রোমি ঘোষ

Romance Tragedy

3.0  

রোমি ঘোষ

Romance Tragedy

এক্লেয়ার্স

এক্লেয়ার্স

16 mins
452


টিং টুং টাং...

মেসেজ রিংটোনটা বেজে উঠতেই ঘুমমাখা চোখে বালিশের পাশে রাখা ফোনটা হাতে নিল দিয়া। রোজ সকালে এই বিশেষ মুহুর্তটার জন্যেই অপেক্ষা করে থাকে ও, একটা বিশেষ বার্তা না পেলে ওর যে ঘুম ভাঙ্গেনা, কারণ বার্তাটা পাঠানোর মানুষটা যে ওর কাছে খুবই বিশেষ।

টেক্সটটা পড়েই মুখে হাসিও ঝিলিক দিলো আবার রাগও উঁকি মারলো!

'গুড মর্নিং লেদী'

উফ্! বেদটা না! জ্বালিয়ে খেলো আমার ব্রেনটাকে, যতো রাজ্যের উল্টোপাল্টা ডাকনামে আমাকে না ডাকলে পটি ক্লিয়ার হয়না শয়তান ছেলেটার! নাহয় আমি একটু ঘুমকাতুরে, ল্যাদখোরামি আমার ডিএনএতে লেখা, তাই বলে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে কেউ সাতসকালে বিচ্ছিরি নামে ডেকে ঘুম ভাঙ্গায়? হে ঠাকুর, আমায় কার পাল্লায় ফেলে দিলে তুমি, দিমাগের টকদই খাইয়ে দিলো আমার, প্রেম করতে শিখল না এখনও বেদ!

রাগ, আফসোস সবরকম অনুভূতির চচ্চড়ি পাকিয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বেদের নাম্বারটা ডায়াল করতে লাগলো দিয়া। আজ একটা এসপার ওসপার করেই ছাড়বে, পাগলটার একটু ডোজ় দরকার!

"হ্যালো বেদ? এসব কতদিন চলবে আর?"

"ইয়ো লেদী! ঘুম ভেঙেছে তোর? কফি খাবি তো আয়, বানাচ্ছি!"

"ভাট না বকে যেটা জিজ্ঞেস করলাম তার অ্যানসার দে!"

"কী জিজ্ঞেস করলি? উমমম, মনে পড়ছে না!"

"উহুঁ, ন্যাকাষষ্ঠীর নাতজামাই আমার, এসব অ্যাক্টিং অন্য কারো কাছে করিস! বলছি আমায় আর কতোদিন তোর বেস্টফ্রেন্ডসদের মতো ট্রিট করে যাবি? এসব উল্টোপাল্টা ডাকনাম ইউজ করা এবার থামাবি প্লিজ? আমার একটা পিতৃদত্ত নাম আছে, দিব্যাঙ্কা গাঙ্গুলী, সেটা বলতে পারলে ভালো, নাহলে কিন্তু আমি পালাবো তোকে ছেড়ে!" "পালিয়ে যাবিটা কোথায়? কারণ তোর মতো প্রোডাক্টকে হ্যান্ডেল করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, আমি বলে তাই তোর প্রপোজ়াল অ্যাকসেপ্ট করেছি, অন্য কোনো ছেলে হলে কবেই ভাগতো! অ্যান্ড ফার্স্ট অফ্ অল, এসব দুষ্টুমিগুলো করা আমার ম্যানুফ্যাকচুয়ারিং ডিফল্ট, এসব বন্ধ করতে হলে বেদান্ত সেনশর্মা পেটে গ্যাস হয়ে মরে যাবে! আর সেকেন্ডলি, বড়োরাই তো বলে যতো খারাপ নাম দিয়ে ডাকবে ততো কম নজর লাগবে; তাই তোকে এসব বিচ্ছিরি নামে ডাকি। অবশ্য তোকে যা পেত্নীমার্কা দেখতে নজর লাগার সম্ভাবনা খুবই কম!"

"ওয়ে চুপ বে! আমায় পেত্নী বলছিস যে, নিজেকে আয়নায় তাকিয়ে দেখেছিস কেমন বাঁদরমুখো দেখতে! মাঝে মাঝে মনে হয় কী দেখে আমি তোর মতো ইডিয়টকে ভালোবেসে ফেললাম, যে কিনা এখনও পর্যন্ত ঠিকমতো প্রেম করতে শিখলো না। বক্সিং খেলার জন্যে লম্বাচওড়া বডিই বানিয়ে গেলি, অথচ বুদ্ধিতে শান দিতে পারলি না!"

"দিয়া, সকাল সকাল খিটিরমিটির ভালো লাগে না ইয়ার।"

"তুই তো শুরু করলি; মেজাজটার খিচুড়ি পাকিয়ে দিলি আমায় যাচ্ছেতাই একটা ডাকনাম দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে! এখন যেই তোর দিকে বলটা ঘুরিয়ে দিলাম ওমনি গায়ে লাগছে না!"

"তো ভুলটা কী বলেছি? ল্যাদখোর লেডি, তাই লেদী!"

"উউফফফ্! বেদ! আবার? দাঁড়া আমায় এতো বাজে বাজে নাম দিচ্ছিস তো; দেখবি একদিন আমিও তোর এমন একটা যাচ্ছেতাই নাম রাখবো, তখন বুঝবি আমার কেমন খারাপ লাগে!"

"ঠিক আছে, ইউ হ্যাভ ইয়োর ফুল ফ্রিডম অফ্ নেমিং মি, কার দৌড় কতদূর দেখা যাক! বল বল কী নাম রাখবি আমার বল?"

"এখন না, পরে ভেবে বলবো! ওই বেদ, শোন না, কবে মিট করবি কিছু ভাবলি?"

"তোর সাথে দেখা করবো কি না ভাবছি, যদি আমায় পাচার করে নিয়ে চলে যাস? তোকে বিশ্বাস নেই!"

"উঃ মাই লিটিল বেবি রে, বয়ে গেছে তোকে পাচার করতে বিকজ তোর মতো হাঁদার ভালো দাম পাবো না মার্কেটে!"

"হুম্ হাঁদা বলেই তো সেদিন চ্যাটবক্সে আমায় আই লাভ ইউ বলেছিলি! আমি ভালো ছেলে তাই তোকে অ্যাকসেপ্ট করলাম নাহলে কতো মেয়েরা আমার জন্য লাইন দিয়ে বসে আছে।"

"আমার দূর্ভাগ্য, তখন কী আর জানতাম এতো সুন্দর ফটোগ্রাফি করা মানুষটা ভিতরে ভিতরে এমন বুদ্ধুরাম হবে! আর তোর উপর যদি অতো মেয়েরা ক্রাশ খায় তো যা না তাদের কাছে, দ্য ডোর ইজ অলওয়েজ় ওপেন!"

"কেয়া করে, মুঝে আদত লাগ গ্যায়ী তেরি, আব তুঝসে রাহা নেহী যাতা এক পল ভি!"

"যা যাঃ, জুতো মেরে গরু দান করতে হবে না, যা ভাগ তুই! দুমাস ধরে অনলাইন লাভস্টোরি পড়িয়ে যাচ্ছে আমায়, আর সামনাসামনি দেখা করতে বললে ফালতু এক্সকিউজ় দেখায়!"

"আরে ইয়ার, তুই আমাদের ডিস্ট্যান্সটা দেখ; বিসাইডস্ তোরও অফিস থাকে অ্যান্ড আমার বক্সিং কোচিং সেন্টারের হেকটিক শিডিউল। ফাঁকা সময় পাই কোথায় যে ডেটিং করতে যাবো?"

"শোন দেখা করতে চাইলে ঠিকই উপায় বের করা যায়। থাক বেদ, আমারই ভুল হয়েছে তোকে এসব জিজ্ঞেস করা, আমি ফোন রাখছি, এবার আমায় রেডি হতে হবে।"

"দিয়া দিয়া কথা শোন বেবো, আচ্ছা এই স্যাটারডে নাইট তোর ফ্রি হবে, তাহলে চল মিট করি। মুভি দেখে ডিনার সেরে যে যার নিজের বাড়ি!"

"ফাইনালি, তোর মুখ দিয়ে অবশেষে বেরোলো প্রস্তাবটা! আমি তো ভেবেছিলাম সারা জীবন হয়তো আমায় চ্যাটবক্সেই প্রেম করে যেতে হবে তোর সাথে।"

"আচ্ছা বাবা, শনিবার ইভনিং তোর ফ্রি হবে কি না বলনা, তাহলে আমি সেই মতো আমার সেন্টারে কথা বলে রাখবো, তাড়াতাড়িই ছুটি দিয়ে দেবো আমার ট্রেনিদের তারপর তোর সাথে আড্ডা দেবো জমিয়ে।"

"ওকে রাজি, স্যাটারডে ইভনিং ফাইনাল, হ্যাভিং এ ডেট উইথ ইউ। উফ্ ফাইনালি তোকে সামনে থেকে দেখতে পারবো! ফেসবুকের ডিপি দেখে দেখে আর মন ভালো লাগছিলো না!"

"হ্যাঁ হ্যাঁ মন ভরে দেখিস আমায়, এসআরকে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো, ছুট্টে এসে জড়িয়ে ধরে একটা টাইট হাগ করিস আমায়!"

"হ্যাঁ সেই, ওটাই বাকি আছে, পাবলিক প্লেসে এভাবে হাগাহাগি করি দুজনে মিলে, তারপর দাদু-ক্যালানি একটাও হাওয়া বা মাটি কোথাও পড়বে না, সটাং আমাদের পিঠে এসে লাগবে; তখন ডেটিং ঘুচে যাবে!"

"ওয়ে! ডোন্ট ফরগেট ওয়ান্স আপন এ টাইম আই ওয়াস এ বক্সিং চ্যাম্পিয়ন, এসব মারকুটে দাদু-ফাদু আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার! আই ওয়ানা হাগ ইউ, ব্যস্। করবই করবো!"

"বাজে না বকে, বলনা আমি ওই দিন কী পড়বো, কী সাজলে ভালো লাগবে আমায়?"

"আচ্ছা তো! আমি কী জানি তুই কী পরবি কী সাজবি, আমি তোদের মেয়েদের ব্যাপারে অতো সাজগোজ বুঝিনা। তবে বেশি কিছু উগ্র সাজিস না যাতে আমার চিনতে অসুবিধা হয়, এমনিতেই তোকে যা অদ্ভুত দেখতে!"

"আচ্ছা?"

"হ্যাঁ তো!"

"শোন এই দেখার জন্যই না কতো ছেলে মাথা কুটে মরে যাচ্ছে, নেহাৎ আমি তোকে মন দিয়ে বসে আছি তাই!"

"দিয়া শোন না, নটা বাজতে চললো, এবার আমি রেডি হই রে, নাহলে দশটার মধ্যে বক্সিং ক্লাবে পৌঁছতে পারবো না।"

"হোয়াট! নটা বাজে আর তুই আমায় বলিসনি? এবাবা, আমারও যে অফিসে দেরি হয়ে যাবে!"

"আমি আবার বলবোটা কী, তোর ঘরে ঘড়ি নেই? নিজে টাইম দেখতে পারে না, আবার আমায় বলে আমি নাকি বোকা, প্রেম করতে পারি না!"

"শশশ্, চুপ! সে দ্যাট ইউ লাভ মি? বলনা, ইউ লাভ মি না!"

"ইয়া, সেম টু ইউ!"

বেদ হাসতে হাসতে ফোনটা কেটে দিলো, ওদিকে দিয়া কপাল চাপড়াতে লাগলো, "এই খ্যাপাকে নিয়ে আমি কোথায় যাই? টেরিফিক পার্সোনালিটি একটা!"

ওদের দুজনের মনে ভেসে উঠতে লাগলো প্রথম আলাপের সেই স্মৃতি।

দিয়া ভাবতে লাগলো; দিনটা ছিল রবিবার, বৃষ্টিস্নাত এক সন্ধ্যায় ও ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছিল, সেদিন ওর সদ্য ব্রেকআপ হয়েছে, কী এক দরকারে ডালহৌসি এসেছিল, ফেরার সময় ভাবলো মিলেনিয়াম পার্কটা একটু ঘুরে যাই, গঙ্গার হাওয়া মেখে বাড়ি ফিরব, পার্কের একটা বেঞ্চে বসতে গিয়েই উল্টো দিকের একটা বেঞ্চে গাছপালার আড়ালে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলে রাজীবকে অন্য একটা মেয়ের সাথে। রাজীব ড্রাংক ছিলো, সাথে ওই মেয়েটাও। যার সাথে আর তিন মাস পরেই বিয়ে সে ওকে এভাবে চিট করবে তা দিয়া বুঝতে পারেনি, অন্ধের মতো ভালোবাসতো ছেলেটাকে। সর্বসমক্ষে রাজীবকে একটা ঠাস করে চড় মেরে দিয়া কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায়, ভেবেছিল সেদিনই নিজের জীবন শেষ করে দেবে, কারণ বাড়ির লোককে নিজের বিয়ে ভাঙার কথা বোঝানোর মতো মুখ ওর ছিলো না। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি ওকে বাধা দেয় আর দিয়া বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরে, নিজের মনের জোর ফিরে আসতে থাকে ধীরে ধীরে।

ট্রেনের জানলার ধারে বসে মন ভালো করার জন্য ফেসবুক দেখছিল, একটা ফটোগ্রাফি গ্রুপের মেম্বার হয়েছে ও গত দু তিন মাস হলো, কিন্তু সেভাবে খুলে দেখা হয়নি গ্রুপটা। সেদিন ওই গ্রুপটার টাইমলাইনটা স্ক্রোল করছিল, ভেবেছিল যদি প্রকৃতি মায়ের ছবি দেখে মনের কষ্টটা ভুলে থাকা যায়, একটা বেইমানের জন্য কেন নিজের জীবনটা শেষ করবে ও, সব নতুন করে শুরু করবে দিয়া। হঠাৎ একটা ফটোতে এসে চোখ আটকে যায়, একজন ফটোগ্রাফার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হওয়া নানারকমের সূর্যাস্তের দৃশ্য ফ্রেমবন্দি করেছেন, একটা সিরিজের আকারে তিনি পোস্ট করেছেন ছবিগুলো, এক এক দিন এক এক রকম দেশের সূর্যাস্ত।

দিয়া পুরো সিরিজটা মন ভরে দেখতে থাকে, সাথে ওই ফটোগ্রাফারের অন্য কালেকশনগুলো চোখ বুলিয়ে নেয়, কোনোটা জঙ্গল, কোনোটা সমুদ্র, কোনোটা তারাভরা আকাশ, নাহ্ সত্যি চোখ আছে। জহুরীর জহর চেনার মতো প্রকৃতির অপরূপ মহিমাকে তিনি চিনে নিতে পেরেছেন ঠিক সময়ে। দিয়ার আর তর সইতে থাকে না ওই ফটোগ্রাফারের সূর্যাস্তের সিরিজটার বাকীটা দেখার জন্যে, পরবর্তী ছবি কবে পোস্ট হবে জানার জন্য ওনাকে সরাসরি ইনবক্সে যোগাযোগ বসে দিয়া।

