নিশার নেশা
নিশার নেশা


অন্ধকার ঘর। কেউ কোথাও নেই আসে পাশে। শুধু আমরা চারজন। আর আছে একটা উইজা বোর্ড, তার উপর একটা কাঠের প্ল্যানচেট। প্ল্যানচেটের উপর আমাদের সবার ডান হাত। ঘরের চার কোণে চারটে মোমবাতি জ্বলছে কিন্তু তার আলোতে খুব আবছা দেখা যাচ্ছে আমাদের মুখ। ঠাণ্ডা থাকলেও কপালে একটু হালকা ঘাম। ভয় যে করছে না, তা নয়! তবে আজ আমরা ঠিক করেছি যে করে হোক নিশার সাথে কথা বলবো...নিশা আমার একসময়কার বেস্ট ফ্রেন্ড।
ভারী মিষ্টি মেয়ে ছিলো নিশা, ওর সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত। গল্প করে, খেলে। ওর ছিল ঘড়ির শখ। ওর বাবার সাথে মিলে ও ঘড়ি বা ঘড়ির ডায়াল জমাতো। বিভিন্ন সাইজের, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের, বিভিন্ন রঙের। ওর বাবা মাঝে মাঝেই বাইরের দেশে গেলে ওর জন্য ঘড়ি কিনে নিয়ে আসতেন। শেষবার গেছিলেন জার্মানিতে; ব্ল্যাক ফরেস্টে। নিয়ে এসেছিলেন ওখানকার বিখ্যাত কুক্কু ক্লক। কি সুন্দর দেখতে। বাদামি-কালো কাঠের তৈরি; একদম মাথায় দুদিকে তাকিয়ে দুটো কোকিল – তাদের চোখে লাল পাথর বসানো। ঘড়িটার মাঝখানে একটা গোল ডায়ালে সাদা দুটো কাঁটা। প্রত্যেক ঘণ্টায় ডায়ালের উপর একটা ছোট দরজা খুলে যায়, গ্রে রঙের একটা পাখি বেরিয়ে এসে কোকিলের ডাক শোনায়। আমাকে যেদিন দেখিয়েছিল ঘড়িটা, আমি হেসে বলেছিলাম – যেটা ডাকে সেটাই তো কোকিল না! তাতে নিশা আমাকে খুব বকেছিলো। বুঝিয়েছিলো আমাকে যে মেয়ে কোকিল কালো হয়। আর ওরা ডাকে কুউউউউউ করে। ছেলে কোকিলরা ওরকম গ্রে রঙের হয় আর ওরা ডাকে কুক্কু-কুক্কু করে। যদিও এটা খালি এক ধরণের কোকিলের রঙ। আরও প্রায় পাঁচ থেকে ছয় রকমের কোকিল হয়! আমি অবাক হয়ে গেছিলাম ও এতকিছু জানে কিভাবে! বললো ওর বাবা ওকে বলেছে।
এর কয়েকদিনের মাথাতেই নিশা মারা গেল। ওদের সিঁড়ির দোতালার ল্যান্ডিংয়ে এই ঘড়িটা লাগানো ছিল। সেদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে ও দেখেছিলো ঘড়িটা আর বাজছে না। নিজেই একটা চেয়ার সিঁড়িতে লাগিয়ে ঠিক করতে যায়। আন্টি তখন চান করতে গেছিলেন... ওর চীৎকার শুনে বেরিয়ে এসে দেখেন একতলায় সিঁড়ির সামনে নিশা পড়ে। সাথে সাথে অ্যাম্বুল্যান্স, হসপিটাল; কিন্তু ওকে বাঁচানো যায়নি।
আমরা প্ল্যানচেট শুরু করলাম। মোমবাতিগুলো যখন গলে প্রায় শেষ তখন হঠাৎ প্ল্যানচেটের কাঠটা নড়ে উঠলো যেন। আমার কেমন যেন মাথা ঘুরতে লাগলো, অন্ধকার হয়ে গেলো সব। কতক্ষণ জানি না, মনে হলো কেউ যেন আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে...
চোখ খুলে দেখি আমার বিছানায় আমি শুয়ে; ঘরে খুব রোদ। তার মানে অনেক বেলা হয়ে গেছে! আরতি মাসি আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে – ওঠো মেঘা ওঠো, কত বেলা হয়ে গেলো বলো দিকি!
ঈশ, তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম!
ব্রাশ করতে বাথরুমের দিকে যাওয়ার সময় মা রান্নাঘর থেকে বলে উঠলো – সাবধানে যাস, ওখানে হয়তো কাঁচ আছে এখনো?
আমি বললাম – কেন? কি ভেঙেছে?
মা বললো – ওয়াল ক্লকটা একটু আগে পড়ে গেলো হঠাৎ!