নিজের বাড়ি
নিজের বাড়ি
কালকেই সবে রিয়ার বিয়ে হয়েছে। নিখিল আর কাকলির একমাত্র মেয়ে রিয়া।এখন বিদায়বেলায় সবার আশীর্বাদের জন্য বসে থাকতে থাকতে কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে রিয়ার। আজকে ওর চলে যাওয়ার সময় বাবা আর মা দুজনেই ওর সামনে বসে আছে, দুজনেরই চোখে জল আটকে আছে। এমনই হয় বোধহয়, মানুষ যখন চলে যায় অনেক দূরে তখনই সবাই একসাথে হয়। নইলে কতবার রিয়া এই বড় হয়েও বাবা মাকে বুঝিয়েছে, ডিভোর্স তোমাদের হয়েছে, আমার নয়। আমার কাছে তোমরা দুজনেই খুব কাছের, তোমাদের দুজনকেই ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয় আমার। আমি তো বাবা মা দুজনকেই চাই।
কাউকেই মনের কথাগুলো বুঝিয়ে উঠতে পারেনি রিয়া।এখন হয়তো বয়স ওদের কাছাকাছি এনেছে ঠিকই কিন্তু এখন তো রিয়ার বাবা মাকে ছেড়ে সংসার জীবনে পারি দেওয়ার পালা।
মাঝে মাঝে কলেজের বন্ধুদের গল্প শুনে কান্না এসে যেত রিয়ার, ওরা কি সুন্দর বাবা মা দুজনের সাথেই থাকতে পারে, আর আমারই এরকম কেন?
রিয়া বেশ ছোট থেকেই দেখে এসছে বাবা আর মা দিনরাত ঝগড়া করে যাচ্ছে, কিন্তু ওই ঝগড়ার মাঝেও ওরা একসাথে ছিলো। কিন্তু যখন চিৎকার চেঁচামেচি কমতে থাকলো তখন আস্তে আস্তে বাড়িটা যেন কেমন চুপ মেরে গেলো, হঠাৎ একদিন বাবার সামনে দিয়েই মা রিয়াকে নিয়ে চলে এলো একটা ভাড়া বাড়িতে। আর তারপর থেকে রিয়া আর ওর মা একাই থাকতো।
মায়ের চাকরি, সারাদিন কাজের ব্যস্ততা আরো একা হতে থাকলো রিয়া।
তখন রিয়া ক্লাস সিক্স।কোর্টের অর্ডারে সপ্তাহে একটা দিন রিয়াকে ওর বাবা আনতে আসতো, সেটা বাকি দিনগুলোতে স্কুল থাকে বলেই রবিবারই বাবা ওকে নিয়ে যেতো। আবার সারাদিন কাটিয়ে কোনোদিন বাবা দিয়ে আসতো, আবার কোনোদিন মা এসে নিয়ে যেত ওকে। রিয়ার মনে পড়ছে, রিয়ার শুধু মনে হতো এই জীবনটা এখানেই শেষ হলে ভালো হয়, ও তো চেয়েছিলো দুজনের সাথেই থাকতে এখন যখন বাবা আর মা দুজনেই পাশাপাশি বসে আছে, তখন ওকেই চলে যেতে হচ্ছে। বরের হাত ধরে যে বাড়িতে যাচ্ছে, সেই বাড়িটাও কি কোনোদিন নিজের করে নিতে পারবে?
রিয়ার খুব ইচ্ছা ছিল একটা বাড়িতে সবাই মিলে থাকবে। বেশ কয়েকটা বছর মায়ের বাড়ি আর বাবার বাড়ি এদিক ওদিক করেই কেটে গেলো। এখন একটা নিজের বাড়ি হবে, নিজের অস্তিত্ব হবে ভাবতেই ইচ্ছে করেনা, সবসময় তো বাবা মায়ের হাতের পুতুল ছিলো ও।এই বয়সে এসে যদিও রিয়া বেশ বুঝতে পারে, বাবা মায়ের কোন দোষ নেই। দুটো ভালো মানুষও যে সারাজীবন একসাথে থাকলেই ভালো থাকতে পারবে, তাদের চিন্তাধারা সবটা একরকম হবে সেটা নাও হতে পারে। কিন্তু, কোথাও যেন বাবা মা দুজনকেই একসাথে কাছে না পাওয়াটা একলাফে বড় করে দিয়েছে রিয়াকে। রিয়া নিজেকে গুটিয়ে নিতে শিখেছে, নিজের অনুভূতিগুলো
বাইরে আসতে না দিয়ে ভেতরেই পুষে রাখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই রিয়ার মনে পড়ে যায় সেই দিনটা,
নিখিল - কি হলো রিয়া এখনও খাওনি?
রিয়া - আমার খেতে ভালো লাগছে না। আমি খাবো না।
নিখিল - কি হচ্ছে রিয়া? আমি তো বললাম তোমায় এই সপ্তাহে একদিন তোমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে আমি মুভিটা দেখাতে নিয়ে যাবো।
রিয়া - তুমি এরকম বলো। আর নিয়ে যাওনা। আমাকে আজকেই নিয়ে যেতে হবে।বাবা প্লিজ আজকের দিনটা আমি এখানে থাকি? একটা দিন থাকলে কি হবে?
নিখিল - না রিয়া। আমি বললাম তো তোমার মায়ের পারমিশন নিয়ে রাখবো আমি।এই সপ্তাহেই যাবো আমরা প্রমিস।
রিয়া - বাবা, মাম্মা বলে তুমি নাকি কোনো প্রমিস রাখোনা। এই প্রমিসটা রাখবে তো?
নিখিল - একদম তোমার মাম্মার মত বেশি জেদ হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নাও।
সেদিন নিখিল রিয়াকে বাড়ি দিয়ে আসতেই, রিয়া বাড়িতে ঢুকেই কাকলিকে বলেছিল, মা বাবার সাথে এই সপ্তাহে একদিন মুভি দেখতে যাবো।একটা দারুন থ্রিডী মুভি এসছে জানো?
কাকলি - রিয়া, তোমার বাবাকে বলে দিও কোর্টের অর্ডার অনুযায়ী সপ্তাহে একদিনই তোমার সাথে দেখা করতে পারবে। আর তুমি ওই বাড়ি থেকে আসলেই একটা করে নতুন বায়না ধরো। এটা কি তোমার বাবা তোমায় শিখিয়ে দেয়।
রিয়া আর কিছু না বলে চলে যায় ঘরে, আজকাল বড্ড দমবন্ধ লাগে দুটো মানুষের যত ক্ষোভ যেন এখন ওর ওপরই এসে পড়েছে।
ছোট মাসীর ডাকে সম্বিত ফেরে রিয়ার,
কিরে রিয়া কি অত ভাবছিস। বরকে নিয়ে সুখে ঘর সংসার করিস মা, আর আজ থেকে মনে রাখিস মা, শশুরবাড়িই তোর ঘর, যাই হোক, মানিয়ে চলার চেষ্টা করিস।
ছোট মাসীকে আর কথা বাড়াতে না দিয়েই নিখিল রিয়ার হাতটা ধরে, আর ওর হাতে দুটো চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলে, এখনও তোর মা আর আমার বাড়িটা তোরই আছে রিয়া, তোর যখন খুশি আসবি। আর ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছ তুমি, আর নয়। এবার যতটুকু মানিয়ে নেওয়া যায়, ঠিক ততটুকুই মানিয়ে নিও, তার বেশি নয়।
চাবি দুটো হাতের মুঠোয় ধরে বাবাকে জড়িয়ে ধরে রিয়া। রিয়ার তখন একটাই কথা মনে হচ্ছে, মেয়েদের বিয়েতে এর থেকে বড় উপহার বোধকরি আর কিছু হয়না। জন্ম থেকে যে বাড়িতে বড় হওয়া সেটাও একদিন ছেড়ে চলে যেতে হয়, আর রিয়ার তো এতগুলো বছর বাবার বাড়ি আর মায়ের বাড়ি করতে করতেই কেটে গেছে, এই প্রথম যেন জীবনে একটু স্বস্তি পেলো। রিয়া একবুক শান্তির নিশ্বাস মেখে বরের হাত ধরে এক নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে শশুরবাড়ির পথে পা বাড়ায়, আঁচলে তখন বাঁধা নিজের বাড়ির চাবি।