বোধনে দেবী বিসর্জন...
বোধনে দেবী বিসর্জন...
পিতৃপক্ষের অবসান মুহুর্তের অপেক্ষা মাত্র, দেবীপক্ষের সূচনা আর কিছুদিন বাকি। বছর ঘুরে দেবী আরাধনার প্রস্তুতি চৌধুরী বাড়িতে তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলছে। সমস্ত গ্রাম জুড়ে হৈ হৈ রব। সারাবছরের ক্লান্তি দূরে যাবে, মিটে যাবে দূরত্ব। মানুষে মানুষে মিলন ঘটবে। পূজার চারদিন গ্রামের সমস্ত মানুষ চৌধুরী বাড়িতে পুজোর আনন্দে মেতে থাকবে, দিন রাত অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ক্লান্তি দূর হবে, সবাই এক হয়ে পেট ভোরে খাবার খাবে। এই আনন্দ বছরে একবারই আসে। একবছর পর চৌধুরী বাড়ির একমাত্র মেয়ে উমা বাড়ি বাপের বাড়ি আসবে সেই আয়োজনেরও প্রস্তুতি তখন শেষ পর্যায়ে।
গত বছর বিয়ে হয়েছিল উমার। ব্যাংক ম্যানেজার অনিমেষ চৌধুরীর একমাত্র কন্যা উমা বড়োই আদরের। ছোটবেলা থেকে মা মরা কন্যাকে অনিমেষ নিজেই মানুষ করেছে।প্র য়োজনের থেকে একটু বেশীই সে উমাকে ভালোবাসে। কোনদিন মায়ের অভাব হয়তো বুঝতে দেয়নি। তবুও ফাঁকিটা থেকে গিয়েছিল মূলে।
উমার যখন বিবাহের বয়েস আগত তখন সবকিছু দেখাশোনা করেই তার বিবাহ ঠিক হয়েছিল। বিত্তশালী পরিবারে বিবাহ দিলেও অনিমেষের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল মানুষ গুলির মানবিকতা আছে কি না? মানুষগুলি আদৌ মানুষ কি না সেটা অনিমেষ দেখেনি। পাত্র ভালো, পরিবার ভালো, টাকা পয়সাও অগাধ আছে এটুকুই শুধু দেখেছিল। মেয়ের অভাব অনটন যাতে কোনদিন না আসে সকল বাবা মায়ের মত অনিমেষ সেটা দেখেছিল। কিন্তু মানুষগুলি প্রকৃত মানুষ নাকি কেবলই মুখোশ মানুষ সেটা অনিমেষের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল।
উমার বিবাহকে কেন্দ্র করে অনিমেষের সকল স্বপ্নই পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু উমা কি আদৌ সুখী হয়েছিল তাতে? হয়নি…
<
br>
স্নেহ ভালোবাসায় মানুষ করা বাবার মুখের উপর উমা কোনদিন কোন কথা বলেনি। বিবাহ উপস্থিত হলে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকেও অচিরেই বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিল উমা। যদিও পরে জানা গেছে তার ভালোবাসার মানুষটি তাকে ভালোবেসেছিল কেবলই অনিমেষের টাকার লোভে।
গত বছর ফাল্গুনে বিয়ে হয়েছিল উমার। তারপর ধীরে ধীরে শশুর বাড়িতে শুরু হয়েছিল অকথ্য অত্যাচার।অনিমেষ চৌধুরীর সম্পত্তির অধিকার নেওয়ার লোভ দিনে দিনে বাড়তে থাকে উমার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের। প্রতিদিন অত্যাচারিত হতে থাকে উমা। বেল্টের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে শরীর। মন তো পুড়ে ছাই হয়েছে কবেই। মানুষগুলির টাকার কোন অভাব ছিল না, শুধু তাদের অভাব ছিল মানবিকতার, মনুষ্যত্বের…
আজ সপ্তমী। সারা বাড়ি সারা বাড়ি সেজে উঠেছে আনন্দে। মা আসছেন। ঘরের মেয়ে উমাও বাড়ি আসবে। সমগ্র বাতাসে ধুনো,ধূপের গন্ধ। প্রকৃতি জুড়ে শুধুই পুজোর বার্তা।
হ্যাঁ উমা বাড়ি এসেছে। তবে জীবন্ত অবস্থায় না, এসেছে লাশ হয়ে। অকথ্য অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি নিতে উমা বেছে নিয়েছিল মৃত্যুকে। সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে মৃত্যুর আশ্রয় গ্রহণ করতেই বাধ্য হয়েছিল উমা। সপ্তমীতে মা দুর্গার পূজা সূচনার সাথে বিসর্জিত হয়েছে উমা। কিন্তু কি কারণে উমার মৃত্যু হল? সেকথা অনিমেষ হয়তো কোনদিন জানতেই পারবে না। এভাবে আজও কত উমা হারিয়ে যায় সে খবর কে রাখে? অনিমেষরা হয়তো কোনদিন জানতেই পারে না কি কারণে হারাতে হয় তাদের মেয়েদের! অনিমেষ দের কি আদৌ কোন দোষ? না...সব বাবা মা চান তার মেয়ে সুখী হোক ভালো থাকুক তবুও ত্রুটি কখনও কখনও মুলেই থেকে যায়...হারিয়ে যায় উমারা...