তারপর বাকীটা ইতিহাস, প্রথম প্রথম সেই ফটোগ্রাফার খুব দায়সারা গোছের প্রফেশনাল উত্তর দিলেও পরে আস্তে আস্তে দুজনের মধ্যে বাঁধ ভাঙ্গতে থাকে, শুরু হয় এক নতুন বন্ধুত্ব। দিয়া নিজের মনের কথা ওনার কাছে খুলে বলে শান্তি খুঁজতে থাকে, আর সেই ফটোগ্রাফারও দিয়ার প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করতে থাকে। দিয়া জানতে পারে ওনার নাম, পূর্ব জীবনের কথা, বক্সিংয়ের জগৎ থেকে চোট পেয়ে বিদায় নেবার পর তিনি নিজেই ট্রেনিং সেন্টার খুলেছেন, পাশাপাশি শখের ফটোগ্রাফি করেন দেশ-বিদেশ ঘুরে, ইতিমধ্যেই কয়েক জায়গায় পুরস্কৃত হয়েছে তাঁর তোলা ছবি।

দিয়ার সাদামাটা জীবনে বেদ যেন একটা মিষ্টি হাওয়া বয়ে নিয়ে আসে, আর বেদেরও একাকিত্বের অন্ধকারে মাখা সময়গুলো দিয়া আসার পর আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে থাকে। সামনাসামনি না দেখলেও দুজনে দুজনকে নিয়ে একটা সুন্দর জগৎ বানিয়ে তোলে নিজেদের কল্পনার দুনিয়ায়। ভালোবাসার ফুল ফুটে ওঠে মনের গাছে এবং বেদ আর দিয়া একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে। এবার সেই বেদকে চোখের সামনে দেখতে পারবে, দুহাতে ছুঁতে পারবে সেই ভেবে দিয়ার মনে খুশির ফোয়ারাটা একটু বেশি জোরেই ফুটতে লাগল!

ওদিকে বেদও দিয়ার কথা ভেবে নাচতে নাচতে নিজের বক্সিং ক্লাবে চলে গেল, সারাদিন ট্রেনিংয়ে মন বসাতে পারলো না, সত্যি দিয়া যেন কোনো জাদু জানে, এক লহমায় ওর মনের সব আগল খুলে দিয়েছে, সারা দুনিয়ার কাছে ওর যে রাফ অ্যান্ড টাফ অ্যাটিটিউড সেটা দিয়ার ভালোবাসার কাছে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে, এখন ও দিয়ার প্রেমে মাতোয়ারা, ছোটো ছোটো খুনসুটির মধ্যে দিয়ে আপন করে নিয়েছে দিয়াকে, ভগবানের কাছে দিয়ার খুশি ছাড়া অন্য কিছু প্রার্থনা নেই বেদের। সেই দিয়াকে আর কদিন পরেই কাছে পাবে, দুচোখ ভরে ওকে দেখবে আর হারিয়ে ফেলবে নিজেকে দিয়ার মধ্যে। 


•~ক্রমশ~•


𒊹︎︎︎অন্তিম-পর্ব𒊹︎︎︎ 


'স্যাটারডে সন্ধ্যা ৬:০০ টা... কফি ওয়ার্ল্ড... টেবিল নাম্বার ১০... দেরি হলে আমি কিন্তু পালাবো... পি. এস. আই চুস ইউ!'

বৃহস্পতিবারের ব্যস্ত দুপুরে অফিসের লাঞ্চব্রেকের ফাঁকে দিয়ার মোবাইলে উপরোক্ত কথাগুলো উঁকি মারলো। "স্যাটারডে! মানে শনিবার! মানে আজ বাদে কাল পরশু! এমা! আমি কী ড্রেস পরবো সেটাই তো ঠিক করা হয়নি এখনও! আর এই কফি ওয়ার্ল্ডটাই বা কোথায়; আগে কখনো গেছি বলেতো মনে হয় না, উফ্ বেদটা না! বেছে বেছে যতো আননোন জায়গাগুলো সিলেক্ট করে, এটা বোঝে না যে আমি একটা মফস্বলের মেয়ে, কলকাতার রাস্তাঘাট এখনও ভালো করে চিনিনা! আর লিখেছে দেখো, 'দেরি হলে আমি পালাবো', যেন দেখা করতে এসে আমার কোনো মহান উপকার করে দিচ্ছেন উনি! তার উপর এই 'আই চুস ইউ'! উফ্, ভগবান, মাঝে মাঝে আমারও তো ভালো কিছু শুনতে মন করে, কিন্তু শয়তান ছেলে সেটা আজও বুঝলো না!", দিয়া আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগলো, "নাহ্, বেদকে একটা ফোন করা দরকার, এই ছেলেটা জাস্ট পাগল করে দিলো আমায়!", দিয়া ফোনটা নিয়ে অফিসের বাইরে বেরিয়ে এলো।

"কিরে তোর অফিস নেই? ফোন করলি কেন দিয়া!"

"দেখ বেদ, এসব প্রাইভেট কোম্পানিতে একটা লাঞ্চব্রেক বলে স্লট থাকে, এখন সেটাই চলছে, অবশ্য তুই এসব জানবি কী করে, তুইতো বাড়িতে বসেই ইনকাম করছিস! নিজের বাড়ির নিচেই জিম অ্যান্ড বক্সিং ক্লাব খুলেছিস, যখন ইচ্ছে যাচ্ছিস, খিদে পেলে উপরে গিয়ে খেয়ে আসছিস, অন্যদের পিটিয়ে টাকা আয় করছিস, বিন্দাস লাইফস্টাইল তোর!"

"হ্যাঁ রে খেপি; নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারে স্বর্গসুখ আমার বিশ্বাস! তুই আর কী বুঝবি আমার সারা শরীরে কতো ব্যথা অনুভব করতে হয় রোজ রোজ!"

"আহারে, আচ্ছা সেদিন মিট করে আদর করে দেব, সব ব্যথা সেরে যাবে!"

"বাবা! কে রে তুই! সেদিন বলছিলিস পি.ডি.এ. করা পছন্দ করিস না, তা আজ হঠাৎ এতো ভোলবদল কেন? সাসপিশাস, হাইলি সাসপিশাস!"

"বাজে বকিস না, এই শোন না, বলছি এই কফি ওয়ার্ল্ডটা কোথায় রে? আমি আগে কখনও যাইনি, তুই তো জানিস আমি এখনও পর্যন্ত এই শহরটাকে ঠিক মতো চিনলাম না, আর তুই এসব আননোন জায়গাগুলোকে ঠিক করছিস মিট করার জন্য!"

"আরে ভীতু! চিনিসনা তো কী হয়েছে, চিনে নিবি। মাঝে মাঝে একটু অ্যাডভেঞ্চার করতে শেখ, নতুন জায়গা এক্সপ্লোর করার মজাই আলাদা! কফি ওয়ার্ল্ড নতুন হয়েছে, তবে অল্প কদিনেই খুব পপুলারিটি পেয়ে গেছে ওদের কোয়ালিটি অ্যান্ড সার্ভিসিংয়ের জন্য। ভাবছি তোর সাথে ওখানেই মিট করবো, কফি খেয়ে তারপর আমরা মুভি দেখব, তারপর ডিনার করে তোকে বাড়ি ফেরার ট্রেনে তুলে দিয়ে আমার ছুটি! ডোন্ট ওরি, আমি কোনো কিডন্যাপার নই যে অচেনা জায়গায় তোকে মিট করতে বলবো আর নিজের গ্যাং নিয়ে রেডি থেকে তোকে ধরে নিয়ে পালাবো! শোন তোকে কফি ওয়ার্ল্ড-এর অ্যাড্রেস টেক্সট করে দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি চলে আসবি কিন্তু!"

"হ্যাঁ, আর না আসলে তুই পালাবি তাই তো?"

"হুঁ, বেকার বসে থেকে কী করবো? কাফেতে মশা-মাছিও নেই যে তাড়িয়ে টাইমপাস করবো!"

"উফ্ বেদ, তুই কবে শোধরাবি ইয়ার? হোয়েন উইল ইউ বি সিরিয়াস্?"

"বললাম না, এগুলো আমার ম্যানুফ্যাকচুয়ারিং ডিফল্ট, এর কোনো চিকিৎসা নেই!"

"সেই... আচ্ছা এই 'আই চুস ইউ' এসবের কি মানে হয়? এগুলো কোন লেভেলের পাগলামি? কেয়ার টু এক্সপ্লেন!?"

"এমা, সেকি! তুই 'আই চুস ইউ' মানে জানিস না? এবাবা! আচ্ছা, চিন্তা করিস না, সেদিন তোর জন্যে একটা ডিকশনারি নিয়ে যাবো! সব মানে বুঝিয়ে দেব।"

"ধুর, আমি ফোন রাখছি। তোর যখন আর কিছু বলার নেই তাহলে আমি যাচ্ছি, কাজ আছে!"

"হ্যাঁ, বলার তো আছেই অনেক কিছুই! তবে ভাষারা আমায় ছেড়ে পালিয়েছে, বিকজ, আই অ্যাম লস্ট ইন ইউ। যাইহোক, আচ্ছা আমার কী ডাকনাম রাখলি রে? তোকে তো এতদিন ভাবার সময় দিলাম, কী নাম ঠিক করলি আমার?"

"সেটা যেদিন দেখা হবে সেদিনই বলবো!"

"বাবাঃ! একটা নাম রাখতে তোর এক সপ্তাহ লেগে গেল?"

"আমি তোর মতো অতো নাম-বিশারদ নই রে; যে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে 'লেদী' নামে ডাকে! জাস্ট ইরিটেটিং ইয়ার!"

"ওগুলো ভালোবেসে দেওয়া নাম, বেবো ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!"

"হুঁ ভালোবাসা না ছাই, কোনোদিনও সুন্দর করে 'আই লাভ ইউ' বলেছিস আমায়? তা নয়, সবসময় উইয়ার্ড অ্যাটিটিউড দেখিয়ে 'আই রেসপেক্ট ইউ', 'সেম টু ইউ' এসব বলে যাস! আজকে তো আরো মারাত্মক, 'আই চুস ইউ'! বলি আমি কি কোনো প্রোডাক্ট নাকি যাকে চুস করতে হবে? মাঝে মাঝে আমারও কিছু ভালো কথা শুনতে মন করে সেটা তুই দুমাসে বুঝলি না, বাকী জীবনটাতো আরোই বুঝবি না! সত্যি, আমার কপালটাই খারাপ।"

"দিয়া, আই হ্যাভ টু গো, আমার স্টুডেন্টরা ডাকছে! আর শোন, ওই সব উক্তিগুলোর মধ্যে হিডেন ভালোবাসাটা বুঝতে শেখ পাগলী! ওকে বাই!"

"হ্যাঁ, এর থেকে ভালো আর কী শোনাতে পারিস!"

