ক্ষনিকের আলো
ক্ষনিকের আলো
...Atlast গোছ গাছ শেষ। স-পরিবারে যাচ্ছি দেশের বাড়ি ঘুরতে। আমি আমার জিনিস পত্র গুছিয়ে নিজের ব্যাগে ভরেছি, দু হাতে মা-বাবা র ব্যাগ। দিদি তার জিনিস নিজে নিয়ে যাচ্ছে। ও চাকরি সূত্রে বাইরে থাকে, তাই ওখান থেকে ও সোজা দেশের বাড়ি চলে যাবে। রাত ১০টায় আমাদের ট্রেন ছিল, যথা সময়ে স্টেশনে পৌছালাম। বলে রাখি আমাদের দেশের বাড়ি শহুরে এলাকায় বলা যায়, এবং সেখানে বনেদিয়ানায় পুজো হয়। সেই উপলক্ষেই মূলত যাওয়া।
একে রাতে ট্রেন, তাই ট্রেনে উঠে টাইম পাস করার কোনো অবসর ই নেই। তাই আমি সোজা ট্রেনে উঠে, আমার PhD র বিষয় সেটা নিয়ে বসে পড়ি। কি ভাবছেন পড়াকু আমি?? আরে ধুর মশাই আমার PhD র সাবজেক্ট "ঘুম"।
পরদিন সকালে প্রায় ৮টা নাগাদ পৌছালাম গন্তব্যের স্টেশনে। আমাদের নিয়ে যেতে পাশের বাড়ির এক দাদা এসেছিল।
আমাদের ওখানে পুজোর প্রায় দশ দিন সবাই একসাথেই কাটাই পাড়ার লোক। হ্যাঁ খাওয়া দাওয়া যে যার নিজের বাড়িতে করে কিন্তু পুজোর কাজ একসাথে।
আমাদের নিয়ে গেল বাড়িতে। বাড়ি দিয়ে ঢুকতেই বাঁ দিকে চোখ পড়লো - নাট মন্দির। সেই নাটমন্দির, সেই আমার স্মৃতি বিজড়িত নাটমন্দির।
বাড়ি ঢুকে দোতলায় আমাদের বরাদ্দ ঘরে চলে গেলাম, একটু রেস্ট নেয়ার জন্য, কারন এরপর থেকে আমার যা হাজ্জুতি শুরু হবে, সেটা আর না বলাই থাক। পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা, জমিয়ে আড্ডা, এসব করতে করতেই সেদিন চলে গেল। পরের দিন সকালে দিদিও চলে এলো। আমাদের দুটো ঘর, একটায় আমি-দিদি, আরেকটায় মা-বাবা। সারাদিন মজা, হৈ হুল্লোড় আর পুজোর কাজে কেটে যাচ্ছিল কয়েকদিন।
এই ভাবে উপস্থিত হল পঞ্চমী, জোগাড়-কাজ এর পরিমাণ তুঙ্গে এখন।
তখন কটা হবে, এই বেলা ১টা । আমি বসে আছি দোতলায় ঝুল বারান্দায়। গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা গাড়ি, নামলো তিনজন । পরে শুনলাম দাদুর কোন বন্ধুর নাতির পরিবার, ওরা প্রত্যেক বছরই নাকি আসে। আমি আগে ওদের দেখিনি কারন ওরা এলে আগে এ পাড়ায় ওদের একটা বাড়ি ছিল সেখানে উঠতো। বর্তমানে সেটা প্রমোটিংয়ে দেওয়ার জন্য পুজোর সময় টা আমাদের বাড়িতেই থাকবে।
বিকেলে নাটমন্দিরে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি, দেখলাম একটা মেয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে, জিন্স আর কুর্তি পড়া, চুলটা একটু কোঁকড়ানো। এসে জিজ্ঞেস করলো "আমার বাবা কোথায়???" আমি বললাম "বসার ঘরে দেখো।" ব্যাস এটা শুনে ওখান থেকে হাওয়া। আমি ভাবছি মনে মনে এ ব্যাটা আমায় চিনলো কি করে!! আমি আর তেমন পাত্তা দি নি।
সেদিন রাতে একসাথে সবাই খেতে বসলাম, জানতে পারলাম ওর নাম স্বপ্নালিকা। মনে মনে ভাবলাম নাম টা তো বড্ড আনকমন। পরে ঘরে গিয়ে ভালো ভাবে ভাবতে বুঝলাম স্বপ্ন আললিকা = স্বপ্নালিকা, মনে ওই স্বপ্নের আলো টাইপস কিছু।
সেদিন অনেক রাত অবধি খাটা খাটনি হলো, পরদিন ষষ্ঠী বলে কথা। তখন রাত প্রায় ৩ টে, সবাই একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য যে যার ঘরের দিকে যাচ্ছে, আমি দেখলাম স্বপ্নালিকা বাড়ির পেছন দিকে বারান্দায় কানে হেডফোন গুঁজে আকাশ পানে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম গানের রিদিমে মাথা ঝাঁকিয়ে চলেছে।
আমরা একটু কিউরিওসিটি বাড়লো, আমি এমনি বরাবর খজরা হিসেবে পরিচিত। গেলাম গিয়ে বললাম "কি গান শোনা হচ্ছে??" রিপ্লাই এলো "রুপম ইসলামের হারানো পদক"। আমি বললাম "বাহঃ, আমার প্রিয় গায়ক", সে বললো "হুম, আমারও"। এরপর টুকটাক একদুটো কথা বলে ঘরে চলে গেলাম।
পরদিন ভোর ৫টায় উঠলাম, obviously সবার পরে, কোনো রকমে দু মগ ঢেলে হু হু করে দৌড়ে নাটমন্দির। সবাই শেষ মুহূর্তের জোগাড় এ ব্যস্ত। দেখলাম সেও সবার সাথে সাথে হাত লাগিয়েছে, পড়নে একটা নীল চুড়িদার।
সেরা লাগছিলো বটে। গিয়ে সবার সাথে আমিও জুড়ে গেলাম, সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে করতে ভাব টা জমিয়ে নিলাম। তারপর পুজো, দুপুরে খাওয়া সবে তেই টুক টাক কথা বার্তা হতে লাগলো। খাওয়ার পরিবেশনের সময় ওর জমায় ডাল ফেলে বিতিকিচ্ছিরি করে ফেলেছিলাম। যাই হোক, আমি পুজোয় অতো এদিক ওদিক ঘুড়ি না, ও বিকেলে ওর বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে গেল। আমি বাড়িতেই ছিলাম, কিছু বন্ধু দের সাথে আড্ডা মেরে নয় আত্মীয় দের সাথে বকে নয় কাকুর স্কুটার নিয়ে পাড়া ঘুরে কেটে গেল। সেদিন কোনো কাজ আর তেমন ছিলো না বলে আমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি, যাতে আজকের মতো কাল উঠতে দেরি না হয়।
পরদিন সকালে ৪টে উঠে গেলাম, স্নান করে রেডি হয়ে পুজো মন্ডপে চলে গেলাম, সবার সাথে কাজ করছিলাম, আর আনমনে এদিক ওদিক কিছু যেন একটা খুঁজে যাচ্ছিলাম। তখন ঘড়িতে ৫.৩০ দেখলাম একজন কোনো রকমে চোখ কচলাতে কচলাতে মন্দিরে এসে দাঁড়ালো। আমি বললাম -" কি?? হুম?? কাল হেবি হয়েছে??" সে কোনো রকমে এক চোখ খুলে আমায় আড় চোখে দেখলো, দেখে "হুহ" বলে দেখলাম কেটে পড়লো সেখান থেকে। সেদিন বিকেলে দেখলাম ও এসে দিব্বি আলাপ জমালো আমার আর আমার বন্ধু দের সাথে। ও বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ছে জানতে পারলাম, আর জানলাম আমার থেকে জুনিয়র। ওর সাথে আড্ডা মারতে বেশ ভালোই লাগছিলো। ব্যাপার টা আমার মহান দিদির চোখ এড়ায় নি, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় tease করে চলে গেল সবার সামনে। স্বপ্নালিকা ও হেসে ফেললো। সেদিন বিকেলে ও ওর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘুরতে চলে গেল। আমিও বেরোলাম বন্ধুদের সাথে, কিন্তু কিছুক্ষন পর এক অদ্ভুত রাগ হতে লাগলো, বাড়ি চলে এলাম। বড়রা জিজ্ঞেস করলো কোথায় কার সাথে ঝামেলা করে এসেছি কিনা, আমি কিছু না বলে সামনের একটা দোকান থেকে দুটো কেনা এগ্রোল দু হাতে ধরে খেতে খেতে দোতলায় চলে গেলাম। দিদি দেখলাম হোল নাইটের প্ল্যানে বেরোচ্ছে, যাওয়ার সময় আমায় বলে গেল "যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন" বলে চলে গেল। আমি হেসে ফেললাম।
পড়দিন উঠলাম, আমি আজ একটা সাদার উপর কাজ করা একটা পাঞ্জাবি পড়েছি, অষ্টমী বলে কথা। দেখলাম স্বপ্নালিকা এসেছে, লাল এর উপর একটা শাড়ি পড়ে, অপূর্ব লাগছিলো!!! আমার পাশে এসে দাঁড়ালো বললো "আজ বিকেলে এখানকার বড় বড় ঠাকুর গুলো যদি কেউ দেখাতে নিয়ে যায় তো ভালো হয়"। আমি একবার আড় চোখে দেখে নিলাম, দেখলাম সেও আড় চোখে দেখে সোজা অঞ্জলীর দিকে মনোনিবেশ করলো। আমার মনে বেজে উঠলো "বেটা, মান মে লাড্ডু ফুটা??"। আমি আজ যেন একটু বেশি বেশি কাজ করা শুরু করে দিলাম। বিকেল বেলায় বেরোলাম সামনের বড় বড় ঠাকুর গুলো দেখতে, আমি বললাম "মুখ বাঁকানো ছবি টবি তুলবেন নাকি??" সে কটমট তাকিয়ে বললো "তাতে আপনার বাপের কি??"। আমি আর কথা বাড়াই নি। যেতে যেতে টুকটাক কথা হচ্ছিল, কার কি হবি, কে কি করে, কার বন্ধু কি করেছে এসব সব। আমাদের এখানে একটা পুজো হয় যেটা প্রায় ১৫০ বছরের। মন্দিরে ঢুকে স্বপ্নালিকা বললো "ফোন টা ধরো আর একটা ঝাক্কাস ছবি তুলে দাও দেখি ইন্সটা তে দেব" আমি মনে মনে ভাবছি আমি যা শুনলাম তা ঠিক কিনা, সে বললো "কি হলো?? ফোন অপারেট করতে জানা নেই নাকি?? তোলো তাড়াতাড়ি।" আমি বললাম "কত দাবি লোকজনের। এরপর আমার ও একটা তুলে দিতে হবে, আমিও হ্যাশট্যাগ দেব"। সে বললো "ঠিক আছে"। যে ভাবে বেশ ঘোরা হলো, ফুচকা, চাউমিন, কোল্ড ড্রিংকস খাওয়া হলো। আমি হটাৎ বললাম "একটা সেলফি হবে নাকি??" সে কি ভাবে যেন একটা তাকালো, বললো "হ্যাঁ!! অবশ্যই, নইলে হ্যাশট্যাগ কি করে লাগবে বলো!!" আমি বললাম "বাহঃ নিজের বেলায় দোষ নেই বুঝি" সে বললো "অতো বকে লাভ নেই, ক্লিক টা করুন"।
এই একটা ফটো আমি আমার ফোনে তুলেছি, বাকি সব ওর ফোনে। রাতে বাড়ি ঢোকার সময় বললাম "Whatsapp number টা পাওয়া যাবে??" সে বলল "কেন??" আমি বললাম "পিং করতাম, তাহলে আজকের সব ছবি গুলো পাঠিয়ে দিতে"। বললো "ঠিক আছে সেভ করো" নাম্বার বলে চলে গেল। আমার কেন জানিনা আরো একবার ডাকতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু কি ভেবে ডাকবো সেটা ভাবছিলাম, তারপর বললাম "এই যে ম্যাডাম স্যাপনেলিকলিকে ছবি গুলো doc file করে পাঠাবেন" সে বললো "কি!! কি নাম বললো!! বলে কিছু একটা স্টার হ্যাস দিয়ে বলল মনে হলো" বলে চলে গেল।
সেদিন রাতে যেন আমার ঘুম আসছে না, আমি সেভ করার সাথে সাথেই পিং করেছিলাম, রাত ৩যে, দেখলাম ৬৭ টা ইমেজ ফাইল ঢুকলো, আমি রিপ্লাই করলাম "আমি doc বলেছিলাম" রিপ্লাই এলো "ল্যাদ লাগছে", আমি ভাবলাম "অতো বুঝিনা, নইলে কাল ফোনের মধ্যে ডাল ঢেলে দেব" রিপ্লাই এলো "আচ্ছা জ্বালাতনের লোক তো আপনি মশাই" তারপর ৬৭ টা doc file ঢুকলো। এরপর আগের ওর রিপ্লাই টা ও নিজে মেনশন করে লিখলো "But I like it" । আমি একগাদা হাসির ইমজি পাঠিয়ে দিলাম। গল্প করতে করতেই সে রাত কেটে গেল।
পরদিন সকালে দুজনেই ঢুলতে ঢুলতে নাট মন্দির পৌছালাম, আমায় বাবা হেব্বি ঝাড়লো, সেটা দেখিয়ে আরেকজনের দাঁতে গরম লেগে গেলো ভীষণ তাই বত্রিশ পাটি আর ঘরে ঢোকাতে পারছে না, ঘুম ও কেটে গেল। আমিও ওনার মতো দু একটা স্টার হ্যাস ঝেড়ে দিলাম। সেদিন বিকেলে আমরা বাড়ির পেছনে বসে আছি, সে হটাৎ ফোনে "হটাৎ দেখা" কবিতা টা চালালো, বললো এটা ওর খুব প্রিয় কবিতা। আমি বললাম আমার ও এটা ভালো লাগে। ও বললো "আমাদের দেখা টাও অনেকটা হটাৎ দেখা।" আমি হেসে ফেললাম। উঠে যাওয়ায় সময় বললো "আরো একবছরের অপেক্ষা" , আমি বললাম "মানে??" বললো "কিছুনা"। বিকেলে আমি বন্ধু দের সাথে বেরিয়ে ছিলাম, রাতে ঘরে এসে শুনলাম ওরা চলে গেছে, ওর বাবার কিছু ইম্পরট্যান্ট কল এসেছিল। মন খারাপ হয়ে গেল, আমি ওর নাম্বারে কল করলাম, শুনলাম "আপনার দ্বারা ডায়াল করা নম্বর বর্তমানে পরিষেবা সীমার বাইরে"। আমার মনে যেন দশমী আসার আগেই দশমী চলে এলো।
পরদিন সবার সাথে মিলে দশমীর আয়োজন করলছিলাম, তবু কোথায় যেন একটা শূন্যতা কাজ করছিল। প্রত্যেক বছর যেখানে আমি প্রায় মা র সাথে ঝামেলা করে ধুনুচি নাচি, সেখানে এবারে যেন কোনো ইচ্ছেই নেই। আমি ঐ সবার সাথে থাকতে হয়, ওই ভাবেই থেকেছি। ভাসান থেকে ফিরে এসে আবার ডায়াল করলাম, কয়েক বার কুক কুক শব্দ হয়ে কেটে গেল।
পেছনে দিদি ঘরে গান চালিয়েছে-
".....ফিরে গেছে কত বোবা টানেলের গলা চিরে আলো ইচ্ছেরা ছুটে চলে,
সারাটা দিন জুড়ে তুমি আনাগোনা করেছ সেই সুরে তার রঙ লেগে আছে....."