Siddhartha Singha

Romance

3  

Siddhartha Singha

Romance

কলহ

কলহ

6 mins
657


গ্রামের মাতব্বররা এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। এ কী বলছে ওরা!

ওরা মানে টগর আর মাটি। বিয়ে হয়েছে ছ'মাসও কাটেনি। দু'বাড়ি থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর দিনই ওদের অমন খোলামেলা কথাবার্তা শুনে কারও কারও ভ্রু কুঁচকেছিল। দু'-একজন জানতেও চেয়েছিল, তোমাদের কি প্রেম করে বিয়ে?

টগর হেসেছিল। উত্তর নয়, মাটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল উল্টো--- বিয়ে কি আবার ঝগড়া করে হয় নাকি? হানিমুন সেরে আসার পর প্রথম ক'টা দিন সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু মাস গড়াতে না-গড়াতেই শুরু হল সমস্যা। টগর হাড়ে হাড়ে টের পেল, এ রকম স্বামীর সঙ্গে ঘর করা যায় না। মাটির চোখেও ঘুম নেই। এমন একটা বউয়ের সঙ্গে বাকি জীবন কাটাতে হবে, ভাবতে গিয়েই তার গায়ে যেন জ্বর এল।

দ্বিতীয় মাসের শুরুতেই একদিন এমন কথা-কাটাকাটি হল যে, মাটি কাজে বেরিয়ে যেতেই টগরও ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে রওনা হল কলকাতা। কলকাতা মানে কৃষ্ণনগর। বাপের বাড়ি। কৃষ্ণনগর থেকে আশি কিলোমিটার দূরের বাংলাদেশের বর্ডার লাগোয়া করিমপুরের লোকেরা কৃষ্ণনগরকে কলকাতাই বলে।

শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে চলে এসেছে শুনে মা বাবার মাথায় হাত। তিলজলা থেকে ছুটে এল টগরের বরদা। উস্তি থেকে মেজদি। কাঁচরাপাড়া থেকে ছোড়দা। সবাই কত করে বোঝাল, কিন্তু ওর সেই এক কথা, না। ও বাড়িতে আমি আর কিছুতেই যাব না।

--- কিন্তু কেন? কী হয়েছে বল? ওর কি কারও সঙ্গে কিছু আছে? কিছু টের পেয়েছিস? একটার পর একটা প্রশ্ন। অথচ টগর নিশ্চুপ।

 মাটির বাড়িতেও হাজার প্রশ্ন। হ্যাঁ রে, তোর বউ সেই যে গেল, গেল তো গেলই, আসার আর নামগন্ধ নেই। কী ব্যাপার? ও কি আসবে না? বন্ধুরা বলে, তুই কী রে? বিয়ে হতে না-হতেই বউটাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিস, ওরা কি ভাববে বল তো?

দু'বাড়ি থেকেই নানা কথা উঠছিল। তার হাত থেকে রেহাই পেতেই টগর একদিন তার দাদাদের জানিয়ে দিল, তার পক্ষে ওর সঙ্গে ঘর করা সম্ভব নয়। সে ডিভোর্স চায়। সবাই অবাক। এই তো সবে বিয়ে হল। এর মধ্যেই এই! আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ফিসফাস, ফোনাফুনি। মুখে মুখে সে খবর এসে পৌঁছল মাটিদের বাড়ি। সে কথা শুনে মাটি বলল, আমিও ওর সঙ্গে আর ঘর করতে চাই না।

এ বোঝায়। ও বোঝায়। সে বোঝায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! অবশেষে টগরের দাদারা যখন দেখল, আর কোনও উপায় নেই, তখন বোনকে বলল, তা হলে উকিলের সঙ্গে আমরা কথা বলি? টগর বলল, না। কোর্ট-কাছারি নয়। আমি মিউচুয়াল ডিভোর্স চাই।


মাটিও তাই চায়। কিন্তু মিউচুয়াল ডিভোর্স হলেও দু'পক্ষেরই কিছু লোক থাকা দরকার। যতই আইন হোক, পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠুক থানা, তবু এখনও শহরতলি এবং গ্রামের দিকের ক্লাবগুলোতে মাঝে মাঝেই বিচারসভা বসে। সেখানে জমিজমার বিবাদ থেকে গাছের পেয়ারা চুরি, কার বাচ্চাকে কোন বাচ্চা প্রথম মেরেছে, থেকে কারা পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করেছে, এমনকী পারিবারিক কলহ--- সব কিছুরই বিচার করা হয়। বিচার করেন এলাকার কিছু মাতব্বর গোছের লোক।

ওদের এই ডিভোর্স নিয়েও বিচারসভা বসল করিমপুরে। টগরের দাদাদের উদ্যোগে সেখানে হাজির হলেন কৃষ্ণনগরের কয়েক জন মাথা। দু'পক্ষের লোকেরাই জেনে গিয়েছিলেন, ওরা কেউই কারও সঙ্গে ঘর করতে চায় না। কিন্তু বউয়ের যদি কোনও আর্থিক সংস্থান না থাকে, তা হলে তার চলবে কী করে? তাই বোনের দায়িত্ব যাতে তাদের ঘাড়ে এসে না পাড়ে, সে জন্য মেয়ের দাদারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, তাদের পক্ষের লোকদের আগেই বলে দিয়েছিল, ভরণপোষণের টাকা মাসে মাসে নয়--- মাসে মাসে দেওয়ার কথা হলে নাকি প্রথম কয়েক মাস দিয়েই ছেলেরা টাকা বন্ধ করে দেয়। তখন আবার সেই থানা-পুলিশ কোর্ট-কাচারি। আপনারা বরং, এককালীন খোরপোশ আদায় করে দিন এবং সেটা যেন দশ-বারো লাখ টাকার কম না হয়।

মাতব্বররা বললেন, দশ-বারো লাখ টাকা চাইলেই তো আর দশ-বারো লাখ দেবে না। দরাদরি করবে। আমরা বরং প্রথমেই পনেরো লাখ বলি? 

সেই মতো মাটির কাছে খোরপোশ বাবদ পনেরো লাখ টাকা দাবি করতেই বিস্ফারিত চোখে তাকাল টগর। বলল, আমি তো টাকা চাইনি। ডিভোর্স চেয়েছি। কিন্তু টগর সেই কথা এত আস্তে আস্তে বলল যে, সে কথা কারও কানে গিয়েই পৌঁছল না।

--- পনেরো লাখ? পনেরো লাখ টাকায় ওর হবে? ব্যাঙ্কে রাখলে মাসে ক'টাকা ইন্টারেস্ট পাবে? তাতে ওর চলবে? দিন দিন জিনিসপত্রের যা দাম বাড়ছে, একটা মানুষের খেয়ে-পরে ভাল ভাবে থাকতে গেলে ওই টাকায় কিচ্ছু হবে না। পনেরো লাখ নয়, আমি ওকে পঁচিশ লাখ দেব।

--- না। আমি কোনও টাকা চাই না। এ বার আর আস্তে নয়, বেশ জোরের সঙ্গেই বলল টগর। বড়দি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা স্বরে বলল, বোকার মতো কথা বলিস না। তোর কোনও ভবিষ্যৎ নেই? ও যখন নিজে থেকেই দিতে চাইছে, তোর অসুবিধে কোথায়?

--- অসুবিধে আছে। কারণ, আমি জানি, আমাকে পঁচিশ লাখ টাকা দিতে গেলে ওর শুধু ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙালেই হবে না, আমার বিয়ের আগে গোপালপুরে যে তিন কাঠা ছ'ছটাক জমি ও কিনেছিল, সেটাও ওকে বিক্রি করতে হবে। তাতেও কি পঁচিশ লাখ হবে? ওকে অফিস থেকে লোন নিতে হবে। আমি চাই না, ও সর্বস্বান্ত হোক।

টগর আর মাটির কথা শুনে দু'পক্ষের লোকেরাই এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন।

করিমপুরের এক মাতব্বর টগরকে বললেন, তোমার যখন ওর প্রতি এতই দরদ, তা হলে ডিভোর্স চাইছ কেন?

টগর বলল, ওর সঙ্গে সংসার করা যায় না, তাই।

--- কেন যায় না?

প্রশ্ন শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়ল টগর--- জানেন, ও কোনও কথা শোনে না। এত সুন্দর হয়েছে, ডাক্তার বলেছেন, রোজ সকালে অন্তত ঘণ্টাখানেক করে হাঁটতে। অথচ যতই ডাকি না কেন, ও কিছুতেই সকালে ওঠে না।

--- কেন, আমি উঠি না? টগরের চোখের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল মাটি।

--- আমি কি বলেছি, ওঠোনি? উঠেছ। গুনে গুনে দু'দিন। উঠে কী করেছ?হেঁটেছ? আমি ঠেলে বাইরে বের করে দিয়েছি। খানিক পরে বেরিয়ে দেখি, ও দিকের শিমুল গাছটার তলায়, গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বাবু ঘুমোচ্ছেন...

--- হ্যাঁ, ঘুমোছিলাম। কারণ, আমার ঘুম পেয়েছিল, তাই। আর তুমি কী করেছ? আমি পইপই করে বলেছিলাম, তুমি রোজ বারোটার মধ্যে খেয়ে নেবে। না হলে শরীর খারাপ হবে। কিন্তু কোনও দিন দুটো-আড়াইটের আগে তুমি খেয়েছ?

মাথা নিচু করে নরম গলায় টগর বলল, কাজ থাকলে কী করবে...

--- না, করবে না। দরকার হলে ফেলে রাখবে। আমি এসে করব। কিন্তু তুমি যদি অসুস্থ হও, কে দেখবে?

--- তোমাকে দেখতে হবে না।

--- আমাকে দেখতে হবে না মানে? আলবাত দেখতে হবে। আমি তোমার স্বামী।

--- তুমিও ভুলে যেয়ো না, আমি তোমার বউ। তোমাকে যা বলব, তা-ই করতে হবে। সকালে হাঁটতে হবে। ডাক্তার যে ওষুধ খেতে বলেছেন, নিয়ম করে খেতে হবে। প্রতি দু'মাস অন্তর নিয়মিত পি পি আর ফাস্টিং করাতে হবে।

--- আমি কি করব না বলেছি?

--- সে তো মুখে বলছ। করো কি?

--- করি তো।

--- করো? আবার মিথ্যা কথা? আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়ব না।

--- আমার কথা না শুনলে আমিও তোমাকে ছাড়ব না।

বিচারসভায় বাদী-বিবাদীরা কোথায় চুপচাপ থাকবে। মাতব্বররা যে প্রশ্ন করবে, কেবল তার উত্তর দেবে। তা নয়, ওরা রীতিমত ঝগড়া শুরু করে দিল। বিচারকরা চুপচাপ। এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

হঠাৎ এক মাতব্বর বলে উঠলেন, কে তোমাদের ছাড়তে বলেছে? আমরা বুঝে গেছি, তোমাদের জোর করে ছাড়লেও তোমরা আলাদা হওয়ার নও। যে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের মঙ্গলের জন্য ডিভোর্স পর্যন্ত চাইতে পারে, তারাই তো প্রকৃত জুটি। আমরা চাইব, তোমরা দু'জন অন্তত কয়েক দিনের জন্য কোথাও থেকে একটু ঘুরে এসো।

টগরের দাদা বলল, এটা আপনারা মন্দ বলেননি। মকাইমারা ফরেস্টটা খুব ভাল। আমরা গতবার ওখানে গিয়েছিলাম। বললে, আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

টগর বলল, না। ফরেস্টে না। আমি পাহাড়ে যাব।

মাটি বলল, পাহাড়টাহাড়ে নয়, সমুদ্রে।

টগর বলল, না, পাহাড়ে।

মাটি বলল, বললাম তো সমুদ্রে।

টগর বলল, না। তোমার ঠাণ্ডার ধাত আছে। একটু জলে নামলেই খুব ভোগো। তা ছাড়া আমি জানি, তুমি পাহাড় খুব ভালবাসো। আমি পাহাড়েই যাব। পাহাড়ে।

--- না, পাহাড়ে না। আমি জানি, উঁচুতে উঠলেই তোমার বুক ধড়ফড় করে। আর তা ছাড়া, সমুদ্র তোমার সব চেয়ে প্রিয় জায়গা। আমি সমুদ্র যাব।

টগর বলল, পাহাড়ে। মাটি ফের বলল, সমুদ্রে।

--- না, পাহাড়ে।

--- না, সমুদ্রে।

--- না, পাহাড়ে।

--- না, সমুদ্রে।

দু'জনের মধ্যে আবার শুরু হল চাপানউতোর কিন্তু ওদের কলহের মধ্যে কেউ আর মাথা গলাল না। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance