ভালোবাসার অতৃপ্ত কান্না
ভালোবাসার অতৃপ্ত কান্না
প্রতিদিনের মতো রোজ সন্ধ্যাতেই শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে দাস পরিবারে, প্রায় ১৫-মিনিট ধরে চলে পূজার্চনা, পূজাপাঠ, তুলসী গাছে জল ঢালা নিয়ম করে ৷
শঙ্খধ্বনি ও ঘন্টার আওয়াজে সবাই বুঝে যায় যে হ্যাঁ, সন্ধ্যা নেমে গেছে, তখন যে যার মতন করে নিজের কাজে ঘরে ঢুকে যায়, পাড়ার মধ্যে এতোবড় ঠাকুর ঘর ঐ তল্লাটে আর কারোর নাই, আর এই জল ঢালার কাজটা করে থাকে তৃষা.৷
তৃষা দাস, ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট ৷ বেশ উচ্চ বংশ পরিবারের একমাত্র মেয়ে.৷ বাড়ির চারদেওয়াল আর স্কুল ছাড়া বাইরের জগতের সবকিছুই তাঁর অচেনা-অজানা. এবছরই সে নতুন কলেজে পা রাখে অনেকটা জেদ বসতো, তাও আবার অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে, বাবা-মা এর খুব আদরের মেয়ে, কখনও তাকে কোথাও একা ছাড়া হয়নি, কিন্তু সেও কম নয়, খুব জেদি, কলেজ সে যাবেই, তাও আবার বাড়ির গাড়িতে নয়, তাতে নাকি বন্ধুদের ছোট করা হবে, একসাথে কলেজ যাওয়ার মজাই আলাদা, তাই সাইকেল কিনে দিতেই হবে বন্ধুদের সাথে যাওয়া আসার জন্য, এই আদুরে আব্দারে দিন ছয়েক লেগেছিলো তার বাবাকে বোঝাতে, শেষমেশ উপায় না পেয়ে রাজি হতে হয়েছিল অঞ্জন বাবুকে.
প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও পরে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়.
রেগুলার ডিউটির মধ্যে তৃষার একটাই কাজ ছিলো, বিকাল পাঁচটাই কলেজ ফেরৎ এসেই তুলসী গাছে জল দেওয়ায় নাকি তাঁর সখ.!
বাড়ি এসেই ফ্রেস হয়ে ছোট বালতির এক বালতি জল নিয়ে ছাদে উঠে যায় দৈনন্দিনকার মতো, একটু ঘোরাঘুরির পর তুলসী গাছে জল ঢেলেই ফিরে আসে নীচের তলায় নিজের কামরায়,
তারপর পড়াশোনা, গানের রেওয়াজ এইসব চলতে থাকে সারাক্ষণ.৷
এর-ই মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই তৃষা লক্ষ্য করেছে তাদের বাড়ির সামনে, নতুন ফ্লাটের ছাদে একটা ছেলে ঠিক সন্ধ্যার সময়টাতেই ঘোরাঘুরি করে আর মাঝে মাঝে তার দিকে কেমন যেনও তাকিয়ে থাকে, সে বেশ বুঝতে পারে ঐ ফ্ল্যাটেরই হয়তো নতুন কোনও বাসিন্দা হবে, তাই কাউকে কিছু না বলেই চুপচাপ থাকে, এইভাবে কেটে যায় বেশ সপ্তাহ খানেক, মনে মনে তৃষা বেশ এনজয় করে ব্যাপার টা, কারণ তার এই প্রথম কলেজ লাইফে সেইভাবে কোনও ছেলের সাথে আলাদা ভাবে কথা বলা বা সেরকম কোনও সিচুয়েশন তৈরি হয়ে ওঠেনি এখন অবধি. তাই তাকাতাকির ব্যাপারটা মনে মনে ভালো লাগলেও মুখে প্রকাশ করতে পারেনি কখনও কারো কাছে..!
কলেজে থাকাকালীন হঠাৎ করেই একদিন দুপুরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ায় তৃষা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো বাড়ি ফিরবে কিভাবে.? থামার কোনও নাম গন্ধই ছিলোনা, বাড়ি ফেরার টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে সাত-পাঁচ না ভেবে ঐ বৃষ্টির মধ্যেই এক হাতে ছাতা অন্য হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে বাড়ি ফিরছিলো তড়িঘড়ি করে, কিন্তু বৃষ্টির জলে রাস্তাঘাট এতোটাই টইটুম্বর যে, একহাতে ছাতা নিয়ে সাইকেল চালানো তারপক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না ৷ এদিকে ঘন কালো মেঘে আকাশ প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন, বলতে গেলে প্রায়ই সন্ধ্যা, বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে সেইভেবে সে বড় বড় পা ফেলে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য, বাড়ির কাছাকাছি আসতেই প্রচন্ড শব্দে আশে-পাশে কোথাও একটা বাজ পড়ার আওয়াজে রীতিমতো ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠেছিলো তৃষা, চোখ বন্ধ করেই কেঁপে উঠেছিলো তাঁর সারা শরীর, প্রবল বৃষ্টির জোরেই রাস্তা ঘাট ছিলো তখন প্রায় জনশূন্য. চারদিক নিঝুম, কেউ কোথাও নেই, এদিকে সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে,
এমতাবস্থায় সামনের ফ্ল্যাটের ঐ ব্যাক্তি প্রবল বৃষ্টি ও বজ্রপাতের হুংকারে রাস্তার উল্টো দিকে এক সানসেটের নীচে দাঁড়িয়েছিলো বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়, দূর থেকে তৃষার এই দূরাবস্থা দেখে দৌড়ে আসে তার কাছে, আস্তে করে বলে 'আর ইউ ওকে ম্যাডাম' ?
আবারও হকচকিয়ে ওঠে তৃষা, হাত-পা তখনও কম্পনরত, কোনও রকম চোখ তুলে দেখে শুধু মানুষটাকে,কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই, ঠোঁটের কোণে একটু মৃদু হাসির ছোঁয়ায় শুধু ঘাড় কাত করেই ধীরে ধীরে পা বাড়াতে থাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে,তখনও মনের মধ্যে বজ্রপাতের আতঙ্ক, তার পা যেনও মাটিতে তখনও জমে প্রায়, চলার মতো ক্ষমতায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলো না, গোটা শরীর অবশ হয়ে পরেছিলো,
বেগতিক খারাপ দেখে ছেলেটি আবারও স্বেচ্ছায় জিজ্ঞেস করে 'মেই আই হেল্প ইউ ম্যাডাম' ?
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকেই লুটিয়ে পড়ার আগেই ছেলেটি
চটজলদি সাইকেল টা ধরে নেই, একহাতে সাইকেল আর অন্য হাতে তৃষাকে ধরে কোনক্রমে বাড়ি পৌঁছে দেয় সেই মূহুর্তে,
এদিকে মেয়েকে প্রথমটা এই অবস্থায় দেখেই ঘাবড়ে যায় অঞ্জন বাবু আর ওনার স্ত্রী তৃণা দাস.
তারপর সবটা শুনে তখনকার মতো ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানাই পাড়ায় আসা নতুন অতিথি আবীর কে.!
আবীর মল্লিক, ইন্জিনিয়ারিং কলেজের সেকেন্ড ইয়ার স্টুডেন্ট, কলেজে তার বিশাল নাম ডাক, দূর্গাপূরে আসা শুধু মাত্র পড়াশোনার সুত্রেই.
বাড়িতে বাবা -মা আর ঠাকুমা ছাড়া কেউ নেই, মধ্যবিত্ত পরিবারের খুব গুনি একটা ছেলে, সবার খুব প্রিয়, তবে একটু লাজুক প্রকৃতির, খুব চুপচাপ থাকে সবসময়, কখনও কারো বিপদ হলেই ছুটে যায় সেখানে আগে, এককথায় পরোপকারী.
এরপর সপ্তাহখানেক তৃষাকে আর দেখা যায়নি ছাদে, বা কলেজ যাওয়ার পথে.
যদিও ছটফট করছিলো আবীরের মন তাঁকে একটু দেখার জন্য, কেমন কি আছে জানার জন্য, কিন্তু উপায় ছিলো না, তবুও প্রতিদিন ই সে টাইম মতো ছাদে উঠে লক্ষ্য রাখতো কখন তৃষা ছাদে উঠবে আর তাকে একটু দেখবে, মনে মনে তাঁর প্রতি একটা টান সৃষ্টি হয়ে গেছিলো, রাত-দিন শুধু তৃষার কথায় ভাবতো.
একদিন কলেজ যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই আবীরের বাইক টা যায় খারাপ হয়ে,
কাছাকাছি কোথাও মেকানিক না পাওয়ায় বেশ আনমনা বশতঃ বাইক হাতেই হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল পথ ধরে, যদি কোথাও মেকানিক পাওয়া যায়!
আরে কি হলো, গাড়ির কি ব্রেক ডাউন, আচমকাই মেয়েলি কন্ঠে পিছন ফিরে চাই আবীর, স্তব্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণ, বোকা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে হাঁ করে, বুকের ভিতর তখন আনন্দের রেষ খেলা করে, এ কাকে দেখছে, মেঘ না জমতেই বৃষ্টি.?ক্ষনিকের হাজার প্রশ্ন তাকে ঘিরে ধরে, অধীর অপেক্ষার ফল যে এইভাবে সে পাবে সেটা তার ভাবনার বাইরে ছিলো,
হ্যালো, কি হলো.? আবারও হকচকিয়ে উঠলো আবীর তৃষার মিষ্টি কন্ঠে..
না, হ্যাঁ, বাইক টা হঠাৎ মাঝপথে খারাপ হয়ে যায়. তাই আর কি মেকানিকের খোঁজে যাচ্ছিলাম, এই বলেই আবীর আবার লাজুক ভাবে হাঁটা শুরু করে নিজপথে!
সেই প্রথম দেখা আর কথা তাদের, খুব ভালো বন্ধুত্ব হলো দুজনার মধ্যে, তারপর থেকেই কোনও না কোনও বাহানায় একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ কলেজের বাইরে কখনও কলেজ ক্যান্টিনে, আর সন্ধ্যায় ছাদে-ছাদে, রাতে মোবাইলে কথা না বললে চলতোই না, ধীরে ধীরে কখোন যে বন্ধুত্বটা দুর্বলতার পর্যায়ে পড়েছিলো বুঝতেই পারেনি
দু-জনে, পরস্পর পরস্পরের প্রতি একটা টান অনুভব করতো সবসময়. তাদের বন্ধুত্বটা আরো গাড়ো হতে থাকলো সময় বিশেষে,ছোট খাট পছন্দ অপছন্দ শেয়ার করতো একে-অপরে, যদিও
ভালোবাসা এখন তাদের উচ্চ শিখরে,অন্তরঙ্গ ভাবে জাল বুনেছে বেশ গভীরে.
দুজনার এক সাথে পথ চলা, মাঝে মাঝে একটু ভালবাসা-ঝগড়া, মানিয়ে নেওয়া সব কিছুর মধ্যেই একটা দুর্বলতা কাজ করছিলো তাদের মধ্যে.
তারচেয়েও অনেক অনেক বেশি সবকিছুর ঊর্ধে শুধুই ছিলো তাদের ভালবাসা.
চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছিলো তাদের ভালোবাসা,
লোকমুখেও শোনা যাচ্ছিল অনেক কানাফুসি,
তারপর কত ঝড় ঝাপটা, দুজনের পরিবারে জানাজানি, কোনও পরিবারই ব্যাপার টা মেনে নিতে পারলো না, প্রচন্ড প্রেম বিরোধী ছিলো দুই পরিবার, কিন্তু আবীর আর তৃষা কোনোভাবেই হাল ছাড়েনি সেইসময়.
পড়াশোনায় কিছুটা ক্ষতি হলেও রেজাল্টের দিক থেকে দুজনায় নতুন ক্লাসে পদার্পন করাতে বেশ খুশি ছিলো দুই পরিবার.
এরই মধ্যে একবছর যেতে না যেতেই তৃষার বাবা অঞ্জন বাবু হঠাৎ করেই কোথা থেকে ভালো পাত্রের খোঁজ পেয়ে একেবারে মেয়ের বিয়ের পাকা কথা ঠিক করে ফেলে মেয়েকে না জানিয়ে,
ব্যাশ, লাগবে তো লাগুক আগুন টা ওখান থেকেই দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠলো,
মেয়ের মা মেয়েকে শোনাতেই মেয়ে চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্নাকাটি জুড়ে দিলো,
সেই তারও একজেদ বিয়ে সে এখন করবে না.
বাবার কানে এইকথা জেতেই বাবা ধমক দিয়ে ঘরের ভিতর বন্দি করে রাখলো.
পাকা কথা দেওয়ার পর এইসব শুনতে তিনি একদমই নারাজ.
ঘরের মধ্যেই নিজেকে দিন-দুয়েক বন্দি রাখার পর অনেক অনুনয় বিনয় করে তৃষা কলেজের বাহানায় আবীরের সাথে দেখা করে কলেজ ক্যান্টিনে, তাঁকে যেনও শীঘ্রই সে বিয়ে করে, না হলে আত্মঘাতী হবে বলে চাপ দেয়, আবীরের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ে, সে বুঝতে পারে না এ কিরকম কথা তৃষা তাঁকে শোনাচ্ছে, কি করে সম্ভব ?
সে যে এখনও পড়াশোনা করছে, তাদের আর্থিক অবস্থাও সেরকম স্বচ্ছল নয়,তাঁর মায়ের সমস্ত জমানো পূঁজি আর বাবার মেহনতের টাকা দিয়েই আজ এই বাড়ি আর পড়াশোনার খরচ বহন, সেখানে কি করে পালিয়ে বিয়ে করবে সে.?
আবার বাড়ির একমাত্র ছেলে, সব কিছু নির্ভর পরবর্তী প্রতিষ্ঠানের ভার-দায়িত্ব সব কিছুই আবীরের নিজের উপর.
এখন বিয়ে করলে তাদের পরিবার সমেত যে পথে বসতে হবে..!
এইকথা শুনেই বিগড়ে যায় তৃষা, চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে, এলোপাতাড়ি মারতে থাকে আবীর কে, তাঁকে নাকি যাহোক একটা ব্যবস্হা করতেই হবে আজকালে, আবীর কোনও পথ খুঁজে পায় না, বুকের মধ্যে একটা তোলপাড় করা ঝড় বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়, একরাশ জল চোখে শুধু বলে 'ফিরে যাও' তৃষা.. পারলাম না তোমার কথা রাখতে, পারলাম না আমাদের ভালোবাসার শেষ রক্ষা করতে, এই বলেই মুখ নামিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো আবীর,
স্তম্ভিত হয়ে গেলো আশেপাশের সবকিছু, গোটা পৃথিবীটা যেনও থমকে গেলো তৃষার কাছে,
শুধু একবার মাত্র বিড়বিড় করে বলে উঠলো- আরেকবার ভেবে দেখ প্লিজ,
পারছিনা কিচ্ছু ভাবতে এই মূহুর্তে, যাও ফিরে যাও বলেই আবারো হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো আবীর.
নিমিষেই মনে হলো সব শেষ, শরীরের প্রতিটি পেশি যেন অশার হয়ে পরেছিলো তৃষার.
মূকবধিরের মতো ফিরে গেলো একরাশ হতাশা নিয়ে, ঘরে ঢুকেই কারোর সাথে কথা না বলে সেই যে খিল দিলো, সত্যি আর ফিরে দেখলো না এই পৃথিবীটাকে, ফিরে দেখলো না তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে, এতোটাই ভালোবেসেছিলো সে আবীর কে..!
এইভাবেই নিভে গেলো ভালোবাসার আর এক জলন্ত প্রদীপ.
জীবনে সবকিছু পাওয়ার পরও একটা অতৃপ্ত চাঁপা কান্না জীবনের সকল প্রাপ্তিকে তার ছায়ায় ঢেকে ফেললো.!