অপ্রেমের খিদে
অপ্রেমের খিদে
ভীষণ একটা নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে বড়ো রাস্তার গা ঘেষে থাকা হলুদ রঙের বাড়িটাকে। ভীত-সন্ত্রস্ত ভেজা বিড়ালের মতো বাড়ির উপরতলার জানলাগুলো যেন ঝড়বেগে চলে যাওয়া গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সেই জানালার উপর থেকে ঝোলা লাল রঙের সিফনের পর্দাটাকে প্রচণ্ড জোরে চেপে ধরে একটা থমথমে কণ্ঠ প্রশ্ন করলো-
‘আজকের কাগজটা দেখেছিস?’
ইভানের প্রশ্নে নতুনত্ব কিছু না থাকলেও তার গলাতে বেশ উদ্বেগের ছাপ ছিল। মনে হচ্ছিলো, তার গোটা শরীর যেন কোনো দুঃস্বপ্ন ঘিরে রেখেছে। কিন্তু, তমালের মতে ইভানের এইরকম কথায় খুব একটা পাত্তা না দেওয়াই শ্রেয়। তাতে শরীর ও মন দুই সুস্থ থাকে।
তমাল খবরের কাগজে ভয়ানক কিছু থাকার আশঙ্কা করে বলে, ‘কি আর দেখবো; হতে পারে, হয়তো কোন ছয়বছরের শিশুর ধর্ষণ হয়েছে অথবা ত্রিকোণ প্রেমের একটি কোন হয়তো কেউ মুছে দিয়েছে। কাগজ দেখে বুক ছলকে ওঠার মতো কিইবা আর আছে? গোটা শহর জুড়ে শুধু অমানুষের আস্তানা আর নিচু মানুসিকতার প্রমান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে’।
ইভান শুকনো গলায় বলে, ‘তার থেকেও ভয়ানক কিছু আছে। তুই তিন নম্বর পাতার বামদিকের আর্টিকেলটা পড়’।
‘আহা! যাই হয়ে যাক, তুই ওতো ভয় পেয়ে আছিস কেন? অবশ্য দিনে একবার করে ভয় পেয়ে ফোনের বিল না তুললে তোর তো আবার রাতে ঘুম হয়না,’ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল তমাল।
বছর পঁচিশের ইভানের ভয় পাওয়াটা আসলে একটা রোগ। Post Traumatic Stress Disorder তার একনিষ্ঠ সঙ্গী। কোন বিষয় নিয়ে হঠাৎ করে খুব রেগে যাওয়া, রাতে ভয়ানক খারাপ স্বপ্ন দেখা, নেগেটিভিটিতে মন ছেয়ে যাওয়া, এর কোনটাই তার জন্মগত নয়। দুবছর আগে সেই মেয়েটার বলে যায় কথাগুলো, এখনও তার সেই প্রানজ্জ্বল মনকে একটা গুমঘরে খুন করে ফেলে রেখেছে। কবে তাতে প্রান পাবে, তা জানে না কেউ। তাই, তমাল বন্ধু হিসেবে মাঝে মাঝে তাকে বকাবকি করলেও, তার ক্ষতচিহ্নগুলোর সাথে সে পূর্বপরিচিত।
‘আছিস?’ হাওয়ায় প্রশ্ন করে তমাল।
ইভানকে তখনও অন কল দেখাচ্ছিল ।
‘হ্যাঁ; হেডলাইনটা পড়লি?’
সে জোরে জোরে লাইনগুলো পড়ে, ‘ব্যাচেলার ছেলেদের পার্স থেকে তাদের প্রেমিকার ছবি উধাও; সাত দিনের মাথায় প্রেমিকারা নিখোঁজ’।
তমাল এমনিতে খুব সাহসি ছেলে। এ বয়সের ছেলেদের গলায় এতটা গাম্ভীর্য খুবই চোখে পড়ার মতো। তবে শেষের শব্দ গুলোতে তার স্বরটাও ফিকে হয়ে এলো। শুধুমাত্র, ইভানের, ভয় দুরদুর করা মনটাকে ভুল বুঝিয়ে শান্ত করার জন্য সে বলল, ‘শোন ইভান, এসব খবর ওই গুজব টাইপের। কোনো একজনের হয়তো কাকতালীয়ভাবে ছবি উধাও আর প্রেমিকার অন্য ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া একসাথে হয়েছে; আর রিপোর্টার গুলো তো মাটি খোঁড়ে খবর বার করার জন্য। দেখ, হয়তো এটাও সাবস্ক্রাইবার বাড়ানোর কোন নতুন প্ল্যান। তুই এতো চাপ খাস না’।
তবে মন কি আর মানে যখন ভয় বাহকেরই ভয় পেতে ইচ্ছা করে।
ইভান একটু গম্ভীর গলায় জবাব দেয়, ‘শুধু ক্যাপসান পড়ে নিজের যুক্তি সামনে রাখবি না। ভিতরের লেখাটা পড়। আর শোন, মেয়েজাতি নিয়ে তোর অস্বাস্থ্যকর চিন্তাভাবনা দূর কর’।
‘কেন? কি এমন আছে?’
‘ছয়টা ছেলের সাথে এমন ঘটনা ঘটেছে। ছয়টা আলাদা জায়গা। আর সবার বাড়িতে দুদিন পর একটা করে বেনামী চিঠি গেছে। দরজার সামনে কেউ রেখে গেছে’।
কৌতূহলী তমাল জিজ্ঞেস করে, ‘কি ছিল চিঠির মধ্যে?’
‘রঙিন কাগজের উপর কন্সটানিয়া স্টাইলে লেখা ছিল UNICORN আর একদম শেষে মাস-সহ একটা তারিখ। পুলিশ তদন্ত করছে, তবে পুরোটা পড়ে যা বুঝতে পারলাম, কোনো কিনারাই এখনও করতে পারেনি,’ ইভান উত্তর দিল।
তমাল একটু হাঁফ ছেড়ে বলল, ‘ব্যাপারটা খুব একটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। তুই একটা কাজ কর; আজকের লাঞ্চটা আমার বাড়িতে সেরে ফেল। তারপর ফিজিক্সের সেকেন্ড সেমিস্টারের পড়াটাও একটু হবে আর এই বিষয়টা নিয়ে একটু কালটিভেটও করা যাবে’।
তমাল ও ইভান একই কলেজ থেকে এম.এসসি করছে। ছোটো থেকেই স্কুল, টিউশন, প্রিয় খেলোয়াড় সব এক। নাহলে, কলিযুগে আর বন্ধুত্ব টেকে কোথাও। যোগাযোগের অভাবে, পছন্দ-অপছন্দের অমিলে কিংবা স্ট্যাটাসের ফারাকে, সম্পর্কগুলো শুধু ভেঙেই চলেছে। যাইহোক, তখন দুপুর দেড়টা। নিধিরাম টেবিল জুড়ে সপ্তপদ সাজিয়ে রেখেছে। রান্নার গন্ধে তমালের খিদে তখন তুঙ্গে। ইভান কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই ভেজা ভেজা ঠোঁট নিয়ে তমাল বলে, ‘ভাইটি, ভেটকি মাছের পেটিগুলো কিভাবে তাকিয়ে আছে দ্যাখ, আর বাটি থেকে উঠে থাকা মটনের হাড়টাতো একেবারে লালায় লাবেঞ্চুস করে দিচ্ছে আমার মুখটাকে’। তারপর ইভানের হাতটা একপ্রকার টেনে নিয়ে তাকে চেয়ারে বসায় তমাল।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে তারা স্টাডিরুমে যায়।
‘তোকে একটা ইম্পরট্যান্ট কথা বলার আছে,’ স্টাডিটেবিলের উপর হাত ঘষতে ঘষতে ইভান বলল।
‘সব শুনবো। তুই আগে হাজমোলাটা নে; দারুন টেস্ট,’
তমালের কোথায় গুরুত্ব না দিয়ে ইভান বলতে শুরু করে, ‘ভিকটিমদের নাম গুলো দেখেছিস? যে ছয়জনের নাম আছে, তাদের মধ্যে পাঁচজন আমাদের হাইস্কুলের আর একজন B.SC করার সময় ব্যাচমেট ছিল।
নামগুলো স্বচক্ষে দেখে, তমালের চোখে আসা ভাত-ঘুমের বারোটা বেজে পাঁচ। বেচারা তমাল, ভেবেছিল, সাতশো টাকার মটন খেয়ে নাক ডাকিয়ে একটু শীতঘুম দেবে। ছয়টা ছেলের জন্য নয়, তার চিন্তা হচ্ছিলো ইভানের জন্য। সে ইভানকে প্রশ্ন করে, ‘সৌম্যদীপার সাথে কথা হয়েছিল কাল?’
তমালের এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য বুঝতে পারে ইভান। সে কাঁপা স্বরে উত্তর দেয়, ‘তুই কি বলতে চাইছিস আমার সাথেও...’।
তাকে থামিয়ে দিয়ে ধমক দেয় তমাল, ‘চুপ একদম। আমি কখন তোকে এটা বললাম? তোর এই ধরে নেওয়া স্বভাবটাই তোর কাল। এই ধরে নেওয়ার কারনেই সৌম্যির সাথে তোর ঝগড়া হয়েছিল আর তার জন্য লাইফে কি এসেছিল বলে দিতে হবে?’
তমালের এই বকাঝকার মাঝে মাথা নিচু করে বসেছিল ইভান। বোধহয়, অতীতের কিছু কালিমালিপ্ত দিনের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। সেই রাত; সেই লেটনাইট পার্টি।
ব্র্যান্ডি, হুইসকি, শ্যাম্পেন, এসব নানা বিদেশি মদের সমাহারে আর রসাত্মক গন্ধে পার্টি বেশ জমে উঠেছিল। সৌম্যদীপার বার্থডে উপলক্ষে তার ওভার-স্মার্টলুকওয়ালা বন্ধুরাই এসবের আয়োজন করেছিল। ঠিক সেইসময় ইভান সবে দরজা পেরিয়ে ডিস্কো লাইট আর গমগম করা মিউজিকের মাঝে এসেছে, ভেবেছিল সৌম্যি তাকে দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরবে অথবা দেড়ি হবার জন্য বকবে। কিন্তু, এর কোনোটাই হয়নি। তাদেরই ক্লাসমেট আখিলের সাথে বলডান্স করতে দেখে ইভানের হাত থেকে গিফটের প্যাকেটটা পড়ে যায়। সৌম্যির কোমরটা জাপতে ধরে ছিল আখিল। ইভান রাগটা আর চেপে রাখতে না পেরে, সৌম্যির হাতটা সর্বশক্তি দিয়ে ধরে দাঁত কিরকির করতে করতে তাকে বাইরের বাগানে নিয়ে আসে।
সৌম্যদিপা চেঁচায়, ‘ছাড় ইভান! লাগছেতো! ছাড় বলছি আমাকে!’
‘আখিল যখন তোর কোমরটা ধরেছিল, তখন লাগছিল না? আমি আসিনি বলে অন্য পার্টনার জুটিয়ে নিয়েছিস! ছেলেধরা নাকি রে তুই?’
‘মানে? তুই আমাকে এই চিনলি?’
ইভান আর সৌম্যির বচসা যখন তুঙ্গে, তখন ইভানের চোখ কিচ্ছুক্ষণের জন্য ডান্সফ্লোরের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে যায়; একদৃষ্টে মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে ছিল। দূর থেকে হলেও মেয়েটার চোখের অদ্ভুত চাহনি ইভানের কানে কিচ্ছুক্ষণের জন্য তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। সৌম্যি যে এতক্ষণে ইভানের দেওয়া ব্রেসলেটটা সবুজঘাসে ফেলে দিয়েছে, তা খেয়াল করেনি ইভান।
‘কিছু বলছিলিস তুই?’ ইভান অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
সহাস্য সৌম্যি উত্তর দেয়, ‘বাব্বা! এখন আর কথাও শুনতে পাচ্ছিস না? কোথায় গেল তোর বিশ্বাস? তুই থাক তোর ভাবনা নিয়ে, আমি চললাম’।
কোনো উত্তর দেয়না ইভান।
ইভান আবার একবার পার্টিতে ঢুকল। তার দিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটিকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই ওইভাবে তাকিয়ে ছিলিস কেন?’
