Bhaskar Choudhury

Drama

3  

Bhaskar Choudhury

Drama

একটা চার, একটি চুমু।

একটা চার, একটি চুমু।

5 mins
17.7K


- "হ্যাঁ স্যার, আমি দিবাকর বলছিলাম আপনি কি বাড়ি আছেন? আমি আসলে এই দিকে একটু এসেছি, আপনারই পাশের কমপ্লেক্সে।"

- "না, কেন বলুন তো?"

- "ওই এবারের প্রিমিয়ামটা বাকি ছিল। কয়েকটা নতুন পলিসির ব্যাপারেও কিছু বলবার ছিল।"

- "ওঃ। আমি আসলে একটু সিটি সেন্টারে এসেছি, আর মিনিট ২০ লাগবে এখান থেকে বেরোতে।"

- "আচ্ছা, আমি তাহলে আপনাদের কমপ্লেক্সের বাইরের চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছি।"

-"ওকে"।

সুকুমার বাবু বেশ মালদার লোক। রাজারহাটের এক বিলাসবহুল আবাসনে থাকেন। নিউটাউনে দুহাজার বর্গক্ষেত্র জুড়ে নিজের অফিস। আজ আদেও তার পাশের কোনো আবাসনে আসিনি। এসেছি তাঁরই কাছে। উদ্দেশ্য প্রিমিয়াম ছাড়াও তার কাছ থেকে আরো নতুন কিছু পলিসি করানো। তাই অফিসে না গিয়ে সোজা তার বাড়িতে আসা। শনিবার সুকুমার বাবু বাড়িতেই থাকেন। বসলাম তার প্রকান্ড আবাসনের পাশের চায়ের দোকানে, আব্দুলদার চায়ের দোকান। চা খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখটা বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। খেলার পাতায় ছোট্ট একটা খবরে চোখটা আটকে গেল। খবরটা পড়তেই সিনেমার মতো মন চলে গেল ফ্ল্যাশব্যাকে।

আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগের ঘটনা। দিনটা ছিল রবিবার, জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ, শীতের পরশ আর কম্বলের ওম একে অপরকে জড়িয়ে ছিল। সকালে ঘুম ভেঙেছিল ধবধবে সাদা লুচি আর কুচিকুচি করে কাটা আলুর চচ্চড়ির গন্ধে। দুপুর বেলা ছিল ভারত এবং পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা।ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপের তৃতীয় ফাইনাল। পরিস্কার মনে আছে দুপুরে খাসীর মাংস সমৃদ্ধ ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেয়ে খেলা দেখতে বসে গেছিলাম। পাকিস্তান প্রথমে ব্যাট করতে নামে এবং নেমেই ভারতের তখনকার দিনের প্রধান শত্রু সঈদ আনওয়ার এমন চার ছয় মেরেছিল যে শ্রীনাথ, হারভিন্দর সিংহদের মাঠে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। শেষমেশ আনওয়ার এবং ইজাজ আহমেদের জোড়া শতরানের দৌলতে পাকিস্তান ৩১৪ রানের পাহাড় খাড়া করে। তখনকার দিনে ৩০০ তারা করে জেতা সহজ ছিলনা। সবাই প্রায় ধরেই নিয়েছিল যে ভারত হারবে। খেলাটা দেখতে পাড়ার অনেকেই এসেছিল আমাদের বাড়িতে। কুমার, শিবু, ফটিক, সীমা, দামু কাকা এবং অবশ্যই আমাদের পাশের বাড়ির মেয়ে কল্পনা। তখন আমি ক্লাস নাইনে, সবে সবে গোঁফ উঠছে। পড়াশোনা লাটে উঠছে এবং কল্পনার জন্য প্রেম উঠলে উঠছে। কল্পনাকে দেখলেই হ্যান্ডেল ছাড়া সাইকেল চালানো, খেলার মাঠে অকারণে ঝাঁপিয়ে পড়ে বল আটকানো, আজহার এর মত জামার কলার তুলে ব্যাট করতে নামা, হেঁড়ে গলায় কুমার শানুকে নকল করে "চ্যায়েন চুরায়া মেরা, কিসনে ও সানাম তুনে" গাওয়া এই সব কান্ডকারখানা সব চলত। আর তা দেখে কল্পনার কি হাসি। কল্পনার জন্য একটা প্রেমপত্র ও লিখেছিলাম। দু-লাইন কবিতা ও ছিল তাতে।

"আমার শিরা বয়ে,গেছে যে আলপনা,

সে প্রথম প্রেম আমার কল্পনা"।

সেদিন যখন ভারতীয় বোলারদের গণধোলাই চলছিল তখন কল্পনা ফোড়ন কেটে বলছিল, "কি রে বিশু, আজ মনেহয় তোকে নামতে হবে মাঠে ভারতকে জেতানোর জন্য"। তা শুনে বাকি সবার কি হাসি।

ভারত শুরু করেছিল ঝড়ের গতিতে। সচিন, সৌরভের মার দিয়ে। কিন্তু মারতে গিয়ে সচিন আউট হয়ে যায় আফ্রিদির বলে। রবিন সিং এবং সৌরভ যদিও মার থামায়নি। আস্তে আস্তে যারা ভেবেছিল যে ভারত হারবে, তারা আবার গলা চড়াতে শুরু করল। কিন্তু গোলযোগ বাড়ল রবিন সিং আউট হওয়ার পর।ততক্ষণে সৌরভের শতরান হয়ে গেছে। কিন্তু পর পর আজহার, সৌরভ ও সিধুর উইকেট পড়ে যাওয়ায় ভারত চাপে পড়ে যায়। সঙ্গে আমিও। চাপ কাটাতে সদ্য শেখা সিগারেট খাওয়ার জন্য ছাদে উঠে গেলাম। দেখি পাশের ছাদে কল্পনা দাঁড়িয়ে। আমি মুখ ঘুরিয়ে রইলাম। কল্পনা আমাদের ছাদে এসে মান ভাঙানোর সুরে বলল, "কি রে ব্রায়ান লারা রাগ করেছিস।" পাড়ায় তখন সবাই আমায় ব্রায়ান লারা বলে ডাকত বা হাতে ব্যাট করতাম বলে। আমি রাগের স্বরে বললাম,

- "তুই তখন আমায় সবার সামনে ওরম বললি কেন?"

- "কেন বিশু সোনা তোমার রাগ হয়েছে নাকি?"

- "না। ছাড় তোর সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।"

- "আচ্ছা বাবা রাগ করে না। ওই দেখ আরেকটা উইকেট পড়ে।"

আমাদের ছাদ থেকে পাড়ার ক্লাবের টিভিটা দিব্বি দেখা যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে আরো দুটো উইকেট পড়ে গেছিল, জাদেজা এবং মোঙ্গিয়ার। শেষ ওভারে দরকার ছিল ৯ রান। ক্রিজে তখন শ্রীনাথ এবং নবাগত হৃষিকেশ কানিতকার। বল হাতে দুসরার আবিষ্কারক সাকলাইন মুশতাক। আমি বললাম কল্পনাকে, "এই কানিতকার ছেলেটা ভালো খেলে। এই জেতাবে দেখিস।" কল্পনা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল, "তোর কথা সত্যি হলে তোকে একটা চুমু খাব"। দু বলে তিন রান বাকি। সাকলাইন বল করতে দৌড়োল, ব্যাট হাতে তখন কানিতকার। একদিকে ভারত এর ভবিষ্যৎ অন্য দিকে আমার চুমুর ভবিষ্যৎ, ঠিক এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠল.......।

আমি আব্দুলদার চায়ের দোকানে বসে, সুকুমার বাবু ফোন করছেন।

-"হ্যালো দিবাকর, আমি বাড়ি চলে এসেছি। তুমি আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো"। "আচ্ছা", বলে চায়ের দোকানের দাম মিটিয়ে সুকুমার বাবুর আবাসনে ঢুকলাম। সুকুমার বাবুর ফ্ল্যাট চার তলায়, লিফ্ট এ উঠে দরজায় বেল বাজালাম। সুকুমার বাবুই দরজা খুললেন।

- "কেমন আছেন?"

- "এই চলে যাচ্ছে।"

- "সিটি সেন্টারে কি সিনেমা দেখতে যাওয়া?"

- "হ্যাঁ ঠিক। আজ আসলে আমাদের বিবাহবার্ষিকী, তাই একটু সিনেমা দেখা, খাওয়া আর কি। এই শুনছ দিবাকর এসেছে, একটু চা বানিয়ে দাও না।" এই বলে সুকুমার বাবু ঘরের ভেতরে গেলেন।

সুকুমার বাবুর ফ্ল্যাটে এর আগে কোনোদিন আসা হয়নি। বেশ ভালোই সাজিয়েছেন। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আস পাশ দেখতে গিয়ে একটা জায়গায় আটকে গেলাম। দেয়ালে একটা সিঁদুর দানের ছবি। সুকুমার বাবু সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছেন তার স্ত্রীকে। এবং সেটি হল কল্পনা। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ খুলে সুকুমার বাবুর কাগজপত্র গুলো উল্টে পাল্টে দেখতে থাকলাম। ইন্স্যুরেন্সের কাগজে বউএর নাম লেখা আছে কল্পনা গুপ্ত।

১৭ বছর আগের সেই সন্ধ্যেবেলা হৃষিকেশ কানিতকার ভয়কে জয় করে চাপের মুখে অসাধারণ একটি চার মেরে ভারতকে জিতিয়েছিলো। পুরো পাড়া উৎসবে মেতে উঠেছিল আর আমাদের ছাদে কল্পনা আমাকে চুমু খেয়েছিল।

১৭ বছর পর সুকুমার বাবু তার ড্রইংরুমে এসে আর আমায় দেখতে পাননি। পেয়েছিলেন খালি একটি বাংলা খবরের কাগজ যার খেলার পাতায় একটি ছয় লাইনের খবর ছেপেছিল,

"জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন হৃষিকেশ কানিতকার। ভারতের হয়ে ২ তো টেস্ট এবং ৩৪টি একদিবসীয় ম্যাচ খেলা কানিতকারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত ছিল, শেষ ওভারে চার মেরে ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইনডেপেন্ডেন্স কাপ জেতানো"।

সেই চার যার জন্য কল্পনা আমায় চুমু খেয়েছিল, সেই একটা চার ও একটি চুমু দুটোই আজ ইতিহাস। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে নাকি একলা চলতে হয়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama