ঝোড়ো সন্ধ্যায়
ঝোড়ো সন্ধ্যায়
ইলেভেনে দুর্গাপুরের এক নাম করা কলেজে এডমিশন পেলো এলিনা মাধ্যমিকে ষ্টার মার্কস পাওয়ার কৃতিত্বে। ভারী মিষ্টি এই এলিনা। সবসময় হাসি খুশি ,সহজ ,সরল এবং সব থেকে বড়ো কথা ভীষণ ইমোশনাল। চোখের জল কখনো লুকিয়ে রাখতে শেখে নি সে। সেদিক থেকে দেখলে মনে হয় খুব সাহসী তার স্বভাব কারণ নিজের দুর্বলতা কে এলিনা কখনোই আড়াল করতে চায় না । ডানপিটে স্বভাব আর সহজ সরলতায় ভরা এলিনা খুব মনোযোগ সহকারে সাইন্স স্ট্রিম এ পড়াশুনা শুরু করলো। টুশন আর ক্লাস এ সারা টা দিন কেটে যায়। এইভাবেই চলতে থাকে সদ্য কিশোরীর রোজ নামচ।
আষাঢ়ের এক সন্ধ্যেবেলা টুশন শেষে ঝড়ের আভাস পেয়ে খুব জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে এলিনা ঘরে ফিরছিলো ,সে তখন ও টের পাই নি আজ তার মনের কোন এক অজানা ঝড় তার জীবনের গতিপথ হয়তো পাল্টাতে চলেছে।
ঝোড়ো হাওয়ায় রাস্তার বালি চোখে ঢুকে যেতে লাগলো। সে বেচারি সাইকেল এর ব্যালান্স সামলাতে না পেরে মারলো যেন কাকে সাইকেল এর ধাক্কা। ভয়ে ভয়ে চোখ ডলতে ডলতে দেখতে পেলো এক কৃষ্ণকায় ,সুদীর্ঘ যুবক। যেমন টিকালো নাক, তেমন মায়াবী চোখ সাথে মুক্তোর মতো হাসি। ধাক্কা খেয়েও কেউ এমন হাস্তে পারে জেনে খুব অবাক লাগলো। তারপর গম্ভীর গলায় প্রশ্ন " দেখে চালাতে পারো না ?"
না পারি না" বলতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু খুব জোর নিজেকে সংযত করে সেদিন নীরবে এলিনা বাড়ি ফিরলো । এর পরে তিন দিন কেটে গেলো। এই তিন দিনে এলিনা কেবল যেন এক অজানা ঘোরে আচ্ছন্ন । রাত দিন ভাবতে থাকে কে এই মানুষ যে আঘাত পেয়ে ও এতো অমলিন তার হাসি। সেদিন কেমন যেন তাকে মনে হয়েছিল এ মানুষ কে ভরসা করা যায়,বিশ্বাস করা যায়। প্রথম প্রেমে র আভাস এসেছিলো এমন ই এক আষাঢ়ের ঝোড়ো সন্ধ্যায় এলিনা র মনে। সে আভাস কি একটু ও টের পেয়েছিলো সেই দীর্ঘকায় যুবকের মন ?
এদিকে তিন দিন এ এলিনা খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে ,ছেলেটির নাম অয়ন ,পাড়ার ই ছেলে। কিন্তু আশ্চর্য্য আগে কখনো তো তাকে দেখে নি। দেখবেই বা কি ভাবে ? দশ ক্লাস অবধি মা বাবার কড়া শাসনে সে কতটুকুই বা বাইরের জগতে পা ফেলেছে ?এখন টুশন ,ক্লাস এর সুবাদে তার বাইরের গন্ডি অনেকটাই বেড়েছে। আজ কাল এলিনা পড়াশুনায় তেমন মন বসাতে পারছে না , খালি সেই ঝোড়ো সন্ধ্যের স্মৃতি তাকে যেন কোথায় হারিয়ে ফেলছে। এক অদম্য ইচ্ছে রোজ রোজ তার বুকে চেঁপে ধরছে , ধীরে ধীরে সে অস্থির হয়ে উঠছে ,যদি একটু তার দেখা পেতো। মনে মনে খুব রাগ হচ্ছে ,কিন্তু কার উপর ? এই ভাবে এক অদ্ভুত অস্থিরতার মধ্যে তাকে যেতে হচ্ছে দিনের পর দিন।
হঠাৎ একদিন এলিনা টুশন পড়তে যাওয়ার একই রাস্তায় অয়ন কে দেখে ফেলে। বুঝতে পারছে না সে দাঁড়াবে না সোজা চলে যাবে ? হয়তো চলে যেত কিন্তু সেই অমলিন হাসি তাকে যেতে দিলো কই ?
আজ তার উদ্ধত্য মন কোনো বাঁধ মানবে না । কথা সে বলবেই তার সাথে মনে মনে সে প্রায় ঠিক করে ফেললো ।কিন্তু কি বলবে ? খনিকে র মধ্যে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো "সেদিন লাগেনি তো ?" কোনো সম্বোধন ছাড়াই । উত্তর গম্ভীর কণ্ঠে "লেগেছে ,হজম করে নিয়েছি "।স্বভাবসিদ্ধ এলিনা হা হা করে হেসে উঠলো । এইভাবে শুরু তাদের প্রেমের প্রথম পর্ব.
অয়ন সম্পর্কে ধীরে ধীরে এলিনা জানতে পারে সে বি স সি , ১স্ট ইয়ার এর স্টুডেন্ট শহরের আর এক নাম করা কলেজে ।এলিনা তখন ও জানতো না অয়ন এর জীবনের এক অন্য সত্য । অয়ন , এলিনা ক্লাস এর , টুশন এর ফাঁকে ফাঁকে একটু আধটু কথা হয় কিন্তু অয়ন এর সব সত্যি টা সে জানে অনেক পরে ।
এইভাবে আস্তে আস্তে অয়ন ,এলিনা র সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে ।কিছুদিন বাদে এলিনা অনুভব করে কি যেন এক চাঁপা কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়ায় অয়ন তা সে সুকৌশলে এলিনা র কাছে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে । এলিনা এ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাবার সময় ও সাহস প্রথমে পায় নি । পড়াশুনার চাঁপ , ক্লাস এর চাঁপ ইত্যাদিতে সে সেভাবে আলোচনা বা মনের কথা প্রকাশ করানোর উপর কিছুটা নিরুত্তাপ ই ছিল । কিন্তু এক কালী পুজোর রাত এ সে আভাস পায় অয়ন ড্রিংক করে ,খানিকটা অসংলগ্ন অবস্থায় তাকে পুজো মণ্ডপে দেখে ।এলিনা র মনে এক শঙ্কা র দামামা বেঁজে উঠলো । তবে কি অয়ন এতো অল্প বয়সেই মদ্যপ ? কি কারণ তার ?
মন খারাপের দিন শুরু হয় এলিনা র ,মনে হয় স্বপ্ন নিছক স্বপ্ন ই হয় । কিন্তু সত্যি টা কি ? একি শুধুই বন্ধু দের সাথে সেলেব্রেশন মুড এ ড্রিংক করা না কি অন্য কিছু ? না কি হ্যাবিচুয়াল ড্রিংকার ?মাঝে মাঝে ভাবে এলিনা একদিন সত্যি টা অয়ন কে সে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু ভয় হয় যদি কিছু কঠিন সত্য বেরিয়ে আসে , আর তাতে যদি সম্পর্কের ইতি আসে ,এই ভেবে ভেবে এলিনা র পড়াশুনা প্রায় মাথায় উঠার জোগাড় । এহেন টানাপোড়েন এ এলিনা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করে ,আশানুরূপ রেজাল্ট তার হয় নি ।মেডিকেল , ইঞ্জিনিয়ারিং এ ও স্থান হলো না এলিনা র । যাদবপুর ইউনিভার্সিটি তে এডমিশন হলো ইকোনমিক্স এ । এলিনা র দুর্গাপুর ছেড়ে কলকাতা যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু.
অয়ন এর সাথে আজকাল যোগাযোগ কমেছে ,তবুও এলিনা কলকাতায় হোস্টেল এ যাওয়ার আগে অয়ন এর আসল কষ্ট টা নিশ্চয়ই জানবে কারণ সে অয়ন কে এখনো ভালবাসে .
আর দুদিন বাদে কলকাতা যাবে এলিনা ,তাই অয়ন এর সাথে দেখা করা টা জরুরি ,আর জরুরি তার মনের কষ্ট টা জানা, আজ সে কোনো ভাবেই অয়ন কে চুপ থাকতে দেবে না । বিকেল বেলা দুজনে দেখা করলো সেই জায়গায় যে জায়গায় প্রথম তাদের দেখা হয় । সংঘাত দিয়ে ভালোবাসা শুরু হয় । একথা সে কথা র মাঝে এলিনা অয়ন এর রোজ ড্রিংক করার কারণ জিজ্ঞেস করে এবং কেন সে এভাবে নিজের জীবন নষ্ট করছে জানতে চায় , জানতে চায় মা বাবা এতে আপত্তি করে না ? স্টুডেন্ট অবস্থায় পয়সায় ই বা পায় কোথা থেকে ?
সেদিনের উত্তরে এলিনা খুঁজে পেয়েছিলো এক অন্য অয়ন কে । জেনেছিলো অয়ন তার মা বাবা র কাছে নয় থাকে তার মাসি মেসোর কাছে । মাসি মেসো নিঃসন্তান বলে তাকে উনারা এডপ্ট করেন ।ছোট ভাই তার বাবা মা র কাছেই থাকে ।সেদিন অনুভব হলো এক গাছের ডাল অন্য গাছে কখনোই জোড়া লাগে না ।বাবা মা র আদর ,ভালোবাসা ,স্নেহের বঞ্চনা শিশুর মনে ধীরে ধীরে কঠিন ক্ষতের যে বীজ বপন হয়েছিল আজ সে মহিরুহু তে পরিণত হয়েছে ।বুঝতে পেরেছিলো এলিনা , অয়ন হয়তো একদিন এই ভাবেই এক অব্যক্ত অভিমানে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করবে ।এ কষ্ট ,ক্ষত এর কোনো ওষুধ এলিনা র জানা ছিল না ।ভারাক্রান্ত মনে শেষ দেখা সেরে এলিনা বললো " অয়ন ভালো থেকো ,নিজের খেয়াল রেখো,পারলে জীবন টা কে সুস্থ ভাবে এগিয়ে নিয়ে চলো ". সেদিন অয়ন এর মলিন হাসি র ব্যাথা হয়তো এলিনা আজ ও বয়ে নিয়ে চলেছে .
এলিনা কলকাতা চলে গেলো । হোস্টেল এ রুম ও পেয়ে গেছে সে ।এবার ক্লাস শুরু র পালা ।ইউনিভার্সিটি তে প্রথম প্রথম নিজেকে মানাতে একটু কষ্ট হলেও মাস খানেকের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিল এলিনা ইউনিভার্সিটি র পরিবেশের সাথে ।

