কমরেড
কমরেড
মিনু মামা কে প্রথম দেখেছিলাম রাঙু মামার ছেলের বিয়েতে। ভাল নাম মৃন্ময়। মা নিয়ে গিয়ে আলাপ করে দিয়েছিল। রোগা জীর্ণ চেহারা, টিকালো নাক, মুখে পুরু গোঁফ, গালে পাকা দাড়ি, মাথায় কাটা দাগ, চশমার একটা পাল্লা ভাঙ্গা। কিন্তু মুখে একটা অমায়িক হাসি। সেদিন আলাপ করে চলে এসেছিলাম, কিন্তু সেই শিশু মনে জরাজীর্ণ চেহারার লোকটার প্রতি কোনো শ্রদ্ধা জন্মায়নি। প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম মিনু মামকে। বাবা হটাৎ এক রোববার বাজার ফেরৎ নিয়ে এল মিনু মামাকে। মা দেখে খুশী হলেও পরে আড়ালে বাবার ওপর কপট রাগ করেছিল। তার কারন মিনু মামা ওরফে মৃন্ময় লাহিড়ী এক কালের দাপুটে নকশাল। সেই প্রথম মিনু মামাকে চিনতে পারে কাছে থেকে। মিনু মামার কাছে নকশাল আমলের গল্প শোনা। সে হাওড়ার বাড়িতে পুলিশের তাড়া খাওয়া হোক, বা ময়দানে বন্ধুকে পুলিশের গুলি খাওয়া থেকে বাঁচানো। কেমন ভাবে পরের দিকে কিছু কমরেড পাল্টি খেয়ে সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আজ সোনার সিংহাসনে চড়েছে সে গল্প। সেদিন মিনু মামা "মোটরসাইকেল ডাইরিজ" এর একটা ছোট তেল চিটচিটে সংস্করণ দিয়েছিল। আর বলেছিল "বিপ্লবকে জাগিয়ে তুলতে হবে রে বিশু"। বইটাতে একটা রংচটা কাগজে এই কবিতাটি ছিল।
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।
মৃত্যুর ভয় পাইনা,
না আছে অকালমৃত্যুর শোক,
ধর্ম, জাতি, বর্ণ ভুলে,
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।
মাঠে চাষ ফেরত চাষী,
যে পায়না তার প্রতিভার দাম,
তার দুঃখে কাঁদে বিচারের বাণী,
কণ্ঠরোধে ব্যস্ত গণতন্ত্রের গাঁড় লাল খাম,
বিফল এ স্বাধীনতা,
এ গণতন্ত্র না জোক?
সব বাঁধা, আঁধার কাটিয়ে,
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।
এর পর অনেকদিন মিনু মামাকে দেখিনি। কয়েক বছর আগে অফিস যাচ্ছি বাসে চেপে। কানের পাশে কে যেন ফিসফিস করে বলল "কিরে বিশু অফিস যাচ্ছিস?"। ঘুরে তাকাতে দেখি মিনু মামা দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে। ঠিক এমন ভাবেই রাস্তায় কারো সাথে কথা বলতো মিনু মামা। ফিসফিস করে। বাবা একবার অফিস যাওয়ার সময় পার্ক স্ট্রিটে একজনকে কানের সামনে বলতে শুনেছিল, "রমা কে বোলো আজ রাতে খাব। কচি পাঁঠা নিয়ে এসো"। বাবা ঘুরে তাকাতেই দেখেছিল মিনু মামা রাস্তা পার করে চলে যাচ্ছে।
- আমি বললাম "মিনু মামা কোথায় যাচ্ছ?"
- "সরকার আজ ডেকেছে রে। নকশাল আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে থাকা লোকেদের সংবর্ধনা দেবে।"
- "কিন্তু তুমি যে বলেছিলে সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য নেবে না?"। কথাটা শুনে মিচকি হাসলো মিনু মামা।
- "খালি পেটে কি আর বিপ্লব হয় রে। পকেট একদম ফাঁকা। বিপ্লব দিয়ে কি হেঁসেল চলে। আমার স্টপেজ এসেগেছে রে। চলি"। এই বলে এক দৌড় মেরে বাস থেকে নামল মিনু মামা আর ঠিক তখন পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে মিনু মামাকে ধাক্কা মারল। মিনু মামা ছিটকে গিয়ে এক বাতিস্তম্ভের নীচে পড়ল।
কয়েকটা লোক দৌড়ে গেল মিনু মামার দিকে। কেউ জল দিচ্ছে, কেউ হওয়া বাতাস, কেউ এ্যাম্বুলেন্স ডাকার তোড়জোর করছে। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। একজন মিনু মামাকে প্রশ্ন করল দাদা আপনার নাম কি? আপনার বাড়ি কোথায়? এই শেষ প্রশ্নটা আমিও মিনু মামাকে করেছি, মিনু মামা তোমার বাড়ি কোথায়? কোনোদিন আমায় উত্তর দেয়নি। আজ উত্তর দিল।
"আমার বাড়ি, তোমার বাড়ি,
নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি"।
ওটাই মিনু মামার শেষ কথা ছিল। যেই বাতিস্তম্ভের নীচে মিনু মামা পড়েছিল সেই বাতিস্তম্বে ব্যানার লাগানো, "কোলকাতার সবচেয়ে বড় বাড়ি আপনার হাতের মুঠোয়"।
বিড়বিড় করে বললাম "সরকারের কাছ থেকে তাহলে সাহায্যে নিতে হল না।" মিনু মামার সেই কথাটা মনে পড়ে গেল, "বিপ্লবকে জাগিয়ে তুলতে হবে রে বিশু"। পেছন ফিরে দেখলাম সেই গাড়িটা যাতে মিনু মামা ধাক্কা খেয়েছিল। কোনো স্বর্গীয় প্রাক্তন মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে গাড়ির গায়ে লেখা "কমরেড তুমি ঘুমাও, আমরা জেগে আছি। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।"