Mahuya Paul

Inspirational Children

4.3  

Mahuya Paul

Inspirational Children

রশিদ চাচা

রশিদ চাচা

1 min
332


"কোথায় যাচ্ছ? " পিছনে তাকিয়ে অর্ণব দেখলো অতি ক্ষীর্ণকায় বয়স্ক একজন টাঙাওয়ালা  গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবারো বয়স্ক লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করলো ,"কি বাবু বাড়ি যাবে তো? চলো আমি পৌঁছে দিচ্ছি। "


এতো রাতে স্টেশন থেকে বেরিয়ে অর্ণবের ও  চিন্তা হচ্ছিলো কি করে ২কিমি রাস্তা হেঁটে বাড়ি যাবে।একে তো বর্ষাকাল ,ঘুটঘুটে অন্ধকার ,তারপর বৃষ্টি হয়েই চলেছে ,ট্রেন  টা এতো লেট করবে ভাবতে পারে নি সে। 

যাই হোক,এমতবস্থায় একটা টাঙাওয়ালা কে দেখতে পেয়ে সে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করলো।তার দিকে এগিয়ে গিয়ে অর্ণব বললো হ্যাঁ  চাচা চলো ,যাবো। 


বাড়ির জায়গাটার  নাম বলতে যেতেই বয়স্ক লোকটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো জানি গো বাবু,মন্দিরতলা যাবে তো? ভানু ব্যানার্জীর ছেলে তুমি,

কতদিন পর শহর থেকে বাড়ি ফিরছো।  তোমার বাবার শরীর টা ভালো নয়।তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে বাবাকে দেখো,সেবা যত্ন করে সুস্থ করে তোলো। 

অর্ণব লোকটির কথা শুনছিলো ,লোকটি একটু থামতেই জিজ্ঞেস করলো ,এতো কথা তুমি কি করে জানলে গো চাচা ? তুমি কি আমায় চেনো ?


বয়স্ক লোকটি বললো ,না চিনলে কি আর  এত কথা কইতে পারতুম ,বাবা ? আমার নাম রশিদ মিয়া। এই এলাকায় জন্ম আমার ,সেই কোন 

ছোটবেলা থেকে টাঙা  টানছি,গ্রামের সব লোকজন ,রাস্তা ঘাট আমার একদম হাতের তালুর মতো চেনা ।  


অর্ণব জিজ্ঞেস করলো,তা  কত বয়স হলো তোমার ? উত্তরে রশিদ মিয়া বললো,আমার আবার বয়স ! কি জানি কত্ত হবে ,৮০ / ৮৫ এর বেশি বই কমতো নয়।

 

রশিদের কথা শেষ হতেই অর্ণব আবার জিজ্ঞেস করলো ,এই বয়সে এতো কষ্ট করে কেন টাঙা নিয়ে বেরোও ? বাড়িতে কে কে আছে গো তোমার? ছেলে পুলে নেই নাকি ?


 উত্তরে রশিদ মিয়া বলে চলে , আমার একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটির  বিয়ে দিয়েছিলাম,শ্বশুরঘর করছিলো। কিন্তু পোড়া কপাল আমার, শ্বশুর বাড়ির দাবি মেটাতে না পারায় মেয়েটাকে আমার পুড়িয়ে মেরে ফেললো ওই শয়তানরা ,থানা পুলিশ করেও কিছু হলো না ;তখন তোমার বাবা আমায় অনেক সাহায্য করেছিলেন এই ব্যাপারে ,কিন্তু কিছুই করতে পারিনি, আজও  শয়তান গুলো মাথা উঁচু করে  ঘুরে বেড়ায় চোখের সামনে ।  ছেলেটাকে অনেক চেষ্টা করেও ঠিক মানুষ করতে পারিনি ;সংসারের অভাব ,বোনের মৃত্যু সব মিলিয়ে সেও আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে নি ,নেশা ভান করে ছেলেটা আমার মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা যায় ,এই ৫ বছর হলো।  বৌ টা এত শোক সহ্য করতে না পেরে পাগল পাগল হয়ে যায় ,তাও সে এতদিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে ছিল ,কিন্তু গত বছর

 ডেঙ্গুতে সেও আমায় ছেড়ে চলে যায় ,তাই বুঝতেই পারছো বাবু ,এই পার্থিব জগতে আমার আর কেউ নেই এখন। 

তোমার বাবা বড় ভালো লোক বাবু ,আমায় বিপদে অনেক সময় টাকা দিয়ে ,লোকবল দিয়ে সাহায্য করেছেন। স্কুল শিক্ষক হয়েও একটু আধটু হোমিওপ্যাথি জানেন বলে শুধু আমি কেন ,গ্রামের অনেক লোককেই উনি বিনা পয়সায় ওষুধ দেন। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও,বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তুমি তো বড় ডাক্তার হয়েছো , বাবার ভালো করে চিকিৎসা করো,

আর যদি পারো এই গ্রামের মানুষ গুলোকেও একটু দেখো , ওরা বড় অসহায় ,বড় গরিব। 


রশিদ মিয়ার কথা হা করে শুনছিলো অর্ণব ,কখন যে বাড়ি এসে গেছে খেয়ালই করে নি। টাঙা থেকে নেমে ১০০ টাকার একটি নোট দিতে গেলে রশিদ মিয়া বলে,তোমার বাবার উপকার আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবোনা ,তোমার কাছ থেকে টাকা নেই কি করে বল। তাছাড়া এমনিতেও আমি রাত বিরাতে  লোকের বিপদে আপদে তাকে যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি,

যদি কাউকে হাসপাতাল বা অন্য কোথাও জরুরি ভাবে নিয়ে যেতে হয় ,আমি চেষ্টা করি তাদের পৌঁছে দিতে ,ওই টাঙা  টানা ছাড়া যে

 আমি আর কিছুই জানি না গো।


 একথা শুনে অর্ণব হেসে বললো ,একদিন বাড়ি এস চাচা ,বাবার সাথে দেখা করে যেও। 

“আসবো বাবু”,এই বলে রশিদ চাচা অন্ধকারের মধ্যে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো।


 অর্ণব কিছুক্ষন সেই দিকেই তাকিয়ে থাকলো ,একটু সম্বিৎ ফিরে পেতেই তাড়াতাড়ি করে ঘরে ঢুকে বাবার কাছে গেলো। বাবার মাথায় হাত বুলাতেই বাবা চোখ খুলে ছেলেকে দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন এতো রাত হলো বাবা ,ট্রেন টা বুঝি খুব লেট ছিল ? কি করে হেঁটে এলি এতটা রাস্তা এই রাতে বৃষ্টির মধ্যে ? ছেলে বললো ,না বাবা কোনো কষ্ট হয়নি আমার ,তোমার পরিচিত এক টাঙাওয়ালা দাঁড়িয়ে ছিল স্টেশন এ ,সেই পৌঁছে দিলো। বাবা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো ,আমার পরিচিত! কে রে বাবা ? নাম কিছু  বলেছে কি? ছেলে বললো ,হ্যাঁ বলেছে তো রশিদ মিয়া।  অর্ণবের বাবা চমকে উঠে বললেন,কি বলছিস তুই এসব ? রশিদ তো গত বছরই মারা গেছে ,ওর আর ওর বৌয়ের তো ডেঙ্গু হয়েছিল ,আমিই ডাক্তার দেখিয়েছিলাম ,কিন্তু বাঁচাতে পারিনি ,

জানিসই তো গ্রামের চিকিৎসা ব্যাবস্থার কি হাল। 

তখন তোর কথা খুব মনে হচ্ছিলো ,কিন্তু কি করবো বল ,তুই তো শহরে নার্সিং হোম এ  খুব ব্যস্ত ছিলি,তাই আর তোকে জানাই নি কিছু। 


ছেলে তো কিছুতেই নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। কিন্তু এটাই যে সত্যি ,তা সে বেশ  বুঝতে পারছিলো। বাবার প্রেসার টা চেক করতে করতে বললো ,জানো তো বাবা ,রশিদ চাচা বোধ হয় কিছু বলার জন্য আমায় বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিলো ,আমি ভাবছি এখানেই থেকে যাবো ,গ্রামের মানুষের চিকিৎসার খুব প্রয়োজন। শহরে আমার মতো ডাক্তার অনেক আছে,ওখানে আমি না থাকলেও চলবে।তোমার বৌমা আর নাতি কেও নিয়ে আসব।  আমার ছেলে  তোমার স্কুলেই পড়বে,আমি যখন তোমার হাতে গ্রামের স্কুলে পড়ে  মানুষ 

হয়েছি ,আমার ছেলেও নিশ্চই হবে। তুমি চিন্তা করো না ,মা নেই তো কি হয়েছে ,তোমার বৌমাই তোমার সংসারের হাল ধরবে। 


ছেলে বৌমার সেবা শুশ্রূষায় কিছু দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলেন ভানু ব্যানার্জী।মাস দুয়েকের  মধ্যেই গ্রামে শুরু হলো ছোট্ট একটি হাসপাতাল তৈরির কাজ ,যেখানে মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে সকলেই চিকিৎসা পাবে ,

প্রয়োজনে শহর থেকে বড় ডাঃ আর উন্নত চিকিৎসা ব্যাবস্থার সব দায়িত্ব নেওয়া হবে বিনা পয়সায়। অর্ণব তার এতদিনের সব সঞ্চয় দিয়ে আর বন্ধু পরিচিত সকলের সহায়তায় হাসপাতাল টি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক মহান স্বপ্ন পূরণে ব্রতী হলো। হাসপাতালের নামকরণ করল  মায়ের  নামে 'স্নেহলতা হাসপাতাল' । 

আজও  শোনা যায় ,রাত বিরাতে  অনেক দূর দূরান্তের রোগী কে কোনো এক টাঙাওয়ালার এই হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার কাহিনী। অর্ণবের কানে যেন আজও বাজে রশিদ চাচার সেই শেষ কথাটা " আসবো বাবু  "। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational