে বসেছে। রামুর চায়ের দোকানের সামনের রোজাকার বিকেলের আড্ডা।রাজনীতি থেকে সিনেমা, স্বর্ণযুগ থেকে বর্তমান যুগ সব নিয়েই তর্ক চরমে। ভাড়ের পর ভাঁড় চা নিমেষে শেষ হয়ে গেল আড্ডার ছলে। মুকুন্দ বাবু এমনিতে সরল মানুষ রোজ বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে এখানেই বসে গল্প করেন। যদিও সকলে সমবয়সী নয় তবে একই এলাকায় থাকেন সবাই। কালা ভোম্বল হঠাত্ মুকুন্দকে উদ্দেশ্য করে বলল

:-" কী হে ভায়া, তোমার শাগরেদটি কে আজ দেখছি না, ওহ সে বুঝি আজ আসেনি। নির্ঘাত কোন দেশউদ্ধার করতে গেছে,,,"

মুকুন্দ কথা গুলি জবাব দেওয়ার আগেই সমীরণ বাবু বলে উঠলেন

" আহ! থাম তো ভায়া,

 অরুণ সমাজসেবি মানুষ, দীন দরিদ্রের জন্য সে যা করে তা আমরা ক-জনেই বা করতে পারি।"

মুকুন্দ এবার মুখ খুলল:- 

" সে আর ক-জনে বুঝে সমীরণ দা। অরুণটা আজ নিশ্চই কোন কাজে আটকে গেছে। নাহলে দেরী হবার কথা নয়।"

সমীরণ:- " হ্যা সত্যি! অরুণ খুবই সময়নিষ্ঠ ছেলে।"

বলতে বলতেই হারু দৌড়ে দৌড়ে এলো খবর দিতে।

হারু: " ওওও মুকুন্দ দা, মুকুন্দ দা গো, শিগগিরি চলো। অরুণ দা তোমায় যেতে বললে এখুনি।"

মুকুন্দ: " কী রে হারু কী হয়েছে?"

হারু: "ওতো জানিনে আমার সময় দেখলুম। অরুণ দা আর বাচ্চু কোথায় যেন যাবে। তোমায় এখুনি যেতে বলল।"

মুকুন্দ: " সমীরণ দা আজি উঠি তাহলে।"

হারুকে সঙ্গে নিয়ে মুকুন্দ ছুটল অরুণের বাড়ি। মুমূন্দ আর অরুণ ছোট বেলার বন্ধু স্কুল, কলেজ সবই একসাথে করেছে ওরা। সুখে দুঃখে এক অপরের সাথী ওরা। মুকুন্দর মনটা কেমন করেছে। নিশ্চই কিছু ঘটেছে।বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে অরুণ, মুকুন্দকে দেখেই এগিয়ে এলো অরুণ। বলল

: " তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, তাড়াতাড়ি চল।"

মুকুন্দ:- " কী হয়েছে, আগে বল বাড়িতে সব ঠিক আছে তো?"

:- "বাড়িতে সব ঠিক আছে কিন্তু,,,"

:- " কী হয়েছে বলো"

:- " একটা খারাপ খবর আছে। ভোলা কাকা আর নেই।"

মুকুন্দ একমুহুর্ত থমকে গেলো। কয়েকমুহুর্ত চুপ থেকে মুকুন্দ:-

" কীভাবে হলো?"

:- " হঠাত্ই আজ দুপুরে, এখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই চল দেরী হচ্ছে।" 

অরুণ আর মুকুন্দ বেরিয়ে গেল ভাগ্নে বাচ্চু কে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা পথে বেশী দূর নয় ভোলা দাসের বাড়ি।


বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখল বিশাল জটলা। লোকে লোকারন্য বাড়িটাই ঢুকতেই দেখল ভোলা কাকার শায়িত দেহ তার পাশে বসে ওনার স্ত্রী কাঁদছে। ওদের দেখেই উনি উঠে দাড়িয়ে চিৎকার করে বললেন:" তোমরা এসেছ বাবা তোমরা এসেছ, দেখ না তোমাদের কাকা আর নেই গো আমাকে রেখে চলে গেছে।"

অরুণ উনাকে সামলাচ্ছে। মুকুন্দ তখনও নিশ্চুপ। বোধহয় কথা খুঁজে পাচ্ছে না। লোকেরা উনার সৎকারের আয়োজন করছে। মুকুন্দ বারান্দায় বসে দেখছে সব। মনের অজান্তেই তার মনে পড়ে গেল পুরানো কথা।


ভোলা তাদের বাড়ির পুরানো ভৃত্য ছিল। যাকে বলে প্রায় তিনপুরুষের বিশ্বস্ত। মুকুন্দ কে জন্মাতে দেখেছে সে। ছোট থেকে কোলে পিঠে করে মানুষও করেছে বলা চলা। বিকেলে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া স্কুলে নিয়ে যাওয়া সবই ছিল ভোলার কাজ। তবে পরিবারে তার স্থান ছিল পরিবারের সদস্যদের মতই। মুকুন্দর বাবার ইচ্ছেতেই ভোলার পরিবার ওদের বাড়ির কাছেই একটা জায়গায় তাদের বসতি গড়ে তুলে। মুকুন্দ ছোটবেলা থেকেই তার ভোলা কাকাকে ভীষণ ভালবাসত।

ভোলার একটি মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল বকুল। সে তার বাবার সাথে প্রায়ই মুকুন্দ দের বাড়িতে আসত। মুকুন্দ বয়সে খানিক বড়ো হলেও বকুল আর মুকুন্দ ছিল এক অপরের খেলার সাথী আর তাদের সঙ্গে অরুণ তো ছিলই। তাদের ছোটবেলাটা একসাথে হাসি, ঠাট্টা, খেলায় দারুণ কেটে গেল। ভোলা তার মেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে কোন দ্বিধা করেনি। অবশ্য মুকুন্দদের বাড়ির অবদান তাতে কম ছিলনা। 

ধীরে ধীরে তাদের বড়ো হয়ে উঠা। মুকুন্দ, অরুণদের বাইরে পড়তে চলে যাওয়া। সব কথা ভেসে উঠছিল মুকুন্দ চোখে।

অরুণ এবার মুকুন্দ কে বলল "চল যেতে হবে।"

লোকেরা কাঁধে করে নিয়ে চলল ভোলার অন্তিম যাত্রায়। সঙ্গে মুকুন্দ আর অরুণ। দেখতে দেখতে অনেক টা পথ পেরিয়ে শবযাত্রা পৌঁছল তার গন্তব্যে। 


চিতা সাজানো হচ্ছে। পুরোহিত কাজ করছে। মুকুন্দ আবারো গাছ তলায় বসে পড়ল। তার মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা এরকমই শ্মশানে একদিন হাহাকার করেছিল ভোলা কাকা। দাড়িয়ে শুধু নীরবে দেখেছিল সে কিছু করতে পারেনি।


বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষে ওরা দুজন যখন বাড়ি ফিরল, তখনও সে ভাবেনি তার জীবনটা বদলে যেতে চলেছে। 

পুকুরের সেই প্রথম ফিরে এসে বকুলকে দেখেছিল মুকুন্দ। সে নিজের চোখ বিশ্বাস করতে পারেনি, একী সেই বকুল যার সাথে সে ছোট বেলায় কত খেলেছে। বকুল সেইদিন ছিল তার চোখে অপুরুপা এক নারী। অরুণ কে সেইদিনই সব বলেছিল মুকুন্দ। অরুণ সাহস দিয়ে বলেছিল

-" মনের কথা মনে রাখতে নেই বলে দে, যা হওয়ার হবে।"

দোল পূর্ণিমার দিনে বকুলকে রাঙিয়ে দিয়ে মনের কথা বলেছিল মুকুন্দ। বকুল বরাবরই নম্র স্বভাবের, সে শোনা মাত্রই লজ্জ্বায় পালিয়ে গিয়েছিল সেদিন। এইভাবেই তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে মধুর সম্পর্ক তৈরী হয়।

বকুল তবু সবসময় ভয় পেত যদি পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে না নেয়। সে সময় বলত মুকুন্দকে 

:-" আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যাবে না তো।"

হেসে মুকুন্দ বলেছিল

:-" কোনদিনও না। এই তোমায় ছুঁয়ে কথা দিলাম"

কিন্তু কোথায় কী সম্পর্ক জানাজানি হতেই বাড়িতে হুলুস্থুলু হয়ে গেল। মুকুন্দ তার বাবাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলেও তিনি রাজি হননি। বলেছিলেন

:- " কাজের লোকের মেয়েকে অনুগ্রহ করা যায়। কিন্তু তার সাথে সম্পর্ক করা যায় না।"


তিনি ভোলাকে অব্দি চুড়ান্ত অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। 

অরুণ বলেছিল সব কিছু ছেড়ে বিয়ে করে পালিয়ে যা ওকে নিয়ে।

ঠিকও হয়েছিল সব। যেদিন তারা বিয়ে করবে সেইদিন কনে সেজে মন্দিরে অপেক্ষা করছিল অরুণ আর বকুল এবং ভোলার পরিবার। 

কিন্তু মুকুন্দ আর আসতে পারেনি। মিথ্যে অসুস্থতার ভয় দেখিয়ে তাকে আটকে রেখেছিল তার বাবা।


এইদিকে সারা রাত অপেক্ষা করে বকুলেরা বসে আছে। শেষমেষ মুকুন্দর না আসা মেনে নিতে পারেনি বকুল। লগ্নভ্রষ্টা মেয়েকে যে কেউ মেনে নেবে না তা সে জানত। সেইরাতেই সে আত্মহত্যা করেছিল। ঠিক এরকমই একদিনে অরুণ এসে তাকে নিয়ে গিয়েছিল শ্মশানে। বকুলের নিথর দেহ যেন একরাস অভিমান নিয়ে সেদিন নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে ছিল। ভোলা কাকার সেইদিনের হাহাকার আজও তার কানে বাজে। মেয়ের চিতায় আগুন দেওয়া বাবার কান্না আর জ্বলন্ত চিতার দাবদাহ সেদিন মুকুন্দ কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে।


আজ সেই ভোলা কাকাও চলে গেছে, হয়তো বুকে একরাস বেদনা আর অভিমান নিয়ে। পুরোহিত বলে উঠলেন

:-" মুখাগ্নি কে করবে?"

চারিদিকে স্তব্ধতা। এই দুনিয়ায় ওনার কেউ বা আছে আর। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে মুকুন্দ বলল:-" আমি দেব মুখাগ্নি। উনি আমার পিতৃতুল্য ছিলেন।"

মুকুন্দ মুখাগ্নি দিল তার ভোলা কাকাকে। শেষকৃত্য সম্পন্ন করে যখন সবাই ফিরল তখন প্রায় সন্ধ্যা। নদীর ওপারে অস্তমিত সূর্য যেন ভোলার অন্তিম যাত্রার শেষ আলোটুকু নিয়ে ডুবে গেল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance