নির্বাণ
নির্বাণ


চৈত্রমাসের শুকনো খসখসে হাওয়া বইছে।গরম পরতে এখনও মাসখানেক দেরী আছে তবে দিনেরবেলায় রোদের তেজ ভালোই থাকে।ছাউনির ঘর থেকে বেরিয়ে একটা বিড়ি ধারালো কুদুর।
বেলা এখনও বেশি হয়নি আর একটু বেলা গড়ালে কুদুরের বউ মতি বাজার থেকে ফিরে দুটো খুদ সেদ্ধ করবে,সেই খুদ খেয়ে কুদুর কাজে বেরোবে। কুদুরের বউ মতি ভোর থাকতে বেরোয় তারপর শাকটা পাতাটা তুলে কিছু বাজারে বিক্রি করে কিছু বাড়িতে নিয়ে আসে।
কুদুরের বাপঠাকুরদা বংশপরম্পরায় মেথর, কুদুরও পেটের টানে সেই পথই ধরেছে যৌবনকাল থেকে।এই গ্রামের সব বড়মানুষের বাড়ির মলমুত্র পরিষ্কার করে নিজের মাথায় করে তা ফেলে আসে কুদুর।খুব যত্নে ঝাড়পোছ করে ঝকঝকে করে দেয় বাবুদের ঘরদোর।কাজ শেষে বাবুরা কুদুরের পাওনা টাকা মাটিতে ফেলে দিয়ে গিয়েই গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিজেদের শুদ্ধ করেন।
প্রথম প্রথম এসব দেখে কিছুটা খারাপ লাগতো কুদুরের, যৌবনের তাজারক্ত বাবুদের ওপর রাগে টগবগ করত। যুবক কুদুর ভাবতো একদিন এই বাবুদের বুঝিয়ে দেবে সে কী.. ইত্যাদি তবে বয়স কিছুটা বাড়তে আর সংসারেএ বোঝা চাপতে আজ বছর পাঁচেক হল বাবুদের প্রতি কুদুরের বিদ্বেষ ভাব অনেক প্রশমিত হয়েছে।সারাদিন খাটাখাটির পর নিয়ম করে চুল্লুর ঠেকে যায় কুদুর সেখানে ইয়ারদোস্ত দের সাথে ঠাট্টাতামাসা আর মক্ষীরানির হাতের গরম গরম তেলেভাজা সহ চলে পানাহার।
তারপর রাত গভীর হলে কুদুর বাড়ি ফিরে দেখে মতি তার ভাতের থালা আগলে ঘুমে ঢুলছে ,কোনও কোনও দিন মরদ আর মাগী মিলে হেব্বি মারদাঙ্গা করে আবার কখনও কখনও ভারী প্রেম গদগদ হয়ে তারা রঙতামাশা করে।
যাই হোক এইভাবেই কোনওরকম চলে যাচ্ছিল কুদুর আর মতির সংসার।দশবছরের সংসার জীবনে মতি তিনবার গর্ভবতী হয়েছিল তবে দুর্ভাগ্যবশত তিনবারই সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়েই মারা গেছে।মতি কেঁদেকেটে একসা হয়েছে বারবার দু:খ পেয়েছে কুদুরও। তবে সন্তান শোক নিয়ে বসে থাকলে গরীবের চলে না তাই ভবিতব্য কে একপ্রকার মেনে নিয়েছে কুদুর।তবে সমস্যা হল সন্তনাকাঙখার মত সব আকাঙখা মানুষ চাইলেও ভুলে যেতে পারেনা।কুদুরও পারেনি। তিনটে মৃতসন্তান প্রসব করে মতি ঠান্ডা মেরে গেছে।রাতের বিছানায় কুদুর সোহাগ করতে চাইলেই কেমন যেন সিঁটিয়ে যায়, মতির আনিমিক শরীর মরামানুষের মত পরে থাকে কুদুরের উদগ্র কামনার সামনে।প্রতিরাতে নিজেই কিছুক্ষন ঝাপটা ঝাপটি করে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পরে কুদুর আর মতি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে-“ তুই আর একটা বিহা কর,আমার এই শরীলটাতে আর কিচ্ছু বাকি নাই..”।মতির কান্নার সামনে কুদুরের হায়নার মত ভয়ংকর কাম শান্ত হয়ে আসে।এই অভাবের সংসারে দ্বিতীয় বিয়ে করা মানে বিপদ ডেকে আনা আর মতিকে ত্যাগ করে নুতন বউ নিয়ে সংসার করতে পারবেনা কুদুর।কয়েকবার ইয়ারদোস্তদের পাল্লায় পরে ছাউনির ধারের মন্দ মেয়েমানুষদের কাছেও গিয়েছিল কুদুর তবে তার এক ইয়ারের এই মেয়েমানুষদের থেকে কি এক নোংরা অসুখ হওয়ার পর থেকে কুদুরের ভয় ধরেগেছে, তাই সেই পথও বন্ধ।
বিড়িতে শেষটান টা দিতে দিতে আনমনে কিসব ভাবছিল কুদুর চটক ভাঙল ফটিকের ডাকে।ফটিক কুদুরের ছেলেবেলার বন্ধু এবং ওর মতই মেথর।
-হ্যাঁ রে কুদুর শুনছিস!?
-আরে ফটিক আয় ভাই বিড়িতে দুটো টান দিয়ে যা।
-নারে ভাই পরিবারের খুব অসুখ! আজ একবার ডাগদার না দেখালে..
-ও কি হয়েছে ভাবীর?
-আজ সাতদিন ধুম জ্বর..আজ সকাল থিকে অজ্ঞান হয়ে আছে!
-না ভাই তুই যা বরং..
-শুন না কুদুর তুই আমার হয়ে আজ জমিদারবাবুর বাড়িতে কাজ করে আসবি?আমার যাওয়ার কথা ছিল আজ কিন্তু বুঝতেই তো পারিস..আবার না গেলেও গর্দান যায়!
-তুই ভাবিস না আমি করে আসব তুর কাজ।
-বাঁচাইলি তু ভাই।
একটু বেলার দিকেই বেরোল কুদুর।জমিদারবাড়ির কাজটাতে ভালোই পাওয়া যাবে বোধহয়, তার কিছুটা নাহয় ফটিকের বাড়িতে দিয়ে আসবে সে! বালবাচ্চা আছে ফটিকের একদিন উপার্জন না হলে বাছারা তার খেতে পাবেনা।কুদুরের এক মতি ছাড়া কেই বা আছে!?এসব ভাবতে ভাবতে জমিদার বাড়িতে পৌঁছে গেল কুদুর তারপর নিজের কাজ বুঝে নিয়ে বাড়ি থেকে পরে আসা পরিষ্কার জামা ছেড়ে কাজে নেমে পরল সে।
জমিদারবাবুর বাড়িতে মোট পাঁচটা শৌচাগার আর ততগুলোই স্নানাগার। সেসব গুলো খুব যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করে কুদুর,জমিদারবাবুর মানুষ ভালো,তাঁর বাড়িতে যদি একবার কোনওভাবে বহাল হওয়া যায় তবে আর পেটের চিন্তা থাকবে না তাদের, মতিকেও আর সাতসকালে শাকপাতা তুলে বেচতে যেতে হবেনা।এসব ভাবতে ভাবতে চারনম্বর শৌচাগারের নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে টিনের ট্রে টা সরানোর জন্য মাথা তোলে কুদুর। মাথা তুলে ওপরে তাকাতেই মুহুর্তের মধ্যেই কুদুরের সারা শরীরে বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে যায় যেন। সে দেখে তার মাথার ঠিক ওপরে দুটি অর্ধচন্দ্রাকার উজ্বল পেলব নিতম্ব আর শীতের প্রথম টসটসে কমলালেবুর কোয়ার মত যোনী। মুহুর্ত খানিক সময় মাত্র, তারপরেই ছিটকে সরে আসে কুদুর শৌচাগারের ট্রে টা খুব কোনওমতে রেখেই বেড়িয়ে আসে কুদুর, টের পায় এর আগে কোনওদিনও তার শরীর এমন ভয়াল ভাবে জেগে ওঠেনি।একী দেখল সে!? কাকে দেখল? এই মেয়েমানুষ কী পৃথিবীর কেউ নাকি স্বর্গের কোনও হুর পরী! যার শরীরের একটা অঙ্গই এত সুন্দর তার সমস্ত শরীর না জানি কেমন হবে! শরীরটা অবশ হয়ে আসে কুদুরের হঠাৎ খুব শীত করতে থাকে।একটা অজানা ভয় আর তীব্র শারীরিক উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে আসে কুদুর।কোথায় আর পাওনা গন্ডার হিসেব কোথায় আর জমিদারবাড়ির বাধা কাজ পাওয়ার তাড়না! কুদুরের শরীর মন জুড়ে শুধু ওই উজ্বল পেলব নারী- অঙ্গ আর কোনও কিছুই মাথায় আসছে না কিছুতেই।যে করেই হোক যেভাবেই হোক এই নারীকে তার চাইই চাই! কিন্তু কিভাবে? এসব ভাবতে ভাবতেই কোনওরকমে বাড়ি ফেরে কুদুর,এক গা ধূমজ্বর নিয়ে।
আজ চারদিন প্রবল জ্বর সেরে উঠেছে কুদুর কিন্তু জ্বরের প্রাবল্যেই বোধহয় একটু ভেবলে গেছে সে।সারাদিন তেমম কথা বলে না কুদুর বললেও ভুল বকে মতি কোনওমতে খাইয়ে দেয় দুটো তারপর আবার কুদুর চুপচাপ বসে থাকে আর মনেমনে সর্বক্ষণ সেই পেলব নিতম্ব আর রেশম যোনীর কথা চিন্তা করতে থাকে।চিন্তার ঘোর কখমও হালকা থাকে কখনও গভীর। এমনই এক চিন্তার ঘোরের মধ্যেই কুদুর একদিন মতির কাছে স্বীকার করে তার বাসনার কথা,অকপটে বর্ণনা করে সেদিনের মুহুর্তখানেকের জন্য দেখা অভূতপূর্ব দৃশ্যের কথা।মতি মন দিয়ে শোনে আর মাথায় হাত দিয়ে বলে-“ হায় অদ্দেষ্ট!এ কী বলিস তুই কুদুর সে নিশ্চয়ই জমিদারবাবুর নূতন বউ, শুনেছি মাগী বড় সুন্দরী কিন্তু তাকে কিভাবে এনে দিব! আমাদের জাতের কোনও অল্পবয়সী মেয়ে হলে নয় তবু হত কিন্তু..একী সব্বোনাশ করলি কুদুর! হ্যাঁরে মাঠাকুরণ বোঝেননি তো তুই যে নীচে দাইরে তারে দেখিচিস? হায় যদি জানে তবে তো জমিদারবাবু আমাদের গর্দান নেবেন রে!..” মতির এতগুলো কথার একটাও স্পর্শ করেনা কুদুরকে, সে শুধু সেই অবাক করা নারী-অঙ্গের কথাই ভাবে বসেবসে। দিনরাত এভাবেই পার হতে থাকে।
বছর দুয়েক পরের কথা।কুদুরের সতীসাধ্বী বউ মতি বছর দেড়েক হল দুর্বিষহ জীবনযন্ত্রণা সইতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়েছে।তাদের ছাউনির ঘর কোনও এক কালবৈশাখী ঝড়ে গুড়িয়ে গেছে, সে বাড়ি আর জোড়া লাগেনি।কুদুর বাড়িঘর ছেড়ে বহুদিন গ্রামের শেষপ্রান্তের বকুল গাছতলায় আশ্রয় নিয়েছে।দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল আর চুলের জটার পেছনে ঢাকা পরেছে কুদুরের পূর্বাশ্রমের ইতিহাস।গ্রামের লোকের কাছে সে এখন ধ্যানিবাবা।সারাদিন চোখ খুলে চিন্তার গভীরে ডুবে থাকে এমন ভাবে যেন মনেহয় গভীর ধ্যানেমগ্ন সে।ইতিমধ্যেই গ্রামের নারী-পুরুষ নিয়ম করে তার সামনে রেখে যায় ফলমূল,দুধ দই পায়েস প্রভৃতি।কুদুর কোনও সময় সেসবের দিকে ফিরেও চায়না আর তার এই ফিরে না চাওয়ার জন্যেই ভক্তদের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলে সন্ধ্যে হলেই ধ্যানীবাবার নামে জয়ধ্বনি দেয় ভক্তকূল।এইভাবে কাটে আরও কতদিন।
কোনও একবছর সে গ্রামে বৃষ্টি হয়না একবিন্দুও।বৃষ্টির অভাবে মাঠঘাট ফুটিফাটা হয়ে ওঠে।মহাসমারোহে ব্যাঙ দম্পতির বিয়ে দিয়েও ফল পায়না গ্রামবাসী।তারপর কিভাবে যেন ধ্যানিবাবার মাহাত্ম্য পৌঁছে যায় জমিদারবাড়ির অন্দরমহলে। সকলে বলাবলি করে জমিদার গিন্নী বড়ই সুলুক্ষণা তিনি যদি শুদ্ধ শরীর মনে ধ্যানিবাবার আরাধনা করেন তবে নিশ্চয়ই বৃষ্টি আসবে গ্রামে।আলোচনা কানে যায় জমিদার গিন্নীর শৈলবালার।তিনিও ধ্যানিবাবার কাছে গিয়ে গ্রামের মঙ্গলের জন্য পুজো দিতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন।নিদৃষ্ট দিনে জমিদার বাড়ির থেকে রুপোর পালকি করে শৈলবালা রওনা দেন ধ্যানীবাবার ধামের উদ্দেশ্যে। পালকি থেকে নেমে আসেন শুভ্র উজ্বল শাড়ি পরিহিত জমিদার গিন্নী। তারপর ধ্যানীবাবার পায়ের কাছে পূজার উপাচার নামিয়ে রেখে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করেন ধ্যানিবাবাকে।সেদিন রাতে জোৎস্না পরেছিল চরাচর জুড়ে,বকুলফুলের মাতাল করা গন্ধে ম'ম করছিল চারপাশ ,জমিদার গিন্নী শৈলবালা আকুল স্বরে ডাকলেন-“ বাবা! আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন আমায়?ধ্যানিবাবা কোনও উত্তর করলেন না।ধ্যানিবাবার তনুমন মস্তিষ্ক জুড়ে তখনও অর্ধচন্দ্রাকৃতি পেলব নিতম্ব ও কমলালেবুর কোয়ার মত কোমল যোনী।যে নারীর জিন্যে সে ঘর ছেড়েছে, নাওয়া খাওয়া ভুলেছে আজ সে মহার্ঘ্য নারী তার পায়ের লুটাচ্ছে অথচ কুদুরের হুশ নেই।আজ মতি বেঁচে থাকলে এই দৃশ্য দেখে আমোদ পেত হয়তো কেননা গ্রামবাসীর আরাধ্য ধ্যানিবাবার ইতিহাস বোধকরি সে ছাড়া আর কেওই জানতে পারেনি কোনওদিন।কুদুর উদগ্র কামনা তাকে সম্পুর্ণ নিষ্কাম করে তুলেছিল।সিদ্ধিলাভ হয়েছিল তার।সে রাতে আকাশ জুড়ে একদল কালোমেঘ আনাগোনা করেছিল খুব।তিনদিন বজ্রবিদ্যুৎ সহ প্রচুর বৃষ্টিপাত হল,তারপর বৃষ্টি থামতে গ্রামবাসী যখন ধন্যধন্য করতে দুইহাত ওপরে তুলে ধ্যানিবাবার ধামে গিয়ে পৌঁছল তখন দেখল বাজের আঘাতে মরে কাঠ হয়ে আছেন তাদের ধ্যানিবাবা।বকুলগাছটাও পুড়ে খাক,তবে কোথা থেকে যেন বকুলফুলের তীব্র সুবাস আসছে।
(একটি প্রাচীন উপকথার ছায়া অবলম্বনে লেখা)