ঋতুমতী
ঋতুমতী


স্কুল থেকে ফেরার পর রমিতা বেশ কয়েকবার মিঠিকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে সব খাতা তো বেরোলো, অঙ্ক খাতা বেরোবে না।
মিঠি - কিজানি? মিস কিছু বলেনি।
রমিতা - সত্যি কথা বলছিস তো? সব খাতাই তো এক এক করে দেখিয়ে দিলো, শুধু অঙ্কটাই বাকি। এই সপ্তাহটা দেখি, পরের সপ্তাহে একবার মিস কে জিজ্ঞেস করে নেবো।
মিঠি - না মা তোমার জিজ্ঞেস করতে হবেনা মিস কে, এমনিই দিয়ে দেবে।
তারপর বেশ কিছুদিন পর চিলেকোঠার ঘরে মিঠির খেলার রান্না বাটিগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে পুরনো ভাঙ্গা টেবিলটার ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বেড়িয়ে আছে দেখে সেটা খুলে দেখতেই রমিতার হাতে চলে আসে মিঠির অঙ্ক খাতা। আর সেদিন মিঠিকে দু এক ঘা দিয়েই শান্তি হয়নি রমিতার, বরং সেদিন বিকেলে খেলতেও যেতে দেয়নি ক্লাস ফোরে পড়া মিঠিকে, রমিতা বেশ কড়া গলায় বলে উঠলো, আজকে তোর বাবা আসুক, সব বলবো। তারপর দেখিস তোকে কি করে।
এতক্ষণ এত মারধোর হলেও মিঠির ভয় করেনি অত, কিন্তু বাবার কথা শুনলেই কেমন যেন ভয় লাগে। বাবা কোনোদিন মারেনি, কিন্তু কোন অন্যায় করলে, বাবার চোখের দিকে তাকালেই মিঠির বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। মিঠি ঠিকমত খেয়ে নেয়, যাতে মায়ের রাগটা একটু কমে, কথাটা যাতে বাবার কান অবদি না পৌঁছায়।কিন্তু তাতে রমিতার মন গলেনা একেবারেই।
অফিস থেকে রঞ্জিত ফিরতেই রমিতা আগেই বলে ফেলে মিঠির কথা, তখন রমিতার গলায় ঝাঁঝ বেশ স্পষ্ট।তারপর রঞ্জিত চুপ করে আছে দেখে রমিতা বেশ চেঁচিয়ে বলে, কিগো তুমি কিচ্ছু বলবেনা মেয়েকে?
রঞ্জিত - হমম বলবো। মিঠি এসো এখানে।
মিঠি যথা সম্ভব ধীর পায়ে বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়, ঠিক কি ঘটতে চলেছে বুঝে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে।
রঞ্জিত মিঠিকে অবাক করে দিয়ে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত রেখে বলে, কাজটা কি তুমি ঠিক করেছো মিঠি?
মিঠি চুপ করেই থাকে। উত্তর দেওয়ার মত সাহস সঞ্চয় করে ওঠা হয়না। রঞ্জিত আবার জিজ্ঞেস করে, কি হলো মিঠি। উত্তর দাও তুমি কি কাজটা ঠিক করেছো?
মিঠি - না।
রঞ্জিত - জেনেশুনে কেন একটা ভুল কাজ করলে তাহলে। অঙ্কে নম্বর কম হয়েছে তো কি হয়েছে, হয়তো মা একটু বকবে, তার জন্য কেউ এমন কাজ করে?
সবাই কি অঙ্কে ভালো হয়?তুমি অঙ্কে একটু কাঁচা, প্র্যাক্টিস করলেই ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি ঠিক নাও হয় কম নম্বর পেলে নিজেকে লুকিয়ে রাখলেই কি সব ঠিক হয়ে যায়। যাও এখন গিয়ে পড়তে বসো, আর এমন করোনা কখনো।
মিঠি ঘরের দিকে চলে যায়, কিন্তু তখনো বেশ চুপ। মিঠি ঘরে গিয়ে ঢুকতেই রমিতা রে রে করে ওঠে, একটুও বকলে না তুমি মেয়েটাকে, এত বড় একটা অন্যায় করার পরও গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কথা বললে?
রঞ্জিত - একটু শান্ত হও রমিতা, মিঠি কাজটা করেছে ভয় থেকেই। আমরা যদি খুব বেশি বকাবকি করি ও ভয় পেয়ে এই কাজটা আবার করবে। ওর ভয়টা ভেঙে দিতে হবে। জীবনে হার জিত তো থাকবেই, কিন্তু জেতার খুশিটা যেমন আমরা ওর সাথে ভাগ করে নিতে পারি, হারার কষ্টটাও যেন কোনো ভয় ছাড়াই আমাদের কাছে ও বলতে পারে, তাহলেই দেখবে আর কোনোদিন ওকে আড়াল করতে হবেনা কিছু।
আর জীবনের অঙ্ক অনেক জটিল রমিতা, তার আগেই এই অঙ্ক বিষয়টা ওর কাছে এত জটিল না করে তোলাই ভালো।
মিঠি সেদিন আড়াল থেকে সবটা শুনে বাবার প্রতি অজান্তেই একটা ভরসা তৈরি হয়েছিল, মাকে কিছু বলতে অসুবিধা হলেও বাবাকে ঠিক বলে ফেলতো মিঠি।
এর বেশ কিছুদিন পরেই মিঠি টিভিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন দেখে বাবাকে প্রশ্ন করে ফেলেছিল, বাবা এটা কি গো?
রঞ্জিত - বড় হও বলবো তোমায়।
মিঠি - বলনা বাবা এটা কি?
রঞ্জিত - বলবো মিঠি। সময় হলেই বলবো।
তারপর যখন মিঠির জীবনে ঋতু পরিবর্তনের সময় এলো,তখন মিঠির ক্লাস এইট। সেইদিনটা ছিল সরস্বতী পুজো।
বন্ধুদের কাছে এই ব্যাপারটা একটু আধটু শুনে থাকলেও সেদিনও কিন্তু মিঠি বাবার কাছেই গিয়ে কেঁদে পড়েছিল অনেক রক্ত পড়ছে বাবা।কি করবো? রঞ্জিত রমিতাকে ডেকে মিঠিকে ন্যাপকিনের ব্যবহারটা শিখিয়ে দিতে বলেছিল ঠিকই, কিন্তু নিজেই মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, মিঠি আজ কিন্তু তুমি নারী হলে। সব মেয়েদেরই এমন হয়, এটা শুধু তোমার সাথেই হল এমনটা নয়।
জানতো, মা কামাখ্যা যখন ঋতুমতী হন, সেই সময়টাকে আমরা অম্বুবাচী বলি, সেটা ভক্তদের কাছে একরকম উৎসব। কারন, ঋতুমতী হলেই নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার উপযুক্ত হয়। অনেকেই বলে, এসময় পুজো করতে নেই, তবে কি জানো ঠাকুর ঋতুমতী হলে এত বড় উৎসব হয়, কারন, এই নিয়মের ওপরই যে জগৎ সংসার চলছে, সেই সত্য আমরা মানুষ হয়ে অস্বীকার করে আড়াল করে রাখি। কোন শাস্ত্র, বেদ, উপনিষদ এইসময় পুজো, মন্দির থেকে দূরে থাকার ব্যাখ্যা দিতে পারেনা, কিন্তু আমরা কুসংস্কার বয়ে নিয়ে চলি যুগ থেকে যুগান্তরে।
মিঠি - বাবা, আমি সরস্বতী পুজো করতে পারবো তো?
রমিতা - নিশ্চয়ই পারবে মিঠি। মন পবিত্র থাকলে সব করা যায়।
এবার চলো পুজোর সময় হয়ে আসছে।
মিঠি - মা, আমায় শাড়ি পরিয়ে দেবেনা?
রমিতা - নিশ্চয়ই দেবো মিঠি।
ধুপ ধুনোর গন্ধের সাথে মিঠিদের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে মিঠির কণ্ঠস্বর,
ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে,
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,
ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।
সরস্বতী প্রতিমার সামনে বসা হলুদ শাড়ি পড়া মিঠি মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতেই ভাবছে, স্কুলে গিয়ে বন্ধুদেরও বলতে হবে আজকের গল্পটা।