ক্লাউড নাইন
ক্লাউড নাইন
দার্জিলিং-এর চূড়ায় ‘ক্লাউড নাইন’ অবজার্ভেটরি। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ। আয়ানের জীবনের প্রথম বদলি।
টয় ট্রেন থেকে নামতেই তার নাক ভরে গেল চা-বাগানের ভেজা মাটির গন্ধে। পায়ের তলায় পিচ্ছিল পাথর, মাথার ওপর কাঞ্চনজঙ্ঘা লুকিয়ে আছে মেঘের পর্দায়।
ক্লিনিকের সামনে শ্রেয়া দাঁড়িয়ে। সাদা কোটের ওপর একটা নীল কার্ডিগান, হাতে ছেঁড়া ছাতা। চুলে লাল রিবন, যেন বৃষ্টির মাঝে এক টুকরো রোদ।
“আপনিই নতুন মেঘ-ম্যান?”
“আর আপনি?”
“আমি এখানকার একমাত্র নার্স। নাম শ্রেয়া। জ্বর সরাই, কাশি সরাই, আর মেঘের নীচে মরতে আসা লোকদের হাসি ফেরাই।”
তার হাসির মাঝে সে খক খক করে কাস্তে লাগলো মুখ ফিরিয়ে । আয়ান দেখল "ঠান্ডা লেগেছে হয়তো।"
প্রথম রাত। আয়ানের ঘরে একটা পুরনো রেইন-গেজ, একটা লাল লেদারের নোটবুক, আর একটা ভাঙা রেডিও। বাইরে বৃষ্টি ঝমঝম। সে খাতায় লিখল:
Daily Weather Log – 03 July
Rainfall: 64 mm
Wind: Whispering her name already
পরদিন সকালে শ্রেয়া এল চায়ের ফ্লাস্ক হাতে।
“চা না হলে মেঘ নামে না।”
তার হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট—মোমো। ভাপ বেরোচ্ছে।
“এখানে খাবার মানে স্মৃতি। একবার খেলে ভুলতে পারবেন না।”
আয়ান প্রথম মোমো মুখে দিতেই চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ঝাল, গরম, আর একটা অদ্ভুত মিষ্টি মত স্বাদ, সমতলে ঠিক অমন থাকে না।
“এটা কী দিয়ে বানানো গো?”
“আমার মায়ের রেসিপি। সাথে কিছুটা ভালোবাসা।”
দ্বিতীয় সপ্তাহ। বৃষ্টি থামে না। আয়ানের ছাদে একটা লাল ঝান্ডা ওড়ে—ঝড়ের সিগন্যাল।
শ্রেয়া প্রতি সন্ধ্যায় আসে। তার সঙ্গে একটা পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ড—হেমন্ত।
“এই গান শুনলে মেঘ কান্না করে বসবে!”
তারা দুজনে বারান্দায় বসে। শ্রেয়ার হাতে একটা লাল উলের স্কার্ফ। সে বুনছে।
“কার জন্য?”
"যে থেকে যাবে সে জানতে পারবে।"
“মানে যে থেকে যায় তার জন্য।”
তৃতীয় সপ্তাহ। বিদ্যুৎ চলে গেল তিন দিনের জন্য। কালো অন্ধকার মেঘে ঢেকে আছে যেন পুরো পৃথিবী ! মোমবাতির আলোয় শ্রেয়া বলল কোনো সতর্কতা ছাড়াই,
“আমার ফুসফুসে ক্যান্সার। চতুর্থ স্টেজ। কলকাতায় বলেছে আর মাস পাঁচেক.....।”
আয়ানের হাত থেকে মোমবাতি পড়ে গেল। মেঝেতে আগুনের ফুলকি আর গোলে যাওয়া মোম।
“চলো নীচে নামি।”
“না। আমি এখানে মরতে চাই। যেখানে মেঘ আমার চুলে হাত বোলায়।”
সেদিন থেকে আয়ানের রিপোর্ট বদলে গেল:
Daily Weather Log – 17 July
Rainfall: 112 mm
Intensity: Shreya-level
Cloud cover: Her eyelashes when she blinks slow
চতুর্থ সপ্তাহ। তারা মলের কাছে একটা বেঞ্চ আবিষ্কার করল। বেঞ্চের পিছনে লেখা—‘যারা হারায়, তারা বসে’।
শ্রেয়া বলল, “আমার বাকি দিন একশো। গুনে দেখো।”
আয়ান গুনতে শুরু করল। প্রতিদিন একটা লাল ক্রস তার ক্যালেন্ডারে।
পঞ্চম সপ্তাহ। বৃষ্টি কমল। আকাশে একটু নীল। শ্রেয়ার শ্বাস ভারী হয়ে আসছে একটু একটু করে।
সে আয়ানের রেইন-গেজে একটা চিঠি রাখল:
“যখন বৃষ্টি থামবে, আমিও থামব। তুমি মেঘ হয়ে যেও। আমি চেষ্টা করব বৃষ্টি হতে।”
আয়ান চিঠি পড়ে চোখ গুলো ঝাপসা করে ফেললো। শ্রেয়া এসে তার চোখ মুছে দিল।
“কাঁদলে মেঘ কমে যায়।”
ষষ্ঠ সপ্তাহ। শ্রেয়া আর হাঁটতে পারে না। ক্লিনিকের বিছানায় শুয়ে সে জানলার দিকে তাকায়।
“আমার নামে একটা ঝড় রাখতে পারবে?”
আয়ান রেডিওতে বলল, “Cyclone Shreya approaching Darjeeling.”
ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন— “পাগল হয়েছ?”
আয়ান বলল, “হ্যাঁ। প্রেমে।”
সপ্তম সপ্তাহ। বৃষ্টি ফিরল। ঝমঝম।
শ্রেয়া জানলায় বসে হাত পাতে। “দেখো, আমি ঝরছি।”
আয়ান তার হাত ধরে। হাত ঠান্ডা।
অষ্টম সপ্তাহ। শ্রেয়ার চুল পড়তে শুরু করল। সে মাথায় লাল রিবন বাঁধে।
“এটা আমার শেষ ফ্যাশন।”
আয়ান তার মাথায় হাত রাখে। “তুমি এখনো সুন্দরতম।”
নবম সপ্তাহ। শ্রেয়া আর কথা বলে না। শুধু হাসে।
আয়ান তার কপালে চুমু খায়। “আমি তোমায় আটকে রাখব।”
“কীভাবে?”
“প্রতি ফোঁটা আমার হাতে ধরব।”
দ্বাদশ সপ্তাহ। একশোতম দিনের আগের রাত।
বৃষ্টি থেমে গেল। আকাশ পরিষ্কার। তারা দেখতে পেল।
শ্রেয়া বলল, “কাল সকালে আমি চলে যাব।”
আয়ান বলল, “আমি তোমায় যেতে দেব না।”
শ্রেয়া তার হাতে একটা লাল উলের স্কার্ফ গুঁজে দিল। “এটা পরে থেকো। ঠান্ডা লাগবে।”
একশোতম দিন।
সকাল ছ’টা। আয়ান ছুটল ক্লিনিকে।
শ্রেয়া শুয়ে। ঠোঁটে হাসি। চোখ বন্ধ। হাতে লাল রিবন।
বালিশের তলায় চিঠি:
“আয়ান,
এবার তুমি মেঘ। আমি বৃষ্টি।
প্রতি বর্ষায় আমি তোমার গালে পড়ব।
ভুলো না।
—শ্রেয়া”
আয়ান ফাইনাল রিপোর্ট লিখল:
Final Weather Log – Day 100
Rainfall: Complete
Visibility: Zero
Temperature: Her last breath, still warm
Note: Clouds still spell her name in Braille.
সে আর ফিরল না।
‘ক্লাউড নাইন’-এর ছাদে বসে থাকে। গলায় লাল স্কার্ফ।
প্রতি বর্ষায় মেঘ নামে।
প্রতি ফোঁটা তার গালে পড়ে।
সে চোখ বোজে।
যেন শ্রেয়া ফিসফিস করে,
“আমি এখানে।”
-NiR ✒️

