সাজ
সাজ
আজ ঘুম ভাঙল বেশ দেরি করেই, আসলে অ্যালার্ম ঘড়িটা কাল থেকে খারাপ হয়ে পরে আছে। অবশ্য এক বেকার মানুষের অ্যালার্ম ঘড়ির কি বা প্রয়োজন? তাই আর ঠিক করেতে দেওয়া হয়নি। বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলে মোবাইলটা রাখা, অনেক্ষন থেকে বাজছে, তার আওয়াজেই বোধহয় ঘুম ভাঙল আজ। জানলার বাইরে এক থমথমে মেঘলা আকাশ মনটাকে উদাশ করে তুলছিল, আপনমনে জয় সেদিকেই তাকিয়ে ছিল, তবে দ্বিতীয় বারের রিং, ঘোরটা কাটিয়ে দিল, খানিকটা বিরক্ত হয়ে এসেই ফোন ধরল। অচেনা নম্বর, বিরক্ত হয়েই হ্যালো বলল সে, ওপার থেকে যে গলা ভেসে এল তা যেন আজন্মচেনা,
তবে যেন কিছুতেই ঠাওর হচ্ছে না। ওপার থেকে ভেসে এল এবার ছোট্ট একটা কথা,
“আমি রাই বলছি। ভাল আছিস জয়?”
ওই একটা নাম যেন স্মৃতির সাগরে ভাসিয়ে দিল একনিমেশে। রাই? এতগুলো বছর পর? সত্যি রাই তাকে ফোন করেছে? অনেকক্ষণ কোন উত্তর না পেয়ে রাই বলল, “কিরে? কথা বলবি না?” কি বলবে জয়? আর কি বলার আছে? ৪ বছর আগে রাইএর সাথে যা করেছিল সে, তার পরে ওর সাথে কোন মুখে সে কথা বলবে?
তবুও জোর করে বলল,
"হ্যাঁ বল । আমার এই চলে যাচ্ছে রে, তোর খবর বল, ভাল আছিস?"
-আমি ভাল নেই রে জয়, একদম ভাল নেই...
-কেন রে কি হয়েছে?
-দাদা আজ ৩ মাস যাবৎ ক্যানসারে ভুগছে, লাস্ট স্টেজ...
রোহানদার ক্যানসার? সেই লম্বা সুপুরুষ মানুষটা, সেই হাসি খুশি, আড্ডাবাজ মানুষটা আজ কর্কট রোগে আক্রান্ত? কি বলছে রাই? না এটা হতে পারেনা... রোহানদা এভাবে শেষ হয়ে যেতে পারেনা, কিছুতেই না। ওপারের কান্নার আওয়াজ পেয়ে অবিশ্বাস ভরা গলায় যেন চেঁচিয়ে উঠল,
-কি বলছিস তুই? কবে হল এসব?
-আমি আর সহ্য করতে পারছি না জয়, আর পারছি না... দাদা চোখের
সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে...
-নিজেকে সামলা রাই, এখন তো তোকেই শক্ত হতে হবে, রোহানদা কে
সাহস যোগাতে হবে তো...
-আর আমায়? আমায় কে সাপোর্ট করবে জয়? কে আমায় সামলাবে? ৩ মাস
ধরে সকলকে সামলাতে সামলাতে আমি ক্লান্ত, আমিও তো ভেঙ্গে পরছি... কেউ নেই যাকে একটু
পাশে পাব...
এর কি উত্তর দেবে জয়? পাশে তো ছিল একসময়, তবে থাকতে পারল কই?
আজ ৪ বছর পর রাই যে তাকে ফোন করেছে, এখন শুকনো সান্ত্বনা ছাড়া আর কি বা দিতে পারে
সে?
-নিজেকে শক্ত কর... সব ঠিক হয়ে যাবে, একটু ধৈর্য রাখ।
-আর কত ধৈর্য রাখব রে? কেমো কাজ করছে না, ডাক্তার প্রায় জবাব
দিয়েই দিয়েছেন... আমি এবার ভেঙ্গে পরব, আমি আর পারছি না যে...
-কোথায় আছে রোহানদা?
-ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার রিসার্চে... একবার আসবি জয়? একবারটি
আসবি? দাদা তোকে দেখতে চেয়েছে।
রোহানদা দেখতে চেয়েছে? আজ এতগুলো বছর পর রোহানদা তাকে দেখতে
চেয়েছে? বেশ তো সামলে ফেলেছিল নিজেকে, আবার এত বছর পর কেন এই আমন্ত্রণ? যেই সময়
জয়ের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল তখন তো আসেনি রোহানদা, একবারের জন্যেও ফিরে তাকায়নি,
আর আজ মৃত্যুশয্যায় কি দরকার তার সাথে?
রাই উত্তর না পেয়ে কাতর গলায় আরেকবার অনুরোধ করল,
-আসবি না? একবারের জন্যে পুরনো সব কথা ভুলে, একবারও কি আসা
যায় না?
-আমি কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াব বলতে পারিস? ৪ বছর আগের
স্মৃতিগুলো আবার ঘাটার কি দরকার বলতে
পারিস?
-জয়... দাদা প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর মুখে ঢোলে পরছে,
তোকে একবার শেষ দেখা দেখতে চেয়েছে। প্লিজ জয়...
এই অনুরোধ কি করে ফেলবে জয়? একটা মানুষ জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে তার আশ্রয় চেয়েছে, তাকে ফেরায় কি করে? এতটা নিষ্ঠুর কি করে হবে?
-তাহলে তুই আসবি না? দাদা কে কি বলব জয়? আমি কি বলব সেটা বলে
দে...
খানিকটা চুপ থেকে জয় বলল, “বলিস আমি কাল বিকেল চারটে নাগাদ
আসছি...”
-থ্যাঙ্কু জয়... আসিস, দাদা অপেক্ষা করবে তোর...
-আর তুই?
২
সকালের প্রথম ফ্লাইট ধরে সোজা নেমেছে দমদম বিমানবন্দরে। রাইয়ের ফোন, রোহানদার ক্যানসার, কলকাতায় ফেরার সুযোগ, সব মিলিয়ে যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল ২ ঘণ্টা। সামনে একটা ট্যাক্সি খালি হচ্ছে দেখে সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ট্যাক্সি থেকে নামলো চারজন, তাদের কথোপকথন থেকে জয় বুঝল, পরিবারের কেউ বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। একটু তফাতে দাড়িয়ে তাদের বাক্যালাপ শুনছিল, আর নিজের চার বছর আগে কলকাতা ছাড়ার দিনটা মনে পরছিল। ।
এই ছেলেটা ভাগ্যবান, তার পরিবার তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার বেলায় সে একা এসেছিল, একেবারে একা। কারণ সিধান্তটাও যে তার একারই। ট্যাক্সি খালি হতেই, ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতাল বলে, তাতে চেপে বসল জয়, আর কিছুখনের মধেই বিমানবন্দর ছেড়ে ঢুকে পরল তার শহর, কলকাতায়।
এক একটা রাস্তা তার চেনা ছিল একসময়, কতবার সে একা একাই ঘুরে বেড়িয়েছে এই রাস্তা ধরে, কিন্তু আজ যেন বড্ড অচেনা এই শহরটা। কেমন যেন সবটা পালটে গেছে, অবশ্য পালটাবে নাই বা কেন? কলকাতা ছেড়ে পালানো থেকে আবার কলকাতার বুকে ফিরে আসার মধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। বদলায়নি শুধু একটা জিনিস, তা হল অনুভূতিটা। অনেকদিন পর নিজের ঘরে ফেরার যে অন্যরকম অনুভূতি, এক অদ্ভুত শান্তি, সেটা এক চিলতেও বদলায়নি। ট্যাক্সিটা ক্যান্সার হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়াল, ভাড়া মিটিয়ে হাসপাতালের সিঁড়ি বেয়ে রাইয়ের কথামত তৃতীয় তলে পৌছাল জয়। তবে কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল, কিকরে সে এত বছর পর রোহানদার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে?
হঠাৎ খুব চেনা সেই গলায় রাই ডাকল তাকে, “জয়? এদিকে আয়।”
পিছন ঘুরে রাইকে দেখে যেন এক লহমায় চার চারটে বছর পিছিয়ে গেল জয়, অজস্র স্মৃতি ভিড় করে উঠল মনে, একরাশ যন্ত্রণা, ক্ষোব, আক্ষেপ যেন মনটাকে ভারী করে তুলল। রাই আবার ডাকল,
-এদিকে আয় জয়...
-হ্যাঁ, আসছি।
-কেমন আছিস তুই?
-যেমন দেখছিস...
-হুম...
-আর তুই?
-আমি?
-হ্যা তুই, কেমন আছিস?
-দাদা অপেক্ষা করছে রে, এদিকে আয়।
রাইয়ের পিছন পিছন কেবিনে ঢুকল জয়, সামনের দৃশ্য তার চোখের
অশ্রুধারাকে আটকে রাখতে পারল না। যেই মানুষটাকে বরাবর দেখে এসেছে পাঠ-ভাঙা
পাঞ্জাবী আর ঠোটের কোনায় এক অমলিন হাসি নিয়ে, সে আজ সাদা চাদর চাপা দিয়ে আধশোয়া
হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। জয়কে দেখে সেই দীর্ঘাকায় ক্লান্ত মানুষটা অনেকদিন
পর যেন অল্প হাসার চেষ্টা করল।
-দাদা, দেখ জয় এসেছে, তুই বলেছিলি না ও আসবে...
-জয় যে আসবেই, ওকে যে আসতেই হতো...
-রোহানদা, কেমন আছো গো? এসব... কিকরে?
-রাই, তুই একটু বাইরে যা তো, আর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাস। আর
হ্যাঁ, দেখিস তো, জয় না বেরনো অবধি কেউ যেন না ঢোকে।
-মানে... বাইরে? কেন?
-ওফ... বললাম তো, যা। ওর সাথে আমার একটু কথা আছে। তুই যা...
রাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই, রোহানদা জয়ের দুত হাত চেপে ধরল।
কাতর গলায় বলল,
-আমায় ক্ষমা করে দিতে পারবি জয়?
-কিসের ক্ষমা?
-এরম করিসনা জয়, তুই তো সবটাই জানিস। আমার হাতে আর বেশীদিন
নেই... ক্ষমা করবি না আমায়?
-অসব পুরনো কথা থাক না, কেন আবার ওই কথা বলছ?
-পুরনো কথা হলেও, অপারাধবোধ আমায় রোজ কুঁড়ে কুঁড়ে খায় জয়...
আমি ঘুমোতে পারি না।
-তুমি তো ভুল করনি, ভুল তো আমার...
-না জয় না, ভুল তো আমার সবচেয়ে। সেদিন তোর ভালবাসার মান
রাখতে পারিনি আমি, সমাজ, সংসারের চোখরাঙানীতে ভয় পেয়েছিলাম যে।
-থাক সে সব কথা...
-না আজ আমায় বলতে দে জয়... তোকে আমি ভালবাসতাম জয়, বড্ড
ভালবাসতাম, তবে তখন রাইয়ের বিয়ে দেওয়া বাকি, সেইসময় তোর আর আমার সম্পর্ক যে সমাজের
কলঙ্কের দাগ দিত তাকে ভয় পেয়েছিলাম। তাছাড়া রাই তোকে ভালবেসে ফেলেছিল রে। ওর চোখের
সামনে আমি এটা কিকরে করতাম?
-সব মেনে নিলাম... তবে একবার যখন সবাই আঙ্গুল তুলল আমার
দিকে, যখন সকলে কালি মাখাল আমার মুখে,
তখন কি একবার বলা যেত না যে সেদিন ঘরের দরজাটা তুমি বন্ধ করেছিলে? একবার কি পাশে
এসে দাঁড়ানো যেত না এই বলে যে ওর কোন দোষ নেই, আমি এই সম্পর্কটা শুরু করেছিলাম?
-আমি খুব লজ্জিত জয়, আজও ওই চিৎকার আমার কানে বাজে। রাত্রে ঘুম ভেঙে যায় তোর কালি
মাখা মুখটা মনে পরলে। সেদিনকার স্বার্থপরতা আজ আমায় কাদাছে প্রতিদিন। তোর সাথে যে
অন্যায় আমি করেছি, তার প্রায়শচিত্য আমায় এই জীবন দিয়েই করতে হচ্ছে।
-অরম করে বল না রোহানদা, কষ্ট হয়... অসব কথা আর মনে রেখো না,
অনেক দিনের আগের কথা। আজ আর সেদিন নেই, তাই ওই কথা বলেও লাভ নেই।
-হুম...
কিছুটা দম নিয়ে রোহান বলল, " একটা আবদার করব রাখবি? শেষ বারের মত?"
-বলো...
-একবারটি কাজল দিবি চোখে? তোর কাজল কালো চোখটা দেখেনি
শেষবারের মত।
ব্যাগ থেকে কাজলটা বার করে ভেজা চোখে কোনমতে কাজল পরল জয়।
রোহান অপলক দৃষ্টি দিয়ে মুহূর্তটাকে অনুভব করছিল, হঠাৎ কাজল পেন্সিলটা হাত থেকে
পরে গেল বিছানতে, ঝুঁকে কাজলটা তুলতে গিয়ে, চারবছর আগের সেই কলঙ্কিত বিকেলটার মত
দুটো সত্ত্বা মিলিত হল গভীর চুম্বনে, তফাৎ শুধু একটাই, এবারে আর পরদার ফাক দিয়ে
রাই সে দৃশ্য দেখে তার কাকিমাকে ডেকে আনেনি...
---------------------------সমাপ্ত----------------------------