গোল
গোল
গোলললললল..গোললললল ,এই আওয়াজটা শুনলেই কেমন যেন হয়ে যায় পূবালীর মনের অন্দরে ,যা ভাষায় প্রকাশ করা ওর পক্ষে অসম্ভব।
ফুটবল খেলা দেখার প্রতি সেই ছোটবেলা থেকেই খুব আগ্ৰহ পূবালীর। শুধু টিভি তে নয়,পাড়ার মাঠে খেলা হলেও সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে ,যতক্ষন না শেষ বাঁশি টা বাজছে ,তা তার যত কাজই থাক!এর জন্য কম বকা শুনতে হয়না মা এর কাছে ,তবুও নিজেকে সামলাতে পারেনা। আসলে ফুটবল খেলার প্রতি এই আগ্ৰহ টা তৈরী হয়েছিল বাবার হাত ধরে। খুব ছোটবেলায় সকাল -বিকাল নিয়মকরে পূবালী বাবার হাত ধরে মাঠে আসতো ,মাঠের প্রান্তে গাছতলায় বসে বাবার ফুটবল প্র্যাকটিস করা দেখতো , আর একটু বড় হবার পর , মাঝে মাঝে বাবার সাথে ফুটবলে পা দেওয়া ,বিভিন্ন গল্প শোনা এই গুলো ছিল রোজকার বিষয়।এইভাবে সময় গুলো কাটছিল গল্পের মতো করে, তারপর কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল!
আজ তিন বছর হলো ,বাবা আর এই জগতে নেই।সময় কেটেছে শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায়। পূবালীর মনে হয় এই তো বাবা খেলছে ,এক্ষুনি খেলা শেষ করে পূবালীর মাথায় আলতো করে হাতটা রেখে কতো কথা বলবে।. মানুষ কে সুখের স্মৃতি যে ভবিষ্যতে এতো কষ্ট দিতে পারে তা পূবালীর চেয়ে কেও বেশী জানতে পারে বলে ওর বিশ্বাস হয় না।
আজকে বাবার কথাগুলো বারবার মনে পড়ছিল পূবালীর।বাবা বলতো মানুষের জীবনের সাথে ফুটবল খেলার অনেক মিল। তখন এর মানেও বুঝতো না , মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক সময়। সময় সব মানুষ কে সব বুঝিয়ে দেয়! সে তা এতোদিনে বুঝতে পেরেছে। আসলে এখন জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝতে পেরেছে। বাবা প্রায় বলতো, প্রত্যেকে মানুষ তখনই সফল হবে যদি ফুটবলের গোলপোস্টের মত নিজেদের জীবনের গোল ঠিক রাখে। লক্ষ্য স্থির না থাকলে তুমি সারা মাঠে বল নিয়ে বেকার দৌড়ে বেড়াবে । দিনের শেষে শুধু পরিশ্রম করা সার হবে!তুমি সারামাঠে কতক্ষন বলে পা রাখলে ,দিনের শেষে কেউ দেখবে না, শুধু গোল দিতে পেরেছো কিনা সেটাই সবাই দেখবে । মানুষের ক্ষেত্রে যেমন কতটা তুমি সফল লোকে বিচার করে তুমি দিনের শেষে কি করছো ?কেমনভাবে .... তা নয়!এই বল নিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছনোর পথে কিছু লোক তোমাকে লক্ষ্
যে এগাতে সাহয্য করবে , যারা তোমার দলের লোক,যেমন জীবনের মাঠে যারা তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।কিছু মানুষ তোমাকে বাধা দেবে ,যারা তোমার বিপরীতে খেলছে । তেমনিভাবে, জীবনের মাঠে কিছু লোক তোমাকে ভুল পরামর্শ দেবে,লক্ষ্যের পথে বাধা সৃষ্টি করবে । এইসব পরাস্ত করে একজন ফুটবলার যেমন লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকে ,তেমনি তোমাকে সঠিক লক্ষ্যের দিকে এগাতে হবে সব বাধা-বিপত্তিকে পাশ কাটিয়ে। জীবনের মাঠেও গোলকিপারের মতো একজন থাকে যারা তোমাকে জীবনের প্রতি মুহূর্তে জেতাতে চায় ,যতই প্রতিকূলতা আসুক না কেনো। এর মধ্যে কিছু মানুষ থাকবে যারা তোমার ভালো করতে গিয়েও, অনেক ক্ষতি করে ফেলে ,তাদেরই অজান্তে।। আমাদের খারাপ লাগে ,আমরা এদের প্রায়শই ভুল বুঝি ,তবে এরা আমাদের চটজলদি সাফল্য এনে দিতে গিয়ে ,আমাদের দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে ,অনেকটা ফুটবলের অফসাইড এর মতো। জীবনের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া খেলা ফুটবল ছাড়া আর একটাও নেই!
বাবা প্রায়শই বলতেন প্রত্যেকে মানুষের উচিৎ একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে,, অথাৎ গোলের দিকে এগিয়ে যাওয়া।তবেই লোকে মনে রাখবে, আর আমার মতো তোকে পিছু ফিরে তাকাতে হবে না।
পূবালী কোনদিন ও জানতে পারেনি ,তার বাবার কিসের এতো যন্ত্রনা!যতবারই জিজ্ঞেস করেছে ততবারই বাবা এড়িয়ে গেছেন ,নানান কথা বলার অজুহাতে।
তবে এখন তার কাছে বাবার যন্ত্রণার কারণ অনেকটাই পরিস্কার। পূবালী এখন জেনেছে ওর বাবার যতটা প্রতিভা ছিল তা কোন দিনই উনি সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারেনি।সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ,শুধু বল নিয়ে দৌড়ে বেড়িয়েছে , কি ফুটবল মাঠ আর কি জীবনের মাঠ!
আবার একটা গোলের আওয়াজে হুঁশ টা ফিরে পেল পূবালী।আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে পূবালী বাড়ি গিয়ে বই খুলে পড়তে বসে গেল .....
দীর্ঘ দশবছর পরে হাজারও ব্যস্ততার মধ্যে এদেশে এসে বাবার নামঙ্কিত মেডেল টা সবোর্চ্চ গোল দাতা কে তুলে দিয়ে আজ পূবালীও খুব আনন্দিত ।তখনও মাঠের জায়েন্ট স্ক্রিনে দেখাচ্ছে পূবালী থেকে সায়েন্টিস্ট পূবালী হয়ে ওঠার ছবি ,আর পূবালীর কানে ভেসে আসছে সেই পুরোনো আওয়াজ গোলললললল!