মেয়েটার নাম অপয়া। মেয়েটা অপয়া কিনা সেটা জানা নেই ইভানের। সে তমালেরও ব্যাচমেট। ইভানের প্রশ্ন এড়িয়ে সে বলল, ‘বড়োলোকের এসব শহুরে মেয়েরা একটা ছেলের সাথে বেশিদিন থাকতে পারেনা। তাই এদের থেকে বেশিকিছু এক্সপেক্ট করো না। ইভান মৃদু মাথা নেড়ে আপসোসের কণ্ঠে বলল, ‘সে আমি বুঝেছি। একবার একটা সরি পর্যন্ত বলল না’।
‘এইসবকারনে এই চকমকে পার্টি বরবাদ করার কোন মানে নেই,’ বলল অপয়া।
খুব অদ্ভুতভাবে ইভানের হাতটা অপয়া ধরে ডান্সফ্লোরে নিয়ে যায়। তারপর যা হলো...।
‘এই, কিরে? কোন মহাসাগরে ডুব দিলি? আটলান্টিক নাকি প্রশান্ত?’ ইভানের কাঁধে হাত চাপড়ে বলল তমাল।
ইভান খানিক ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে এবং একটু নড়েচড়ে বসে ছেড়ে যাওয়া গল্পের সুতো টেনে পকেট থেকে ফোনটা বের করল।
‘তমাল? হোয়াটসঅ্যাপে সৌম্যির একটা ভয়সনোট (Voicenote) এসছে’। ইভানের হাতটা একটু কাঁপতে আরম্ভ করেছিল। তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে তমাল ভয়সটা প্লে করলো।
‘বাঁচাও! বাঁচাও! ইভান! ও আমাকে নিয়ে যাচ্ছে! আ!!!..’। মুহূর্তের মধ্যে নিভে এলো চিৎকারটা। কণ্ঠস্বরটা যে সৌম্যির তা চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি কারোর।
শেষের চিৎকারটা শুনে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো কোনোকিছু দিয়ে জোরে আঘাত করা হয়েছে তাকে। উল্টোদিকে বসে থাকা ইভানের ঘাড়ে তখন ঘাম জমেছে। পায়ের নিচটাও থরথর করে কাঁপছে।
‘কবে এসেছে ভয়েসটা?’ ধরা গলায় প্রশ্ন করে ইভান।
‘দুদিন আগে। বিকেল চারটে নাগাদ’।
‘হিসাবমতো আজ তাহলে একটা চিঠি আসার কথা, তাইতো?’ ইভান ডিজিটাল ক্লকটার দিকে তাকিয়ে বলে।
ঘড়িতে তখন তিনতে পঞ্চান্ন।
তমাল বিছানা থেকে নেমে জগ থেকে জল খেতে যাচ্ছে, তখনই বেজে উঠল কলিং বেলটা।
‘দাঁড়া, আমি দেখছি’, তমাল এই বলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। তবে দরজা খুলে গায়ে শীতের সূর্যাস্তগামী রোদ লাগা ছাড়া আর কিছুই পায়না সে। দরজা বন্ধর সময় তার পায়ে কিছু একটা ফোটার মতো অনুভব করে। নিচে তাকিয়ে যা দেখেছিল, তাতে তার হাড়হিম হয়ে গিয়েছিল; একটা গেরুয়া রঙের এনভিলপ।
ঘরে ঢুকতেই অপ্রত্যাশিতভাবে বলে ওঠে, ‘চিঠি এসছে তাই না?’ যেন প্রশ্ন নয়, নিশ্চিত হচ্ছিলো ইভান। কোনো প্রত্যুত্তর না করে এনভিলপটা বাড়িয়ে দেয় তমাল।
‘আমিই খুলবো?’ প্রশ্ন করে ইভান।
‘হুম। তোর গার্লফ্রেন্ড হারিয়েছে। এটা তোর কাজ’।
গলা ভারী করে উত্তর করে ইভান, ‘ও এখন শুধুমাত্র বন্ধু ছাড়া আর কিছু নয়। দেখ হয়তো, ইতিমধ্যেই কোনো লাইফ পার্টনার পেয়ে গেছে,’ বলেই নিজের মনকে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কিন্তু, তাহলে আমার কাছে চিঠি এলো কেন?’
নীলরঙের একটা মোটা আর্টপেপারের চারভাগের একঅংশ। বড়ো করে কন্সটানিয়া ফন্টে লেখা আছে ‘UNICORN’। আর একদম নিচে আছে একটা তারিখ। সেটা দেখে তমাল আর ইভান দুজনেই পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
‘তাহলে কি ওই সব করছে?’ তমাল আশঙ্কার কথা জানায়।
ইভান হকচকিয়ে উত্তর দিল, ‘নানা! সে কিকরে সম্ভব? তাকে B.SC এর সেকেন্ড সেমিস্টারের পর থেকে আর দেখাই যায়নি’।
‘আচ্ছা, অন্য কেউও তো হতে পারে? মানে তারিখটা অন্য কিছুও তো নির্দেশ করতে পারে? এই মাসেই কি হয়েছিল ব্যাপারটা? বুঝতে ভুল হচ্ছে না?’
ইভান মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘মানুষের জীবনের কালোদিনগুলো অনেকটা শ্যাওলার মতো। দিন যত অতিবাহিত হয়, অপরাধবোধগুলোও চারিদিক দিয়ে একেবারে খামচে ধরে। তাই, মাস-দিন-ক্ষণ কোনটাই ভুল হবার কিঞ্ছিত সম্ভাবনা নেই’।
‘এই UNICORN শব্দটারই বা অর্থ কি?’
তমাল বলার সঙ্গে সঙ্গে ইভান গুগুলে খুঁজতে শুরু করে দিয়েছিল। স্ক্রল করতে করতে ইভান জানায়, ‘ইউনিকর্ণ বলতে প্রাচীনকাল থেকে একটা পশুকে বোঝায় যাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখতে এবং সে একশৃঙ্গ। দেখতে অনেকটা আমাদের ওই পক্ষীরাজের মতো’।
কিছুক্ষণ ইউনিকর্নের ছবিগুলো একমন দিয়ে দেখে তমালকে প্রশ্ন করলো সে, ‘একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?’
‘কি?’
‘এই ইউনিকর্নের ছবিগুলোর সাথে রামধনুর বেশ কয়েকটা রং কিন্তু প্রায় সব ছবিতে আছে। এই রামধনুর রংগুলো একসাথে আর কোথায় দেখা যায়, বলতে পারবি?’ ভ্রুরু তুলে প্রশ্ন করে ইভান। সে কিছু একটা আবিষ্কার করার চেষ্টায় তখন মেতেছে।
দুপাশে মাথা নাড়ে তমাল।
‘LGBT কমিউনিটি কি, তা জানিসতো?’ আবিষ্কারক ইভানের গলায় তখন মৃদু কনফিডেন্সের ছাপ পড়েছে। তমাল এ বিষয়ে জ্ঞানশূন্য তা বুঝে, সে বলতে শুরু করে, ‘সমাজের চোখে ঘৃণিত এই কমিউনিটিকে আলাদা করে বোঝানোর জন্য তাদের নিজস্ব একটা ফ্ল্যাগ আছে যার রঙ হুবহু রামধনুর কিছু রঙের সাথে মিলে যায়। আর আমরা যাকে আশঙ্কা করছি সেওতো...।
‘আর দেরি করা একদম ঠিক হবে না’। এই বলে তমাল একটা নম্বর দায়াল করতে করতে ক্ষিপ্রবেগে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায়। কারোর সাথে বেশ অনেকক্ষণ কথা বলতে থাকে। কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টায় ছিল বলে মনে হচ্ছিলো। ফিরে এসে সে জানায়, তার বাবার বন্ধু ইন্সপেকটার অয়ন রায়কে খবর দিয়েছে; মিনিট কুড়ির মধ্যে তাদের বাড়িতে আসবে অয়নবাবু।
বাইরে তখন সন্ধ্যে নেমে এসেছে। গুটিকতক পাখির বাসায় ফেরার ডাক তখনও শোনা যাচ্ছে। নিধিরাম ইতিমধ্যেই ডাইনিং টেবিলে তিন কাপ চা রেখে গেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘তোমার সাথে এ ঘটনার যোগ কি?’ মোটা ফ্রেমে ঢাকা চোখ ছিল ইভানের দিকে। বলিষ্ঠ চেহারা, কলপ করে অতিযত্নে আছড়ানো চুল, সাদা সিভিল ড্রেসে থাকা ইন্সপেকটার অয়নের বয়স যে প্রায় ছাপান্ন বছর তা বোঝা বেশ জটিল ছিল।
আড়ষ্টভাবে বসে থাকা ইভান ক্ষীণস্বরে জবাব দেয়, ‘এই তারিখটা। মনে হচ্ছে, আমার জীবনের সেই দিনটাই নির্দেশ করছে’।
‘কেন? কি ঘটেছিলো সেদিন?’ চায়ের কাপ তখন টেবিলে, হাতটা থুতনির কাছে রাখা।
তমালের দিকে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে তাকায় ইভান। তমাল বলে, ‘কাকাবাবু, আমি আপনাকে সবটা বলছি’।
‘পার্টির সেই রাতের কথা তো আপনাকে বলেছি। সেইদিনের পর থেকে অপয়ার সাথে ইভানের ঘনিষ্ঠতা বেশ হয়েছিল। সৌম্যদিপা আর আখিলকে একটা ঘরে ঢুকতে দেখে, ইভান আর নিজেকে সামলাতে পারেনা। অপয়ার, কাঁধে হাত রেখে বলা কথাগুলো খুব সত্যি মনে হয়েছিল ইভানের। আর একপ্রকার বেপরয়াভাবে অপয়াকে ভালোবেসে ফেলে সে তার সাথে শারীরিকভাবেও ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। অপয়ার যে ইভানের প্রতি বেশ গভীর আবেগ ছিল, তা আমি আঁচ করেছিলাম অনেক আগেই। প্রায় একমাস ধরে তাদের সম্পর্কটা বেশ জোরালো আকার ধারন করেছিল, বলাবাহুল্য, দুজনেই দুজনকে একপ্রকার চোখে হারাতে শুরু করেছিলো’, একটা হাঁফ ছাড়ে তমাল।
সিলিঙের দিকে তাকিয়ে একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ‘কিন্তু গণ্ডগোলটা হলো ১৪ ই ডিসেম্বর, রাত ৮ টায়। অপয়া তখন ইভানের ঘরে। কফি আর চিপ্স আনতে আনতে প্রানজ্জল ইভান ঠোঁটের কোলে হাসি খেলিয়ে বলে উঠল, ‘দেখতো অপু, কেমন বানালাম কফিটা’।
‘ওসব পরে হবে,’ অপয়ার স্বর অন্যদিনের মতো ওতটা মিষ্টি ছিল না। সে বলল, ‘আমি কিছু বলতে চাই তোকে। বলতে পারিস, স্বীকার করতে চাই কিছু’। স্টাডিল্যাম্পের আলোয় অপুর চোখের মণিটা তখন বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।
‘কি? বল না। এতো সঙ্কোচ কিসের? হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান আছে নাকি রে?’ ইভান একটু হাসল। তবে অপুর মুখের আনাচে-কানাচে বিন্দুমাত্র হাসি ছিল না।
‘তুই আগে প্রমিস কর, সবকিছু শোনার পরও তুই আমাকে ছেড়ে যাবি না’। একটা ইনসিকুইরিটির ছাপ ছিল তার গলায়।
‘আচ্ছা বাবা, এই দেখ, তিন সত্যি; এবারে বল, কেসটা কি? মনে হচ্ছে জন্ডিস নয়, একেবারে টিউবারকিউলোসিস’।
চেয়ার ছেড়ে উঠে অপু যা বলল, তাতে ইভানের শরীরের ভিতর বাজ পড়ার মতো কম্পন হলো। ‘আমি কিন্তু জন্ম থেকেই মেয়ে নয়। অপারেশান করে মেয়ে হয়েছি। মানে মেডিকেল সায়েন্সর ভাষায় ট্রান্স-ওম্যান’।
ইভান প্রথমটা একটু হকচকিয়ে গেলেও, সে অট্টহাসি হেসে বলে, ‘ক-প্যাকেট গাঁজা গিলেছিস রে?’
মুহূর্তে উত্তর আসে, ‘আমি নেশায় নেই। জন্মগত মেয়ে না হতে পারি কিন্তু মনটা পুরো নারী আর দেহটাও; আর তোকে আমি আমার সবটা দিয়ে ভালবেসেছি’। এই বলে অপু যখন ইভানের দিকে এগিয়ে আসতে যাচ্ছিলো, তখন ইভান তাকে থামিয়ে অত্যন্ত তীক্ষ্ণস্বরে বলল, ‘একদম কাছে আসবি না। সরে যা..সরে যা বলছি..। দুগজ দূরে সরে গিয়ে ইভান বলে, ‘তুই মানে, আগে ছেলে ছিলিস। আর আমি তোর সাথে...ছিঃ!’ আঁতকে ওঠে ইভান। ‘তুই ঠকিয়েছিস আমাকে। বেরিয়ে যা এক্ষুনি’।
করুন স্বরে অপয়া বলে,’বিশ্বাস কর! ঠকাবো না বলেই সব বলে দিলাম, যাতে তুই আমাকে, আমার নিজস্বতাকে ভালোবাসিস। এর আগে সবাই শুধু আমার শরীর নিয়ে সুখ ভোগ করেছে, কিন্তু কেউ এই নির্মম সত্যিটা জানার পর আমাকে ভালবাসেনি; কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, তুই অন্তত...।
চেঁচিয়ে ওঠে ইভান, ‘এর আগে কটা ছেলের সাথে তুই শুয়েছিস? তুই এটা ভাবলি কিকরে সব জানার পরও আমি তোকে মেনে নেব? এটা জীবনের ব্যাপার, সোসাইটি কি বলবে? জাস্ট গেট লস্ট’।
অপয়ার চোখ তখন জবা ফুলের মতো টকটকে লাল। ইভানের জামার কলারটা টেনে ধরে টেবিলে থাকা ছুড়িটা একেবারে ইভানের চোখের সামনে নিয়ে গিয়ে শয়তানের হাসি হেসে বলে, ‘তোকে মেরে দেব? না! এভাবে তো মারবো না। ভালোবাসার মানুষকে হারালে কেমন লাগে সেটা আগে বোঝাবো। তোর বুকের কাঁচা রক্ত একেবারে জল করে দেব। বাবার গোডাউনটা আর আমার কাঁদার ঘর থাকবে না, ওটা একদিন মৃত্যুকূপ হবে; প্রেমিকাদের মৃত্যুকূপ’। এই বলে অপয়া ছুড়িটা মাটিতে ফেলে ঝড়পালানো কাকের মতো রুদ্ধশ্বাসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
‘ব্যাস এই হচ্ছে ইভানের গল্প। পুরোটা ও রেকর্ড করে আমাকে শুনিয়েছিল বলেই, এভাবে বলতে পারলাম। এরপর থেকেই নানাধরনের ভয় কাজ করে ওর মনের মধ্যে’, তমাল অয়নবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল।
ইভান তখনও জানলার বাইরে বুড়ো ল্যাম্পপোস্টের মুখের দিকে চেয়ে আছে। গম্ভীরশ্রোতা হয়ে বসে থাকা ইন্সপেকটার অয়ন হাতে ফোন নিয়ে বলে, ‘আমি ফোর্স রেডি করতে বলছি’। তবে ইভান তাকে বাঁধা দিয়ে বলে যে, সে একাই যাবে ওই গোডাউনে। তমাল বুঝতে পারে, অপুর সাথে বোঝাপড়াটা সে একা করতে চায়। ভ্রুকুটি কুঁচকে, তার কাকাবাবুকে কিছু একটা ইশারা করে তমাল ।
ইভানের হাতে গাড়ির চাবি তুলে দিয়ে, তার কাঁধে হাত রেখে চাপা কণ্ঠে বলে, ‘সাবধানে যাস। সৌম্যদিপা তোর অপেক্ষায় আছে’।
চারিদিক নিস্তব্ধ অন্ধকারে ঢাকা। গোডাউনটার বাঁদিকের দেয়াল ফাটিয়ে অশ্বত্থগাছ তার হাত-পা মেলে আছে। তবে, দরজার সামনেটা একদম পরিষ্কার। কাউকে টেনে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার দাগ স্পষ্ট। ইভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজাটা খুলতেই একটা মিষ্টি গন্ধ তার নাকে আসে। মুহূর্তে সে ঠাহর করে ফেলে, গন্ধটা অপুর পারফিউমের। চার্জ না দেওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা। ঘরের ভিতরটা তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনে সাহসটাও নিভুনিভু। কিছুটা এগোতে, ডানদিক থেকে আসা একটা আলোর আভা ইভানের নজর কাড়ে। পায়ে থাকা কালো স্যান্ডেলটা পাশে খুলে রেখে সে এগোয়। তবে, ঘরে ঢুকে যা দেখলো, তাতে তার রক্ত সত্যিই জল হয়ে গিয়েছিলো। মেঝেতে কালচে রক্ত দিয়ে ইংরেজিতে লেখা ‘Ivan Weds Apu’; তার চারিধারে জ্বলন্ত মোমবাতিগুলো হার্টশেপে রাখা আছে। সেখান থেকে চোখ তুলতেই ইভানের আত্মারাম খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার মতো উপক্রম হয়েছিল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে অপু। মুখের সামনে চুলের বেশ খানিকটা অংশ নেমে এসেছে, পরনে লাল বেনারসি শাড়ি, হাতে সোনার বালা, পায়ে নুপুরের ছমছম শব্দ।
‘এ..কি.. তু..তুমি?’ ইভানের শুকনো গলা দিয়ে অনেক কষ্টে স্বর বেরোল।
‘হাহা! ক্রিমিনালকে দেখে এতো সন্মান? ‘তুই’ থেকে একেবারে সিধা ‘তুমি’? কিন্তু, আমি যে সন্মান নয়, ভালোবাসা চাই; যেটা তুই দিবি আমাকে’, শয়তানের হাসি হেসে অপয়া বলে।