ফোনটা কেটে দিল দিয়া, ছেলেটা সত্যি পাগল, কিন্তু ওর এই পাগলামিগুলোর মধ্যেও যে একটা সরল ভালোবাসা আছে সে কথা ভেবে দিয়া ফিক করে হেসে উঠলো। আজ অফিসের পর একটু শপিং যেতে হবে; একটা নতুন কুর্তি দেখে এসছিলো সেদিন, হলুদ রঙের উপর লাল, সবুজে নকশা করা, সাথে গোলাপী দুপাট্টা। শনিবার সন্ধ্যায় ওই মিষ্টি রঙেই নিজেকে সাজাতে চায় দিয়া, যাতে পাগল বেদটা ওকে দেখে চোখ ফেরাতে না পারে! 


আজ শনিবার;

বেদ আগের দিন সারা রাত জেগে দিয়ার জন্য ছবি এঁকে গ্রিটিংস কার্ড বানিয়েছে, সেই কার্ড হাতে কফি ওয়ার্ল্ড ক্যাফের ১০ নাম্বার টেবিলে বসে গত দেড়ঘন্টা ধরে ও অপেক্ষা করে আছে, দিয়ার পাত্তা নেই, ফোন করলে বলছে নট রিচেবল!

'কী ব্যাপার কী দিয়াটার, এতো লেট করছে কেন? ছটায় আসার কথা এদিকে সাড়ে সাতটা বাজে, আটটায় মুভি শুরু, এখন কখন কফি খাবো আর কখনই বা মুভি দেখব!', বেদ মনে মনে ভাবতে লাগলো, 'না না দিয়া এইভাবে আমায় চিট করতে পারেনা, ও সেধরনের মেয়ে নয়, তাহলে কী আমি কোনো ভুল করলাম মানুষ চিনতে?', হাতের গ্রিটিংস কার্ডটাকে দুমড়ে ধরে বেদ গজগজ করতে করতে উঠে বেরিয়ে যাচ্ছিল ক্যাফে থেকে, হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় ক্যাফের দরজাটা খুলে গেল। বেদ দেখতে পেল দিয়া দাঁড়িয়ে আছে!

"একি দিয়া? এতো দেরি হলো কেন রে, আমি তো ভাবলাম তুই আসবি না! তোর ভাগ্য ভালো যে আমি এখনও পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। আমি উঠে পালাই নি, তুই অনেক লাকি!", বেদ হকচকিয়ে গেল দিয়াকে দেখে।

"আসবো না মানে? তোকে যে আমি কথা দিয়েছিলাম, কথা না রেখে চলে গেলে যে আমার অনেক পাপ হবে রে! আর ভাগ্যের কথা বলছিস; এসবে আর কিছু যায় আসেনা রে আমার! আমার কপাল পোড়া ছিলো বরাবরই, আর পোড়াই থাকবে।", দিয়া কেমন ভাসাভাসা গলায় উত্তর দিল।

"এভাবে কথা বলছিস কেন? আর তুই এরকম ছেঁড়া জামা পরে এসছিস কেন? এরকম বিধ্বস্ত লাগছে কেন তোকে! আয় বোস এখানে। তোর কী হয়েছে বলতো আমায়, শরীর ভালো আছে তো তোর? তাহলে বলতে পারতিস আমায়, আজকের ডেটটা ক্যানসেল করে দিতাম আমি। বোস না তুই, গরম কফি অর্ডার দিচ্ছি, খেলে শরীরে একটু এনার্জি পাবি তুই, তারপর নাহয় আমরা কথা বলবো, আজ আর মুভি দেখা হবে না, চল আড্ডা দিই জমিয়ে!", বেদ চমকে উঠল দিয়ার উত্তর শুনে, ওর এলোমেলো অবস্থা দেখে বেদের মনে সন্দেহ জেগে উঠল, মেয়েটার কোনো বিপদ হয়নি তো আসার সময়, একেই তো কলকাতার রাস্তাঘাট সেভাবে চেনে না বেচারি, কিছুইতো বলছে না ঠিকমতো, উল্টে দায়সারা গোছের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে পাগলিটা!

"না রে, আমাদের আর আড্ডা দেওয়া হবে না! আমার হাতে সময় খুব কম, এক্ষুনি যেতে হবে। ওরা ডাকছে!", দিয়া জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে উত্তর দিল।

"কে ডাকছে? কোথায় যাবি তুই? দিয়া ডোন্ট ফরগেট দিস ইজ আওয়ার ফার্স্ট ডেট, তুই আজকের দিনে অন্য কোনো প্ল্যান রাখতে পারিস না বেবো, দিস ইজ নট ফেয়ার!", এবার বেদের গলায় বিরক্তি ঝড়ে পড়লো।

"প্ল্যান কি আর জেনে শুনে বানালাম! হয়ে গেল হঠাৎ করেই! এখন আমার যাবার ব্যবস্থা পাকা। আর কিছু করার নেই বেদ, এখন সব কিছু আমার হাতের বাইরে, আমি শুধু এই বাকি কাজটা সেরে যেতে এলাম।", দিয়ার চোখে অসীম শূন্যতা, গলার স্বরটা বদলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

"কী বাকী কাজ? দিয়া এসব হেঁয়ালি না করে সোজাসুজি বল কী হয়েছে, আর ইউ নট হ্যাপি উইথ মি? এই রিলেশনশিপটায় তুই হ্যাপি নোস? সত্যি বল, তাহলে আমি বরাবরের মতো চলে যাবো তোর লাইফ থেকে, আর কোনোদিনও তোকে কন্ট্যাক্ট করবো না! তুই আজ ব্রেক-আপ করতে এসছিস নাকি?", বেদের বিরক্তির পারদ ক্রমশ চড়ছে।

"হ্যাপিনেস, ব্রেক-আপ এসবের প্রশ্ন উঠছে কেন বেদ? টু বি অনেস্ট, ইউ আর দ্য বেস্ট থিং দ্যাট এভার হ্যাপেনড টু মি। বাট লাইক আই সেড; আমার ভাগ্যে সুখ সহ্য হয় না, তাই তো আজ তোকে পেয়েও পেলাম না!", বেদের চোখে চোখ রেখে দিয়া উত্তর দিল।

"দিয়া কী হয়েছেটা কী তোর? এরকম উইয়ার্ড বিহেভ কেন করছিস? আচ্ছা আমি 'আই লাভ ইউ' বলিনা বলে অভিমান করেছিস? ওগুলো তো মজা করি, সেটাও বুঝিস না পাগলী!", বেদ চেষ্টা করলো দিয়াকে বোঝানোর।

"আর অভিমান... এই পৃথিবীতে আমার কিছু অবশিষ্ট থাকলে তো অভিমান করবো।", দিয়া নিরুত্তাপ স্বরে কথা বলতে লাগলো।

"গড নোস তুই এরকম স্ট্রেঞ্জ বিহেভ কেন করছিস।", বেদ অবাক হয়ে গেল দিয়ার উত্তর শুনে।

"গড? হ্যাঁ সেই, উনি সবই জানেন তাও চুপ করে থাকেন। যাইহোক, আমার আর বেশি কথা বলার সময় নেই রে বেদ, এবার যেতে হবে আমায়। তোর গিফটটা দেবার জন্য এতদূর আসা। এইনে, এটা ধর!", দিয়া একটা ঝলমলে রঙিন বাক্স নিয়ে বেদের হাতে দিলো।

"ঠিক আছে, এতই যখন তোর যাবার তাড়া, তখন তোকে আর আটকাবো না। যাবার আগে একটা গুডবাই হাগও কি আমার প্রাপ্য হয় না?", বেদ উঠে দাঁড়িয়ে দিয়ার হাত দুটো ধরে ওকে জড়িয়ে ধরলো, হঠাৎ একটা ঠান্ডা শিহরণ খেলে গেল ওর সারা গায়ে! দিয়ার শরীরটা এত হালকা লাগছে কেন? হাত দুটো এতো অসম্ভব ঠাণ্ডা, জ্বর-টর হয়নিতো মেয়েটার? আহারে, জ্বর গায়ে দেখা করতে এসছে দিয়া, ওই জন্যই মনে হয় এতো 'যাবো যাবো' করছে তখন থেকে, নিশ্চয়ই ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসেছে, আর আমি কিনা তখন থেকে ওকে ভুল বুঝে আটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি! ধুর, দিয়া ঠিকই বলেছে, আমি প্রেম করতে শিখলাম না এখনও, দিয়ার মনটা বুঝতেই পারলাম না ভালো করে। থাক ওকে যেতে দিই আজকের মতো, পরে আবার কোনোদিনও দেখা করে তখন চুটিয়ে প্রেম করবো আর আজকের সব লস সব সুদে আসলে পুষিয়ে নেব দুজনে মিলে! বেদ মুচকি হেসে উঠলো।

"আমি আসছি বেদ... দেখা হবে পরপারে... ভালো থাকিস... আই লাভ ইউ!", দিয়া বেদকে ছাড়িয়ে নিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেলো, মুখে একটা মিষ্টি অথচ রহস্যময় হাসি লেগে রয়েছে ওর, চোখে একটা অদ্ভুত কাতরতা, বেদনাময় দৃষ্টি, যেন কিছু না পাওয়ার আক্ষেপ। বেদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দিয়ার দিকে, হঠাৎ ক্যাফের লাইটগুলো দপ্ করে নিভে গেল।

যখন আবার কারেন্ট এলো তখন বেদ দেখলো দিয়া নেই, হাতে দিয়ার দেওয়া গিফটটা ধরে ও দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ মনে পড়ল ওর পকেটে রাখা সেই গ্রিটিংস কার্ডটা, ইসস্ ওটাতো দেওয়াই হলো না দিয়াকে! আর যাকগে না দেওয়া হয়েছে ভালোই হয়েছে; তখন রাগের বশে ও কার্ডটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলো, ওই ছেঁড়া কার্ড পেলে দিয়ার খুব কষ্ট হতো। যাইহোক, আবার নতুনভাবে একটা কার্ড বানিয়ে এর পরেরবার যখন আবার দিয়ার সঙ্গে দেখা হবে তখন দেবই দেবো, এটা নিজের কাছে নিজের পাক্কাওয়ালা প্রমিজ়! এখন যাই, খুলে দেখি দিয়া কী গিফ্ট এনেছে আমার জন্য।

বেদ দেখলো বাক্সটার উপরে লেখা 'তোর নাম', হো হো করে হাসতে লাগলো বেদ, "আমার নাম?! হুম্, পাগলী বলেছিল বটে যেদিন দেখা হবে সেদিন আমার ডাকনামটা ঘোষণা করবে ও, দেখা যাক কী নাম রাখলো আমার!", উত্তেজিত হয়ে বাক্সটা তাড়াতাড়ি খুলে ফেললো বেদ; ভিতরে দেখলো ছোটো ছোটো এক্লেয়ার্স টফির প্যাকেট ঠাসা, সঙ্গে একটা চিরকুট। কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে বেদ চিরকুটটা পড়তে লাগলো; 'তোর সাথে এই টফিগুলোর খুব মিল খুঁজে পাই জানিসতো বেদ, এক্লেয়ার্স টফি যেরকম বাইরেটা খুব শক্ত, অথচ ভিতরটা নরম। তুইও ঠিক তেমনই; বাইরে থেকে দেখাস তুই কতো স্ট্রং পার্সোনালিটি, রাফ অ্যান্ড টাফ, কিন্তু ভিতরের হার্টটা তোর খুব সফ্ট। আর এক্লেয়ার্স টফি যেমন বাইরেটা সুইট খেতে লাগে, তোকেও তেমনই বাইরে থেকে খুব কিউট দেখতে! তাই ভাবলাম তোর ডাকনাম রাখবো এক্লেয়ার্স, কিরে নাম পছন্দ হয়েছে তো? অবশ্য না পছন্দ হয়ে থাকবে কি করে, আই অ্যাম ইয়োর গার্লফ্রেন্ড ইডিয়ট! নে এবার হাস দেখি, হাহা হিহি হোহো!!! ইতি, তোর দিয়া, উমমমআহ!', চিরকুটটা পড়া শেষ করে বেদ হাসতে হাসতে ঠোঁট দিয়ে ছুঁতে লাগলো কাগজটাকে, "লাভ ইউ ইনফিনিটি, দিয়া!"

বাক্সটা নিয়ে ক্যাফের বাইরে বেরিয়ে এলো বেদ, হাতের মুঠোয় কতগুলো এক্লেয়ার্স ধরা, একটা একটা করে মুখে পুরে হাঁটতে লাগলো বেদ, ওর মনের আনাচে কানাচে দিয়া উঁকি দিতে লাগলো, বাসে উঠে জানলার ধারের সিটটা পেয়ে কানে হেডফোন গুঁজে দিল ও, "ফেয়লি থি সিয়াহ্ রাতে... কুছ তো হ্যায় তুঝসে রবতা..."

হঠাৎ ড্রাইভার আচমকা ব্রেক কষতে হুঁশ ফিরল বেদের; কোলাহল শুনে বোঝা গেল কাছে পিঠে কোথাও একটা ফ্লাইওভার ভেঙ্গে পড়েছে, হতাহতের সংখ্যা অনেক, তাই পুলিশ এদিকের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে, সুতরাং যাত্রীদের বাকী রাস্তাটা হয় হেঁটে নয় অন্য কোনো উপায়ে ফিরতে হবে।

কিছু কৌতুহলী জনতা বাস থেকে নেমে ধ্বংসস্তূপের দিকে এগিয়ে গেলেন হালচাল দেখার জন্য; বেদও ওদের সঙ্গী হলো, তবে দর্শক হবার জন্য নয়, যদি কোনো সাহায্য করতে পারে অসহায় মানুষগুলোকে। যদিও পুলিশ যেতে দিচ্ছে না ব্যারিকেড ভেঙ্গে, তাও ফাঁকফোঁকর দিয়ে বেদ ঠিক ঢুকে গেল দুর্ঘটনাস্থলের কাছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি ওকে চুম্বকের মতো টানছে ওই জায়গাটার দিকে।

বাকিদের সাথে হাত মিলিয়ে বেদ সরাতে লাগলো ভাঙাচোরা পাথর এবং যানবাহনের অবশিষ্টগুলো। হঠাৎ একটা বড়ো চাঙর সরাতেই হলুদ কুর্তি পড়া একটা নারীদেহ বেদের হাতে ঠেকলো, ধুলোমাখা গোলাপী দুপাট্টাতে মুখটা ঢাকা দেহটার। অজানা আতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠলো বেদের, "এই ড্রেসটাইতো দিয়া পড়েছিল! না না, আমি যা ভাবছি তা যেন ভুল হয়ে ভগবান!", কাঁপা কাঁপা হাতে বডিটার মুখের উপর থেকে দুপাট্টাটা সরালো বেদ, "দিয়া!!!", মুখে হাত দিয়ে ফোঁপাতে লাগলো ও, "আঁ আঁ...", পকেট থেকে এক্লেয়ার্সগুলো বের করে মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো বেদ, "আই লাভ ইউ দিয়া... আই লাভ ইউ সো মাচ! তুই এভাবে ঠকাতে পারিস না আমায়, আমরা প্রমিজ করেছিলাম উই উইল অলওয়েজ বি অন ইচ আদার্স সাইড!"

"...আর কতো বডি চাপা পড়ে আছে কে জানে...", "... সেই বিকেল পাঁচটায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, এখনও পর্যন্ত উদ্ধারকাজ শেষ হলো না! এদিকে রাত দশটা বাজতে চললো...", "...পুরসভা এসব ব্রিজগুলোর রক্ষণাবেক্ষনের কাজ ঠিকমতো করেনা কেন কে জানে...", "...সরকার চুপ কেন...", বাতাসে মিলিয়ে যেতে লাগলো শতশত আওয়াজ। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance