STORYMIRROR

Jeet Patitundi

Romance

3.2  

Jeet Patitundi

Romance

বৃষ্টিস্নাত রাত

বৃষ্টিস্নাত রাত

10 mins
986


"ভাই, আজ একটা চাইনিজ পেগ বানা, অনেকদিন খাইনা।", রাজদীপ নিজের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল জয়কে। জয় ততক্ষনে পাঁচ নম্বর পেগটা শেষ করে রাজেশ খান্নার "জিন্দেগী কে সাফার মে গুজার যাতে হে" গানটা ইউটিউব থেকে চালানোর চেষ্টা করছিল, এর মধ্যে এইসব আবদার। অনিচ্ছা সত্বেও ঠিক আধ গ্লাস জল ভরে নিখুঁত হাতে কাজ শুরু করল। ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো দাম দেওয়ার সময় বা অবস্থা কিছুই নেই এখন, তারওপর আজ রাজদীপের ব্যাচেলর পার্টি, ওর কথাই শিরোধার্য। হিমালয়ের পাদদেশের গভীর অরণ্যের মাঝে এক দু কামরার কাঠের ট্রি-হাউসের মধ্যে জমে উঠেছে আজকের আড্ডা। 


বিহান তার মামা কে দিয়ে স্পেশাল পারমিশন করিয়ে এই বাংলোটা বুক করিয়েছে, শুধু মাত্র আজ রাত্রের কথা ভেবে। বিহান আর জয়ের বরাবরি জঙ্গল ব্যাপারটা একটু বেশি পছন্দের। দুজনেরই মনে হয়, এই জঙ্গলের ভেতর যেই স্থায়িত্ব আছে, ওই বিশালত্যর মাঝে নিজেদের অন্য ভাবে খুঁজে পায় তারা। তাই যখন রাজদীপ এই রাত্রের দায়িত্ব দিলো তাদের ওপর, বেশি ভাবতে হয়নি জায়গা নিয়ে। রাজদীপ এক বিলাসবহুল সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মচারী হওয়ার সুবাদে তার কাজ ছিল শুধু মাত্র টাকা দেওয়া, বাকি সব দায়িত্ব জয় আর বিহানের। 

জয়, বিহান আর রাজদীপ একদম ছোটবেলার বন্ধু। এই তিন ইয়ারী কথা সেই যে শুরু হয়েছিল একাদশ শ্রেণীতে, এখনো একই ভাবে বর্তমান। রাজদীপ তার কলেজের দুজন বান্ধবীকেও ডেকেছে আজ। জয়রা এদের দুজনকে চেনে না এমন নয়, তবে ওই আরকি খুব কম-ই মিশেছে। এই ঘুরতে এসেই যা কথাবার্তা হওয়ার হয়েছে। গতকাল সাইটসিং এর সময় অবশ্য অনেক্ষন কথা হয় রিয়ার সাথে জয়ের। আপাত দৃষ্টিতে একটু বাচাল মনে হলেও, ভেতরের চাপা কষ্ট গুলো দেখা যায় খেয়াল করলে। ওর সাথেই এসেছে বর্ষা। সত্যি বলতে নামটা একদম সার্থক, এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা আছে ওর মধ্যে, এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা আকৃষ্ট করে তা হলো ওই চোখ দুটো, অতল সাগর যেন লুকিয়ে ওই দুটো চোখের পিছনে।


এই পাঁচজনের আড্ডা আজ, এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে, বেশ ঘেঁষাঘেঁষি করেই বসে তারা। ঠান্ডাটাও এই তল্লাটে বেশ বেশিই। কলকাতায় যখন পাখা চলছে ৩ নম্বরে, সেখানে এই জঙ্গলের মাঝে সবার গায়ে নিদেন পক্ষে একটা জ্যাকেট, তারওপর কেউ কেউ তো শাল জড়িয়ে বসে। ঘরটা খুব একটা ছোট নয়, তবে ওই মদের বোতল, খাবারের প্যাকেট যেভাবে এদিক ওদিক ছেটানো তাতে পরিষ্কার জায়গা খুব অল্পই। বারান্দার দরজাটা খোলা, নাহলে ঘরটা বড্ড গুমোট হয়ে যায়। অবশ্য একসাথে দুটো জয়েন্ট, আর তিনটে সিগারেট সর্বক্ষণ জ্বললে, এক হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটও গুমোট হতে বাধ্য। বারান্দার দরজা দিয়ে সামনের শালবনের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মায়াবী দেখতে দেখতে বিহান কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলো। রাজদীপ ফোনে প্রিয়ার সাথে কথা বলে যাচ্ছে একনাগারে। প্রিয়া তার কলেজ জীবনের প্রথম প্রেম। এই দুদিন হলো আবার কথা জমে উঠেছে দুজনের মধ্যে। 


রিয়া অনেক্ষন ধরে ফেসবুক ঘাটতে ঘাটতে একসময় বিরক্ত হয়ে বলেই বসলো, "....এটা একটা ব্যাচেলার পার্টি? কিসব বোরিং লোকজন। "

রাজদীপ কথাটা শুনেও শুনলো না। বিহানের ঘোরটা খানিকটা বোধহয় কাটলো, বেশ নড়ে চড়ে শালটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বলল, "ব্যাচেলর পার্টি মানে কি শুধুই মাতাল নৃত্য? না উত্তাল মোচ্ছব? শান্তির মধ্যেই লুকোনো যে অরাজকতা, যেই সুপ্ত ছত্রভঙ্গের আভাস আছে, সেটাই উপভোগ করলে হয় না?" কিছুক্ষন সবাই চুপ করে গেল কথাটা শুনে, জয় পেগটা বানিয়ে রাজদীপের সামনে রেখে সেই নিস্তব্ধতা ভাঙলো। বললো, "বিহান, ওদের দোষ নেই, আমাদের সিউডো আতলামিতে এরা অভ্যস্ত নয়।"

রাজদীপ ফোন রেখে এবার বলে উঠলো, "তাও ঠিক, একটু কেমন মনমরা হয়ে গেছে পার্টিটা। আচ্ছা রিয়া তুই বল, কি করা উচিত।" রিয়া এতক্ষন যেন এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। বলল, " আরে একটু গান বাজুক, নাচ ফাচ করি, নাহলে ঠিক পার্টি পার্টি মনে হয় না।" বর্ষা এতক্ষন আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল, রিয়ার কোথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলল, "এই ভাই, গলা অবধি মদ খেয়ে নাচতে পারছি না, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবো কিনা সেটাই ভাবতে হবে, আর ইনি করবেন নাচ।"

রিয়া যেন কিছুটা দমে গেল কথাটা শুনে, বলল, "তাহলে? এরম চুপচাপ বসে থাকবো?"

কারুর কাছে কোনো উত্তর নেই দেখে, জয় বলল, "যারা নাচতে চায় নাচুক না, দর্শক হয়ে থাকি না আমরা। বেশ এন্টারটেনমেন্টও হয়ে যাবে।" বিহান এতে পূর্ণ সহমত প্রকাশ করলো, তাই অগত্যা বর্ষার কথা না মেনে, বেতার স্পিকারে বেজে উঠল, চটুল পাঞ্জাবি গান। এই গানগুলোর এক অদ্ভুত ব্যাপার আছে, যতই কথা না বোঝা যাক, বা খুবই শোনা কোনো সুর হোক, কানের কাছে চললে নিজের অজান্তেই কেমন দুলে ওঠে শরীরটা। গান বাজতেই রিয়া আর রাজদীপ উঠে গানের তালে গা ভাসিয়ে দিল, বিহান বসে থাকার চেষ্টা করলেও রিয়া ছাড়বার পাত্রী নয়, সেই হাত ধরে তাকে টেনে তুলল।


জয় সবার এক পেগ করে মদ বানিয়ে সিগারেটের প্যাকেট পকেটে ভরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সামনের শালবনের মাথায় যে চাঁদের আলো এতক্ষণ খেলা করছিল, তা এখন আর নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝলো, মেঘে ঢেকে গেছে গোটা আকাশটা। আর তারসাথে একটা হিমশীতল হাওয়া বয়ে চলেছে। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো। আনমনে গুন গুন করে "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই" গাইতে শুরু করল। ভেতরে তখন পাঞ্জাব ছেড়ে গান নব্বই দশকের ডিস্কো ডান্সারে এসে পড়েছে। শুনেই বঝল এ রাজদীপের পছন্দ। নেশা করলেই ছেলে রেট্রো ফ্যান হয়ে যায়, অবশ্য এই গানগুলো ভালো না লাগারও কোনো কারণই নেই, সেই সুর আর কথার বাঁধন এখনকার খুব কম গানেই পাওয়া যায়। ভিতর থেকে সবচেয়ে বেশি আসছে রিয়ার আওয়াজ, খিল খিল করে বাচ্ছাদের মতো হাসে সে, একবার ভেতরে উকি দিয়ে দেখল, বিহান আর রিয়া বল ড্যান্স করছে। উফফ, এই দৃশ্য ভোলার নয়, দুই মাতাল যাদের মাথার সাথে পায়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই, তারা বল ড্যান্স করছে। রাজদীপ দূরে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছে, আর বর্ষা তার পেগটা নিয়ে একবার করে নাড়ছে, আবার রেখে দিচ্ছে।


রিয়া মেয়েটা বড্ড প্রানোচ্ছল, ওর এই চনমনে স্বভাবটাই যেকোনো জায়গার প্রাণ হয়ে ওঠে। কিন্তু তার ভেতরটা কেউ কখনো দেখে না। কত গুলো চেপে রাখা কষ্ট, লাঞ্ছনা কে মনের এক বদ্ধ কুঠুরিতে বেঁধে রেখে ঠোঁটের কোনে যে অমলিন হাসি নিয়ে আসে তার খোঁজ একমাত্র সে নিজেই জানে। কোন কোন একলা রাত্রে সেই কুঠুরির দরজা ভেঙে সেই অনুভূতি, সেই কষ্ট গুলো গলায় দলা পাকিয়ে ওঠে, রাত কেটে যায়, চোখের কোনায় জমে ওঠে জল, কিন্তু রাত শেষে তাদের আবার নিজের ভেতর আটকে রেখে নতুন সকাল শুরু করে সে। নিজের জীবনে যেই ছবিটা তার স্বপ্নে ভেসে বেড়ায়, বাইরের পৃথিবীর সামনে যেই ছবিটা সে আঁকে।


বিহান জীবনটা কিছুতেই যেন গুছিয়ে উঠতে পারছে না, চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি সে, পড়াশোনায় খুব একটা ভালো না হলেও, খারাপ কখনই ছিল না। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে কলকাতার এক নামি কলেজ থেকেই, চাকরিও পেয়েছিল ভালোই। সব ছেড়ে ছুড়ে এমবিএ ও পড়ল। তাতে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল হলেও, মনের ভেতরের ঝড়টা আজও একই ভাবে বিরাজমান। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না, শত চেষ্টা করেও এই ভেতরের সাগরটা শান্ত হয়নি। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে অবশ্য যে কেউ বলবে যে এই কষ্ট গুলোর কোনো মানে হয়না। কিন্তু সব কষ্টের কি আর কারণ হয়? কিছু কিছু

কষ্ট একান্ত নিজের, তার কোনো কারণ নেই, তাই সঠিক কোনো উপায় নেই তার প্রশমনের। আসলে যেই জীবনের শুরুতেই অনেক গুলো বাঁধা এসে জমা হয়, সেই জীবনটা বোধহয় অসম্পূর্ণই থেকে যায়। একটা জিগস পাজলের সব কটা ভাগ থাকলেও কিছুতেই তা যেন শেষ হচ্ছে না। বাক্সের গায়ের ছবিটা কিছুতেই যেন ফুটিয়ে তোলা যাচ্ছে না। হয়ত এই ধাঁধার অবসান ঘটলে জীবনেরই পরিসমাপ্তি, তাই এই উত্তর খোজার মাঝেই বেঁচে আছে বিহানের মতো হাজারো মানুষ। 


রাজদীপ বরাবরই স্বচ্ছল অবস্থার মধ্যেই থেকেছে, কিন্তু কোনোকালেই সেই সচ্ছলতা তার মনকে কলুষিত করেনি। রাজদীপ জয় বা বিহানের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। তার মধ্যে এক অদ্ভুত ইচ্ছাশক্তি আছে, আর তার সাথে আছে এক অদম্য জেদ আর সাহস। খুব বাস্তববাদী একটি ছেলে সে, জীবনের সাদা আর কালোর মাঝে যে খয়েরি জায়গাটা আছে, সেটা তার কাছে পাত্তা পায়না। প্রখর যুক্তিবাদী, এবং অদম্য জেদে মোরা ওর যেই ব্যক্তিত্ব, তার সাফল্যের সবচেয়ে বড়ো কারণ। এক দশক ধরে প্রেম করার পর পরের মাসে বিয়ে করছে সে। আজ রাতটা তার কাছে খুব বিশেষ ভাবে আপন। এই রোজকার অফিস আর বাড়ির জাতাকলের মাঝে এই তিন ইয়ারী কথাটাই হারিয়ে যেতে বসেছিল। আজ রাত্রে আবার পুরোনো দিন গুলো মনে পরে যাচ্ছিল তার। যতটা সম্ভব ক্যামেরা বন্ধি করে রাখছিল মুহূর্তগুলো। রোজকার একঘেয়েমির মাঝে এগুলোই বেঁচে থাকার রসদ।


হাতে সিগারেটের গরমটা লাগতে জয়ের ভাবনায় খেদ পড়ল। ঘরে এসে দেখে তার জায়গাটায় এখন রাজদীপ তার বিশাল বপু নিয়ে পরে পরে নাগিন ড্যান্স করছে। অগত্যা বর্ষার পাশে এসে বসল সে। দূর থেকে টিচার্সের বোতলটা টেনে নিয়ে নিজের পেগ বানাতে গিয়ে দেখল, বর্ষা এখনো আগের পেগটাই শেষ করেনি। হাতে নিয়ে আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে। সামনের ওই উত্তাল নৃত্যের মাঝে পাথরের মতো বসে। জয় একবার ভাবল ডাকবে তাকে, তারপর ভাবল না থাক। তার মতে কখনো কখনো কিছু অনুভূতি অন্তরে অনুভব করাটাই শ্রেয়, বাহ্যিক অভিব্যক্তির চেয়ে অন্তরের সাগরের ঢেউ মাপাই অনেক স্বস্তির। একটা খালি প্যাকেটে দুটো সিগারেট ভরে বর্ষার সামনে রেখে জয় আবার গিয়ে দাঁড়ালো বারান্দায়। চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু ভেতরের স্পিকার থেকে ভেসে আসছে আইটেম গানের বোল, আর বাইরে একনাগারে ঝিঝি পোকার ডাক মিলে মিশে এক অন্যেরকম আমেজ তৈরি করেছিল। জয় এবার তার পেগটা নিয়েই বারান্দায় এসেছে, পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট খুঁজতে গিয়ে বুঝল সেটা ভেতরেই ফেলে এসেছে। এমন সময় পাশ থেকে কেউ বলে উঠল, "এই নে, ধরা।" চমকে ঘুরে দেখে বর্ষা দাঁড়িয়ে হাতে লাইটার আর সিগারেট নিয়ে। কখন এসে জয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই হয়নি। হাত থেকে সিগারেট নিয়ে, ধরিয়ে জয় বলল,

-ধ্যান ভঙ্গ হলো তাহলে।

-হুম...ওই আরকি। তুই এই ঠান্ডায় বাইরে কি করছিস? 

-কিছুই না, জঙ্গলটা উপভোগ করছি। 

-কেন জঙ্গলের মধ্যে কি আছে?

-বিশালত্য, দম্ভ, স্থাপত্য রক্ষা করার ক্ষমতা, আর অতল গভীরতা...

-এর চেয়ে মানুষের মন আরো বেশি গভীর। এর তবু শেষ আছে, কিন্তু মানব মনের তো তাও নেই।

-একদম ঠিক, ওই জন্যেই তো জঙ্গল আমার এত ভালো লাগে। মানুষের মন বুঝতে অক্ষম হয়ে এখানেই আশ্রয় নিয়ে একটু স্বাস নিতে পারি।

-জঙ্গল এর বাইরে থেকে যতটা ভয়াবহ, কিন্তু একদম মাঝে কিন্তু শান্ত এক ভরসা বিরাজমান। এক অমোঘ আশ্রয়স্থল। আপন করে নেয়ার টান....

-যেই টান মানুষের মনের মধ্যেও আছে, তবে তা কলুষিত করে আমাদের ছয়টি রিপু। আর সবচেয়ে ভয়াবহ হল, তার মধ্যে লালসা এবং মাৎসর্য, সব নষ্টের এরাই তো মূল।

-এই লোভের ফাঁদে পরেই তো কত জীবন নষ্ট হয়ে গেল। কত সম্পর্কের অবসান এই কারণে। ভালো, আরো ভালো চাই। একই জামা বেশিদিন পড়লে যেমন পুরোনো হয়ে যায়, তেমন ভাবেই সম্পর্কগুলো পুরোনো হয়ে যায় বোধহয়। তখনই বাসা বাধে লোভ। 

-আর এই লোভের ফাঁদে পা দিয়েই উজাড় হয় কত সংসার। যে উজাড় করল সে হয়তো বেঁচে গেল, তবে যার উজাড় হলো, তার মনের গহ্বরে জমা হলো এক গভীর ক্ষত। যেই ক্ষত শতচেষ্টার পরেও অমলিন হয়ে থাকে। তার যে কোনো মলম হয়না, বিশ্বাসের ভীত তা যখন নড়ে যায় তখন বোধহয় মানুষ নিজের ওপরেও আশা ছেড়ে দেয়। মনের ভেতর সব কষ্ট চেপে কলের পুতুল হয়ে যায়, কারণ তাতে লাভ বেশি। অনুভূতি গুলো যে বড্ড কষ্ট দায়ক।

খানিকটা থামল দুজনেই, তার পরে বর্ষা বলল, "তুই খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারিস তো, অনেক না বলা অনঅবিভক্ত কথা তোর কথার মাঝে প্রকাশ পায়।"

-ওই একটা জিনিসের ওপরই তো বেঁচে আছি রে। আসলে কি জানিস, সত্যি কথাগুলো বড্ড নগ্ন, আর এমনও কিছু কথা বা মুহূর্ত থাকে যা শুধু অনুভবই করা যায়, ব্যক্ত করা যায়না। আমি যতটা পারি সেটাই ব্যক্ত করার চেষ্টা করি। 

জয় বেশ বুঝতে পারছিল বর্ষার মধ্যে এক অদ্ভুত ঝড় চলছে, ফেটে বেরোতে চাইছে, তবে কোনোরকমে তা আটকে রেখেছে সে। মেয়েটা যতই চেষ্টা করুক ঢাকতে, তবুও ওর চোখ দুটো সব কথা ব্যক্ত করে, ওই চোখের পিছনে যেই অতল সমুদ্র তাতে আজ সুনামির ঢেউ উঠেছে। যার ছিটে কোনায় এসে জমা হয়েছে, অন্ধ্যকারেও তা জয়ের চোখ এড়াতে পারেনি। আসলে এটাই বোধহয় জয়ের সবচেয়ে বড় দোষ, অনেক কিছু বুঝতে পারে, একটু কম বুঝলে বোধহয় ভালো হতো, বেশি অনুভূতির মাঝে আসল জিনিটাই হয়ত হারিয়ে যায়।


বর্ষা এই ট্রিপে আস্তে চায়নি প্রথমে, কিন্তু রিয়ার জোরাজুরিতে শেষ অবধি রাজি হয়েছিল। সব জায়গায়, বা সব মানুষের সাথে সে সহজ হতে পারে না, এই জন্যে তার বেশি বন্ধুও নেই। খুব বাছা কয়েকজনই তার জীবনে আছে। সে নিজে খুব একা একটি মানুষ, অবশ্য এটার সে নিজেই বেছে নিয়েছে, কারণ তার অনুভূতিগুলো বোঝার মত মানুষ নেই। ছোট ছোট জিনিস তার মনে আঘাত করে, রাস্তার ধারে কুকুরের লেজ ধরে টানলেও তার মনের মধ্যে কষ্ট হয়। কিন্তু এই অনুভূতিগুলো বাস্তব সমাজে খুব খেলো, খুব নগন্য। আসলে কি বাস্তবের পাথুরে সমাজটা আর তার মনের মধ্যর অশেষ পার্থক্য। নিষ্পাপ মন এখনো কলুষিত হয়নি, তবে এই নির্জীব সমাজে বাঁচতে হলে বাইরে এক পুরু আস্তরণ তো করে নিতেই হয়। নারকেলের মত, বাইরের শক্ত খোল দেখে কেউ বুঝতে পারে না যে ভেতরটা এতটা নরম। মাঝে মাঝে এই আস্তরণ ভেঙে আসার উপক্রম হয়, কিন্তু খুব পটু হাতে তা আটকে রেখে আসছে সে এতগুলো বছর। আজ এই ঘুরতে এসে যেইটুকু সময় সে বর্ষাকে দেখেছে, তাতে ওর মনের গভীরতার প্রেমে পরে গেছে। অনেক বছর পর নিজের মত একজনকে সে খুঁজে পেয়েছে। বর্ষা আবার বলল, 

"সব অনুভূতির কি মানে হয়?"

-না। একদমই না। কিছু কিছু আবেগের কোনো কারণ নেই, কিন্তু নিজের কাছে তার অদ্ভূত পশ্রয়। বাইরের মানুষের কাছে যা অর্থহীন, তাই নিজের কাছে অমূল্য। 

জয়ের খুব ইচ্ছে করছিল, একবারটি বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে বলে, সে আছে। বর্ষা একা নয়, জয়ও তো এরকমই, এবং তাই হয়ত একটু বেশি করে তার মনের অভিব্যক্তিগুলো সে বুঝতে পারে। তার ভেতরের সাগরের ঢেউগুলো শান্ত করতে তাকে বাঁধ ভাঙতে দিতে হবে, এবং সেই জলের তোর সামলানোর মতো ক্ষমতা জয়ের আছে। 

হঠাৎ কয়েক ফোটা জল পরল জয়ের কাঁধে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝল এবার মেঘের বাঁধ ভেঙে বর্ষা নামবে। ঘরের থেকে আসা ক্ষিণ আলোয় আরেক বাঁধ ভাঙার আভাস এল, চোখের কোনটা যেন অল্প একটু টলে উঠল। আর ঘর থেকে ভেসে এলো সেই বিশ্ববিখ্যাত গান, "কাহি দূর যাব দিন ঢাল যায়ে...."


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance