Mahuya Paul

Inspirational

4.1  

Mahuya Paul

Inspirational

জীবনের অর্থ (Prompt 7, 7th day, 07.05.2021)

জীবনের অর্থ (Prompt 7, 7th day, 07.05.2021)

5 mins
344


রণিত সেন তার অফিসের নিয়োজিত নতুন এক কর্মী কে জিজ্ঞেস করছেন " বাড়িতে তোমার কে কে আছে?" কর্মী বললো, "আমার ওয়াইফ আর ৮ বছরের একটি ছেলে আছ। " উত্তর শুনে রণিত সেন বললো "ওহো তাহলে তো তোমার আর কোনো চিন্তা নেই,সবই পেয়ে গেছো,এবার মন দিয়ে কাজ করো,শুধু কাজ আর কাজ,কাজকেই ভালোবাসবে,অন্য কিছু নিয়ে আর ভাববে না। আমায় দেখো ,আমি তো মাঝে মাঝে কাজের জন্য অফিসেই রাতে থেকে যাই । বাড়িতে বলেই দিয়েছি,আমার জীবন কাজের জন্য নিয়োজিত। এটাই তো বয়স উন্নতির,টাকা উপার্জনের। যত তুমি কাজের পিছনে সময় দেবে,ততই তোমার উপার্জন বাড়বে। আমার অফিসে তোমার টাকার কোনো অভাব হবেনা। শুধু সবকিছু ভুলে মন দিয়ে কাজ করে যাও।”


নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী সেদিন বসের (রণিতের) এই কথাগুলো শুনে একটু অবাকই হয়েছিল,কিন্তু প্রত্তুরে কিছু বলার বা জিজ্ঞাসা করার সাহস দেখায় নি। ধীরে ধীরে কয়েকদিনের মধ্যে সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, রণিত সেনের ও একটি ৫ বছরের ছেলে,'বিভু' আর ওয়াইফ 'মল্লিকা'(পেশায় অভিনেত্রী )কে নিয়ে সংসার। স্বামী স্ত্রী দুজনই যার যার মতো কাজের জগতে ব্যস্ত , তাই তাদের সংসারের আর এক মূল্যবান সদস্য হল আয়া 'রিনা'। যার উপর ছেলে এবং সংসারের সব দায়িত্ব দিয়ে তারা নিশ্চিন্ত। সেদিন ওই কর্মী বুঝতে পেরেছিলো যে কেন রণিত সেন তাকে ওই কথাগুলো বলেছিলো; রণিত সেন জীবনে যে কাজ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না ,সংসার ,ছেলে, বৌ বলে তেমন কারো গুরুত্বই নেই তার কাছে। টাকা উপার্জনই তার জীবনের একমাত্র দায়িত্ব, একমাত্র লক্ষ্য ,একমাত্র ইচ্ছা। 


এখানে রণিত সেনের অতীত তা একটু বলে রাখা দরকার। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সরকারী চাকুরীজীবি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল সে। বাবা-মা তাকে কখনো বিলাস বহুল জীবন দিতে না পারলেও ছেলেকে মানুষ করার জন্য সবরকম চেষ্টাই করেছিলেন। এমনকি বিদেশ থেকে ডিগ্রী অর্জনের জন্য শেষ সম্বল নিজেদের দোতলা বাড়িটা প্রমোটর কে দিয়ে টাকা নিয়েছিলেন ,আর থাকার জন্য বেছে নিয়েছিলেন শহর থেকে দূরে একটি ছোট ফ্ল্যাট। রণিত ও লেখাপড়ায় খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিল,তাই বাবা-মায়ের চেষ্টা বিফলে যায় নি। বিদেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে যখন সে নিজের একটি ফার্ম তৈরি করার কথা ভাবে ,তখনি ধীরে ধীরে রণিতের বাবা-মা তার সুপ্ত স্বপ্নের কথাগুলো জানতে পারে। তাতে তারা খুব একটা অখুশি না হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই রণিতের অতি বড়োলোক হওয়ার ইচ্ছা এবং চেষ্টা কে মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই ছেলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শহরের অভিজাত এলাকাতে একটি বাড়ি কিনে বাবা-মা কে নিয়ে যেতে চাইলেও তারা রাজি হন নি। কেননা এর মধ্যেই কাজের চাপে দিনের পর দিন রাতে বাড়ি না ফেরা,ফিরলেও মদ্যপ অবস্থায় ,বাবা-মা কে একটু সময় না দেওয়া - এগুলো তারা কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছিলেন না। রণিত তার স্টেটাস বজায় রাখতে যখন বাবা মা কে ফ্ল্যাটে ছেড়ে একদিন নিজের নতুন বাড়িতে চলে গেলো,যাওয়ার সময় মা-বাবা তাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, "জীবনে সুখে শান্তিতে থেকো বাবা "। যদিও ছেলের সেদিন খুব একটা পছন্দ হয়নি কথা টা , সেদিন তাই সে বলেছিলো ,"তোমরা কেন আমায় জীবনে আরো উন্নতি করার আশীর্বাদ করলে না ?"


এবার ফেরা যাক রণিত এর বর্তমান জীবনে। আজ সে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ,অনেক টাকার মালিক, জনপ্রিয় অভিনেত্রী মল্লিকা কে বিয়ে করে বিবাহিত (সংসারী বলা ঠিক হবে না ), এক সন্তানের বাবা। এখন কাজ আর টাকা উপার্জনই তার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। যাই হোক এভাবেই কাটছিলো দিন। 


হঠাৎ একদিন সারা বিশ্বের মতো রণিতের শহরেও থাবা বসালো এক ছোঁয়াচে সংক্রমণকারী মারণ ব্যাধি। যার জন্য দেশে চালু হলো প্যান্ডেমিক লক ডাউন। সব অফিস আদালতের কর্মীদের যখন ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে কাজ করার অনুমতি মিলতে লাগলো, রণিত কিন্তু তার কিছু সিনিয়র কর্মীদের অফিসে একসাথে বসিয়েই কাজ করে যাচ্ছিলো। একদিন অফিসের সকলে জানতে পারলো তাদের বস মানে রণিত সেন ও সেই মারণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। তাই তারা সকলে যখন বাড়ি থেকে কাজ করার অনুমতি চাইলো ,রণিত মেনে নিলো না সেই রিকোয়েস্ট। সে বললো, " আমার হয়েছে বলে তোমাদের হবে ,এমন তো কোনো কথা নেই ,সেফটি রুল মেনে চলো ,সুস্থ থাকবে। আর অসুস্থ হলে ছুটি নেবে। আমায় দেখো এই অসুস্থ শরীর নিয়েই কাজ করছি। বাড়িতে আমার ওয়াইফ ও অসুস্থ, ডাক্তার দেখছে ওকে। বাড়ি থেকে আমি কি করবো ? আর বাড়িতে থাকলে আমার কাজের কত ক্ষতি হবে ,ভেবেছো একবার তোমরা? তাই ওসব ভুলে কাজে মন দাও,আর অফিসে এসেই কাজ করতে হবে তোমাদের। " এই অবান্তর কথা গুলো শোনার পর কিছু কর্মী চাকুরী ছেড়ে দেয় , দু' একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে ,আর কিছু কর্মী বাধ্য হয়ে অফিসে এসে কাজ করতে থাকে। 


কয়েকদিনের মধ্যেই রণিত অফিসে আসা বন্ধ করে দেয় , খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে হাসপাতালে ভর্তি। হ্যাঁ, শহরের সবথেকে নামী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল রণিত , কিন্তু পরিবারের কেউ , আত্মীয় স্বজন, বন্ধু- বান্ধব বা অফিসের কেউই একদিনের জন্যও তাকে দেখতে যায়নি হাসপাতালে। আর বাবা-মা তো কিছুদিন হলো মারাই গেছেন। বড় বড় ডাক্তারদের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেও বিছানা থেকে নামার ক্ষমতা ছিল না তার। বাড়িতেই নার্স ,আয়া এদের দিয়েই দেখাশুনা চলছিল। ছেলেটা পাশের ঘরেই খেলতো , কিন্তু একবারও আসতো না বাবার ঘরে , বাবার কাছে । সেতো চিনতোই না তার বাবাকে সেভাবে। কারণ বাবা যেদিন গুলোতে রাতে বাড়ি ফিরত ,তখন ছেলে ঘুমিয়ে পড়তো ,আর সকালে ছেলে ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাবা বেরিয়ে যেত। আর ওয়াইফ মল্লিকা ,সে আগেই সুস্থ হয়ে যাওয়ায় সেলফ-কেয়ার এ মনোনিবেশ করেছে ,তাই ফার্স্ট ফ্লোরে নিজের কাজে ব্যাস্ত থাকায় সেকেন্ড ফ্লোরে নিজের স্বামী কে দেখতে আসার সময় কোথায়? আর তার অসুস্থতার সময় যারা তার দেখভাল করেছিল ( যেমন ডাক্তার , নার্স , আয়া ),তারাই তো রণিত কে দেখছে এখন , তাই নো টেনশন। 

শারীরিকভাবে ধীরে ধীরে রণিত সুস্থ হতে শুরু করলেও মানসিক যন্ত্রনায় সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। মনে পড়ে বাবা মায়ের দেওয়া আশীর্বাদের কথা গুলো ("জীবনে সুখে শান্তিতে থেকো বাবা "),মনে পড়ে কোনো এক কালে বলা এক বন্ধুর কথা গুলো ("জীবনে টাকাটাই সব নয় রে , পরিবারকে একটু সময় দিস "। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে। আজ টাকার উপর শুয়ে থাকলেও রণিতের বড় শক্ত লাগে বিছানাটা ,ঠান্ডা ঘরেও যেন হার্ট বীট তা বেড়েই চলেছে। চোখ বন্ধ করে এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে দুপাশে তার স্বর্গীয় বাবা-মায়ের উপস্থিতি অনুভব করে --মা-বাবা যেন বলছে তাকে ,আয় বাবা, এবার তোকে কাছে পেলে সঠিক শিক্ষা দেব, জীবনের সঠিক অর্থ বোঝাবো তোকে,টাকার বিনিময়ে নয় বাঁচার মতো করে বাঁচতে শেখাবো ,জীবন যুদ্ধে ভালোবাসা দিয়ে জিততে শেখাবো ,আর তার জন্য তোকে বিদেশে পাঠাতে হবে না,সব ছেড়ে চল আবার শুরু থেকে শুরু করি আমরা।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational