MANAS KUMAR JANA

Drama

2  

MANAS KUMAR JANA

Drama

মাতৃত্বের অনুভব

মাতৃত্বের অনুভব

4 mins
10.6K


আজ আমার ছেলের এক বছরের জন্মদিন। একটা বিশাল ব্যাংকয়েট ভাড়া করা হয়েছে। অন্নপ্রাশনের সময় অফিস থেকে আমরা দুজনেই ছুটি পাই নি বলে, একবছরে এই বিশাল আয়োজন। ছেলেকে একটা দামি লাল রঙের পাঞ্জাবি পরিয়েছি। কপালে চন্দন,গলায় একটা সোনার ভারি চেইন। মাথায় জরির কাজের খুব সুন্দর একটা পাগড়িওয়ালা টুপি।

গোটা হলটা নানা রঙের বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। কতরকমের আলোর কেরামতি। লাল নীল সবুজ আলো জ্বলছে নিভছে। ওপরে একটা রঙিন গ্লোভ ঘুরছে। বক্সে হালকা রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে। সাজগুজকরা মানুষের মুখ গুলো চকচক করছে সেই রোশনায়।

পাঁচশ লোকের আয়োজন হবে প্রায়। অনেকেই এসেছে। সবার হাতেই বড় বড় গিফটের প্যাকেট। সবাই খুঁজছে আমার ক্ষুদে হিরোকে। এর কোল থেকে ওর কোল, চকাস চকাস চুম্বনের শব্দে আমার বার্থডে বয়ের গালগুলো বেশ লালচে হয়ে উঠেছে। ‘কি কিউট দেখতে রে তোর সোনাকে’ শুনতে শুনতে আর মেকি হাসির সাথে, সাথ দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বেশ রাত হয়ে গেছে। আসর জমজমাট। বড় বড় অফিসের অফিসার, কলিগ, বন্ধু বান্ধব, অতিথি কেউ বাদ যায় নি। ব্যাংকয়েটের সামনে গাড়ির পর গাড়ির লাইন। সবই ঠিকঠাক চলছে যা যা চেয়েছিলাম আমাদের স্টেটাস দেখাতে।

হঠাৎ শুরু হল আমার সোনার কান্না। একটু বাড়তে বাড়তে অসম্ভব জেদি হয়ে উঠলো সেই কান্না। কিছুতেই থামে না। সবাই তটস্থ। এর কোল থেকে ওর কোল। হাতে নানা খেলনা দেওয়া হচ্ছে।সবাই কত মন ভোলানো গান, ছড়া শোনাচ্ছে। তবু আমার সোনার কান্না আর থামে না কিছুতেই। আমি তো শেষে বিরক্ত হয়ে এক চাপড় লাগিয়ে দিলাম। আরো কান্না বেড়ে গেল। সবাই অস্থির। কেউ বলল বাইরে নিয়ে যাও। কেউ বলল বুকের দুধ দাও। কিন্তু সত্যি বলতে কি জন্ম থেকে আমি ছেলেকে বুকের দুধ দিতে পারি নি। ক্যারিয়ারের কথা এবং নিজের শারীরিক সৌন্দর্য এর কথা ভেবে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বোতলের দুধেই দিব্বি বড় হচ্ছে আমার সোনা। সে যাইহোক, ছেলের কান্না আর থামে না। যখন প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছি সামাল দিতে তখন খোঁজ পড়ল আমাদের আয়া দিদির। বছর পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি বয়স, রোগাটে, একটু ময়লা, বেঁটেখাটো, কপালে লাল সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে। হাতে অর্ধ ক্ষয়ে যাওয়া দুটো শাঁখা। উনিই জন্ম থেকেই দেখে আসছে আমার সোনাকে। আজ উৎসব বলে খয়েরি রঙের একটু সুন্দর একটা তাঁতের শাড়ি পড়ে এসেছেন। শাড়িটা আমরাই গত পুজোয় দিয়েছিলাম।

ছেলের যখন কান্নায় বেসামাল অবস্থা, ওনাকে পাওয়া গেল হলের সাইডে সাজ ঘরের এক কোনে। একটু ঘুম ঘুম ভাব এসে যাওয়ায় চুপ করে হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে বসে বসে ঝিমছিলেন। হঠাৎ ডাক পড়ায় উনি ধিড়পিড় করে উঠে এলেন। আমি বললাম একে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। ‘আচ্ছা বৌদি, দিন আমাকে’ বলে উনি যেই কোলে নিয়ে আমার সোনার মুখের দিকে তাকিয়ে ‘কি হয়েছে বাবুসোনা? কান্না কিসের? একদম কাঁদে না!' বলে হাসলেন, দেখি সঙ্গে সঙ্গে ছেলের কান্না হাওয়া। আয়া দিদির মুখে কচি হাতটা বোলাতে বোলাতে আও আও করে কত কি যেন বলছে। দিদিও ঘাড় নেড়ে নেড়ে সাড়া দিচ্ছে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। যে ছেলে একটু আগে কান্নায় অস্থির করে তুলেছিল সেই ছেলেই বেলুনগুলো দেখে মজা করছে আর কি সব নিজের মনে আবোল তাবোল বকে যাচ্ছে। আয়া দিদিও কি সব উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, ছেলে আরও বেশি করে আও আও করছে। আনন্দে মুখের অস্পষ্ট ভাষায় বুদ বুদ কাটছে। মুখটা লালা ময় হয়ে উঠেছে।

অনেক রাত হয়ে গেছে, অনুষ্ঠান শেষ। সবাই চলে গেছে। আয়া দিদির অনেকটা দূরে গ্রামের দিকে বাড়ি। ট্রেন পাবে না বলে আজ আর যায় নি। ছেলেকে ঘুম করিয়ে আমাকে দিয়ে, আমাদের বাড়ির নিচে ছোট ঘরে শুয়ে পড়েছে। সব কিছু শান্ত হয়ে গেছে। বর তখনও বন্ধুদের সঙ্গে ব্যস্ত। হয়তো ড্রিংক্স করছে। আমি যখন ছেলেকে নিয়ে একা শুয়ে আছি তখন আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না পেল। আমি অঝরে কাঁদতে লাগলাম ছেলের মুখটা বুকে চেপে। আমার তখন শুধু মনে হতে লাগলো যে ওই আয়াদিদির মধ্যে কি আছে যা আমার মধ্যে নেই, আমি তো আমার রক্তদিয়ে গড়েছি অথচ কি দিতে পারি নি যার জন্য আমার ছেলের কান্না, তার চাওয়া, তার ভাষা আমি বুজতে পারলাম না! যেন সব আনন্দই আমার কাছে তখন মেকি, মিথ্যে মনে হল। যে অনুভূতিটা আমার ছেলে ওই আয়া দিদির কাছ থেকে পায় আমি তা দিতে পারি নি কেন?

আমার ছেলের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার সারারাত আর ঘুম এলো না।

সেদিন প্রথম আমি অনুভব করলাম মাতৃত্বের অভাব কি জিনিস।

রাত্রে শুয়ে শুয়ে ঠিক করলাম যেন তেন প্রকারে আমি মাতৃত্ব শিখবো, আমার সন্তানের চাওয়ার পাওয়ার ভাষা শিখবো। তবেই যে হবে আমার নারীত্বের সম্পূর্ণতা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama