রিমঝিম বৃষ্টি (শেষ পর্ব)
রিমঝিম বৃষ্টি (শেষ পর্ব)
সেদিনও আকাশ বেশ মেঘলা । স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্র মারা যাওয়াতে প্রেয়ার লাইনের পরেই স্কুল ছুটি হয়ে যায় । রিমঝিমকে অনেকে সিনেমা দেখতে যাওয়ার জন্য জোর করে , ১২ এর দাদারাও যাচ্ছে বলে কিন্তু সে এককথায় না করে দেয় । খুব রাগ উঠছে ওর নিজের ওপরই , কারনটা সে নিজেও জানেনা । তড়িঘড়ি করে সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে সাইকেলটা নিয়ে বের হতে যাবে এমন সময় ১২ সায়েন্সের একজন সিনিয়র এসে রিমঝিমের পথ আটকে দাঁড়ায় । সিনিয়র বলে এবার একটু নরম গলায় না বলে দেয় সে । সেই ছেলেটি আরও কয়েকবার চেষ্টা করে বুঝতে পেরে যায় যে একে মানানো সম্ভব ন্য়, অগত্যা রাস্তা থেকে সরে যায় । রিমঝিম মনে মনে বলে –"যার আসার কথা সে যদি এসে বলত একবার......”
পাগলের মত সাইকেল চালাচ্ছে রিমঝিম । খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে । মন রাস্তার দিকে নেই । আকাশে কালো মেঘগুলো কত নীচে নেমে এসেছে, ছুটে বেড়াচ্ছে, রিমঝিম একটা মেঘকে টার্গেট করে সেদিকেই ছুটে চলেছে ।
এমন সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল । রিমঝিমের মনে হল আজ ইচ্ছেমত ভিজবে সে । তারপর হঠাৎ মা’র বকুনি মনে পড়ল , আর তাছাড়া আবার জ্বরে বিছানায় পড়লে অনেক ক্লাস মিস হবে – এইসব ভেবে একটু ভিজতেই একটা চারতলা বাড়ির নীচে গাড়ি পার্ক করবার জায়গায় শেডের নীচে এসে দাঁড়াল মলি । সাইকেলটা রাস্তার সাইডে স্ট্যান্ড করা । বাঁদিকে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে কিন্তু ডানদিকে দেওয়াল থাকায় ওদিকের রাস্তা দেখা যাচ্ছে না । এমন মুষলধারে শুরু হল এবার যে হাঁটু পর্যন্ত ভিজে যাচ্ছে । দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া যাকে বলে সেভাবে বাঁদিকের রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল সে । মাঝেমধ্যে কয়েকটা কাক ছাড়া আর কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই সেখানে । বৃষ্টির সাথে মনখারাপের একটা অদ্ভুত সম্পর্ক আছে , বৃষ্টি হালকা মন কেমনকে অনেক গাঢ় মনখারাপে বদলে দিতে পারে নিমেষে ! এই একাকীত্ব হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া ! নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলে তাও রেয়ানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু এখন কি করবে রিমঝিম ! খুব খুব খুব মনে পড়ছে দিলীপ স্যারের ক্লাসে রেয়ানের সেই রক্ত উথালপাতাল করা স্পীচ । এই নির্জনতায় এখন যদি সে রেয়ানকে সামনে পেত তাহলে কিছু একটা অনর্থ হতই হত । এমনটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ “মা গো” বলে কেঁপে উঠল রিমঝিম ।
>
ডানদিকের রাস্তা থেকে হুস্ করে কাকভেজা হয়ে একটা ছেলে এই শেডের নিচে এসে রিমঝিমকে দেখে থমকে দাঁড়াল ! মনে মনে রিমঝিম চিৎকার করে উঠল –
“ রে-এ-এ-এ-এ-আ-আ-আ-আ-আ-আ-আ-আ-ন......!!!”
গোলাপের পাপড়ির মত রিমঝিমের চোখদুটো থেকে বিস্ময়, ভালোবাসা, অভিমান সবকিছু একসাথে ঠিকরে বের হচ্ছে, তবে গলা থেকে একটা টুঁ শব্দও বের হল না । রেয়ানই সেই সশব্দ বৃষ্টির মাঝে দুজনের মাঝের নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে বলল –
“ তুমি এখানে...?”
প্রশ্নটা বোকা বোকা হলেও রেয়ানের মাথায় আর কিছু আসছিল না । উত্তরে রিমঝিম বলল –
“ বাড়ি যাচ্ছিলাম, রাস্তায় এমন জোরে বৃষ্টি নামল যে এখানে আটকে
গেলাম ।“
“ অহহহ, তুমি গেলে না কেন সিনেমা দেখতে ...?”
জড়তা ও লজ্জার মাথা খেয়ে রেয়ান জিজ্ঞেস করল । রিমঝিম এবার বেশ অবাক হল ।
“ তুমি জানলে কি করে যে আমি সিনেমা দেখতে যাইনি...!!?”
“ আমিও যাইনি তাই...”
“ মানে...?”
“ মানে, কিছুনা... তুমি বুঝবে না... প্রায় পুরো ভিজেই গেছো তুমি দেখছি । এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেটা আমারই বাড়ি । তবে বাবা, মা কেউ নেই এখন বাড়িতে, তাই তোমাকে ভেতরে যেতে বলতে পারছি না । তবে তুমি যদি চাও বৃষ্টিটা না কমা পর্যন্ত তোমার সাথে এখানে দাঁড়াতে পারি...”
এতক্ষনের বৃষ্টির কালো কালো ছিটেগুলো হঠাৎ কেমন রামধনু রঙের হয়ে
গেল । এতক্ষণ মনে হচ্ছিল কেন কেউ রাস্তায় নেই ,তবে এখন রিমঝিমের মনে হচ্ছে কেউ যেন আর রাস্তায় না আসে ।
সেদিন বৃষ্টি থামতে আরও ১০ মিনিট সময় নিয়েছিল, আর ওদের গল্প থামতে সময় লেগেছিল ৩০ মিনিটের মত । সেদিন বৃষ্টি রিমঝিমকে যা বোঝানোর, যা শেখানোর সবকিছু বুঝিয়ে, শিখিয়ে দিয়েছিল ।
সেদিন রিমঝিম প্রথমবারের মত ভালোবাসা নামের অনুভূতি অনুভব করেছিল । সেদিন প্রথমবারের মত রিমঝিম বুঝেছিল –
ভালোবাসা মানুষকে সহনশীলতা শেখায় , ভালোবাসা মানুষকে সৃষ্টিশীল করে তোলে – হাতে হাত ধরে গড়তে শেখায় । সেই রাতে রিমঝিম প্রথমবারের জন্য কিছু সৃষ্টি করেছিল ডাইরির গোপনীয়তায় –
“ যেদিন
মেঘ ছুঁতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম
সেদিন
প্রেম এসেছিল...”