ফেরিঘাটে
ফেরিঘাটে
"এ প্রকৃতির সৌন্দর্যের মায়া কাটানো যে অসম্ভব, ঠিক তোমার মতোই। বারবার আকৃষ্ট করে কাছে টেনে আনে। তোমার নেশায় যেমন আচ্ছন্ন করেছো, তেমনই এখানে এনে স্নিগ্ধ প্রকৃতির মোহে মোহান্বিত করেছো।
আজকের সূর্যটা যেন বড্ড ক্লান্ত, ঠিক আমার মতো। সোনালী আভা আজ যেন মায়া জড়িয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। নদীর জলে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত তিনি, এটাও ঠিক আমার মতো। কিছুক্ষণ পর, পশ্চিমে নদীর কোল ঘেঁষে ঢলে পড়বে, তারপর একদম ডুবে যাবে নদীর অথল জলে।
আজ মাঝিরাও যেন সারি গানের বদলে জারির সুর ধরেছে। দিনশেষে সবাই আজ বড্ড ক্লান্ত, ঠিক ঐ সূর্য মহারাজ আর আমার মতো।.. "
" সাব!"
নিজের আনমনে কত কিছু বিড়বিড় করছিলো সুমন, কারোর একটা কন্ঠস্বরে পিছনে ঘুরে তাকালো। সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে খুব বেশি অবাক হলো না সে। যদিও এই মানুষটার সাথে কোনোদিন কথা হয়নি। তবে বহুবার সে আর প্রতীক্ষা ভেবেছে এই মানুষটার সাথে পরিচয় করবে, কিন্তু কোনোদিন তা হয়ে ওঠেনি। আজ সেই মানুষটাই তার একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ, একধরনের অপ্রাপ্তির ছাপও আছে তার অবয়বে, এই ছাপটা খুব ভালো করে চেনে সুমন। কেন না, তার চোখে মুখের আদলে সেই ছাপটা খুব স্পষ্ট। ঠোঁটের কোণে কোনোরকমে একটা হাসি জড়ো করে বলে উঠলো, " কিছু বলবে!"
সামনে থাকা মানুষটা কিছুটা ইতস্তত করে, তারপর বললো,
" আজ্ঞে, মেমসাবকে দেকি না তো! কদ্দিন হয়ে গেলো। ঐ যে আমার নৌকা। ওকান থেকে আমি প্রায় দেকতাম তোমরা এগসাতে এইকেনে আসতে। মাজকানে আসা বন্ধ করে দিয়েচিলে। গত হপ্তায় তুমি এগলা এলে, আজগেরও। সে জন্যি ভাবলুম জিজ্ঞেস করি। আমি অনেক্কন তেকে আসবো কি আসবুনি সেইডা ভাবতেছিলুম।
- তোমার বুঝি আমাদের একসাথে দেখতে খুব ভালো লাগতো!
- সে আর বলতি! কত্তার কাচে তো সেইটা বলি, অমন জোড় যেন জনম জনম এগসাতে থাকে।
মেমসাব কেন আসে না!
- মেমসাব আর আসবে না কোনোদিন। তোমার কর্তা মনে হয় তোমার কথা শোনেননি, তাই তো আমাদের একসাথে থাকা হলো না। তোমার মেমসাব অনেক দূরে চলে গিয়েছে, চাইলেও ধরা দেবে না।
- মেমসাবও ফাঁকি দিল!
- হুম, ওকে তো কেড়ে নিয়ে গেলো। ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়লো মাস ছয়েক আগে। তারপর থেকে হাজার এক বায়না তার। নাছোড়বান্দা ছিল তো খুব। একদিন এখানে আসার জন্য বায়না ধরলো, আমাকে নিয়ে আসতে হলো। তারপর থেকে এই ফেরিঘাটে রোজ আসতে হতো ওর জন্য। স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম ও রেডি হয়ে বসে আছে। পাঁচ মাসে এই জায়গাটা আমাদের বহু স্মৃতি গড়েছে, বহু অনুভূতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। গত একমাস ওর শরীরটা আর টানতো না, একদিন সবশেষ...
বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সুমন। তারপর আবারও বলতে শুরু করলো, " প্রতীক্ষা বারবার বলতো তোমার সাথে কথা বলার জন্য, তোমার
নৌকোতে করে নদীর বুকে ঘোরার কথাও বলতো। তার এই ইচ্ছেটা পূরণ করা হলো না। "
- নিচে এই লীলাখেলা দেকিয়ে ওপরে বসে বসে মজা নিচ্চেন তিনি!.. কত্তা কি ঠিক করে রেকেচে কারোর এগসাতে থাকতে দেবেনি!
- তোমার চোখ দুটোও তো আমার চোখের কথাটাই বলছে। সেও কি ফাঁকি দিয়েছে!
- সে আজগের কথা নয়, বচর সাতেক হলো বোদয়। এই নদীর বুকে দুজন মিলে ভেসে বেড়াতুম। সক্কাল হলি আমার সাতে এক্কেবারে চলে আসতো, শিক্কিত ছিল। ম্যাট্টিক পাশ! আমার মতো মুক্কু নয়। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলুম। ওপাড়ের একটা বাড়িতে টিউশুনি পড়াতো। সক্কালে ওপাড়ে ছেড়ে আসতুম, আবার নিয়ে আসা। মাঝিরা ফেরী ছেড়ে ঘরে গেলে দুজন এই নদীর বুকে অনেক রাত অব্দি থাকতুম। কত্তার সজ্জ হলুনি, আমার থেকে কেড়ে নিল।
মানুষটাও ঠিক সুমনের মতোই দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে গেলো।
সুমনও আর কিছু বললো না। দুজন মানুষেরই অনুভূতি গুলো এখন পুরোপুরি এক। তাই মুখে কিছু বলার দরকার পড়লো না। কয়েক মুহুর্ত পর মানুষটা বলে উঠলো, " আজ আসি সাব।"..
সুমন মাথা নেড়ে বিদায় জানালো তাকে।
চোখ মেলে বয়ে যাওয়া নদীটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
" দেখলে প্রতীক্ষা! এই ফেরিঘাটে কত মানুষের আনাগোনা, তাদের কত যন্ত্রণা। কেউ আসে সম্পর্ক গড়তে, স্মৃতি গড়তে; আবার কেউ বা বিষন্নতা কাটাতে, ক্লান্ত শরীরে একটু প্রসন্নতা খুঁজে পাওয়ার আশায়। আমরা যখন আসতাম তখন তো কেউ বুঝতেই পারেনি আমাদের মধ্যে থাকা হারানোর ভয়টা, আমরাও কখনও ভাবিনি দূরের ঐ মাঝিটাও বহুদিন আগে প্রিয়জনকে হারিয়ে বসে আছে।
এই ফেরিঘাটটাই যেন অনুভূতি সঞ্চয়ের কারিগর। এখানে শুধু এপাড়-ওপাড়ের মানুষের আদান-প্রদান হয় না, অনুভূতির আদান-প্রদানও হয়।
ঐ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দম্পতির মনের কথাটাও জানা নেই কারোর, এই ঘাটের প্রতিটা মাঝির গল্পটাও কেউ জানে না। ঐ যে বৃদ্ধাটা! ওনার গল্পটাও অজানা। সেই কবে থেকে দেখছি উনি প্রতিদিন এই সময়টা জুড়ে এখানে বসে থাকেন। হয়তো উনিও আমার মতো স্মৃতিগুলোকে মনের খাতায় জীবিত রাখতে এখানে আসে।
আর এই ফেরিঘাটটা দেখো! কখনো কাউকে ফিরিয়ে দেয় না। সবার কথা শুনতে থাকে নিস্তব্ধ হয়ে। সবার দুঃখের গল্পের সাক্ষী হতে হতে, মাঝে মাঝে ওর প্রকৃতি হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়ে; কিন্তু, ঐ বাইশ-চব্বিশের কপোত-কপোতীগুলোর ভালোবাসার ছোঁয়াতেই যেন প্রাণ ফিরে পায়।
আমি আগের মতো প্রতিদিন আসবো এখানে। প্রকৃতির মাঝে তোমার ছবি আঁকতে। রং তুলির দরকার হবে না, মনের ক্যানভাসে স্মৃতি দিয়ে ছবি আঁকবো।
আচ্ছা, ঐ মানুষটা বুঝি রাত হলে আমার মতো করে কাঁদে!.. হুম, কাঁদবে নাই বা কেন!..
আচ্ছা, প্রতীক্ষা আজ আসি,কেমন!.. কাল আবার আসবো তোমার স্মৃতি নিয়ে।"
একটা স্নিগ্ধ বাতাস এসে ফেরিঘাটের আবেগী পরিবেশটাকে একেবারে শান্ত স্তব্ধ করে দিয়ে গেলো।