ইভানের হাত ধরে কিছুটা নিয়ে গিয়ে আলো জ্বালায় অপয়া। সামনের দৃশ্যটা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করা পাপ। ছয়টা মেয়ে; তাদেরকে অর্ধলঙ্গ অবস্থায় ছয়টা বড়ো জলভর্তি অ্যাকোরিআমে গলা পর্যন্ত ডোবানো। সেদিকে তাকিয়ে অপয়া বলে, ‘এদের সবাই মৃত। এতো সুন্দর দেহ এদের ভগবান দান করেছে যে আর পোড়ানোর ইচ্ছা হয়নি। দেখ! কি সুন্দর জলপরীর মতো লাগছে না? পা-দুটো হিমশীতল জলে কি সুন্দর জুড়ে রয়েছে, দ্যাখ!’।
ইভান আঁতকে উঠে, ‘এ কি করেছিস তুই? তুই পাগল হয়ে গেছিস অপু। তোর চিকিৎসার দরকার’।
তার কথার কোনো জবাব দেয়না অপু। লাল ঠোঁটে বাঁকাহাসি এনে বলে, ‘গোটা শহর জানে, পার্স থেকে ছবি উধাও হবার সাতদিন পর এরা নিখোঁজ হয়েছে। কিন্তু আসলে, এদেরকে তার অনেক আগেই আমি আমার ডেরায় নিয়ে এসেছি। ওই ছয়টা ছেলের সাথে শুধু যোগাযোগটা বজায় রেখেছিলাম। কথা বলতো ওরা, কিন্তু তার নেপথ্যে থাকতো আমার স্ক্রিপ্ট। ওদের দিয়ে এমন এমন কথা বলিয়েছি, যাতে ওই ছেলেগুলোর সাথে ওদের সম্পর্ক একেবারে ভেঙ্গে যায়। তাতে লাভ বই ক্ষতি কিছুই হয়নি। সুলগ্না আর সুস্মিতাতো শোকের বসে শিরাই কেটে ফেলল, তন্ময় আর পুত্রসুখ পাবে না বলে ঝুলে পড়ল। তানিয়া আর সৌম্যজিৎ তো আবার ভিডিওকল করে একে অপরকে বিদায় জানিয়ে দিল। তবে ওই অনিন্দিতা বলে মেয়েটা ভারী খচ্চর; আমার গাঁজার পাঁচটা প্যাকেট শেষ করে দিয়েছে, জানিস? আর বাকিদের খাবারে একটু বিষ দিয়েছিলাম, ব্যাস, খেল খতম’।
ইভানের দমবন্ধ হয়ে আসছিল। মানুষ মরার কথা কি অবলীলায় বলে চলেছে সে; কিঞ্চিৎ পাপ-বোধও কাজ করছে না তারমধ্যে।
অপু ইভানের ঘাড়ের কাছে ফিসফিস করে বলে, ‘ভয় পাসনা, তোকে কিছু করবো না, আমি তো ভালোবাসি তোকে ইভু। আর তুই আমাকে বিয়ে করবি এক্ষুনি’।
তার মুখে থাকা হাসি মোটেই স্বাভাবিক নয়। খুব গভীর শোকের মধ্যে সে আছে এখন।
‘সৌম্যদিপা কোথায়?’ প্রশ্ন করে ইভান।
‘না, আজ আর অন্য কেউ নয়। শুধু অপু আর ইভু। সেই ছোটবেলা থেকে যাদের ভালবেসেছি, তারা সবাই-সবাই আমাকে দূরে করে দিয়েছে। কেউ জন্মদিনের উইশ পর্যন্ত করতো না। মা-বাবাও আমার নাম অপয়া দিল। শুধু সোসাইটিতে পরিচয় দিতে হবে বলে, আমাকে মেয়েতে রুপান্তর করল; এখন অবিশ্যি সেই পরিচয়টাও কেউ দেয়না, ওরা সবাইকে বলে রেখেছে আমি একসিডেন্টে মারা গেছি; চুপিচুপি টাকা পাঠায় শুধু। প্রথম তুই-ই আমাকে অপয়া থেকে অপু বলে ডেকেছিলিস। বদ্দ ভালো লেগেছিল রে; সারাজীবন ডাকটা শুনে যেতে যাই,’ হাঁফ ছেড়ে অপু বাঁদিকের নীল আলোটা জ্বালিয়ে দেয়।
‘ওই দেখ, তোর সৌম্যি’। সৌম্যদীপাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দেখল ইভান। তার মাথায় হাত বুলিয়ে অপয়া বলে, ‘আজ ওর বুক চিড়ে রক্ত নিয়েই তুই আমার সিঁথি রাঙিয়ে দিবি’।
‘তুই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিস অপু,’ ইভান চেঁচায়।
অপয়ার হাত থেকে ছুড়িটা কেড়ে নেবে বলে ইভান পা বাড়াতেই, অপয়ার অন্য এক ভয়ঙ্কর রুপ বেরিয়ে আসে। সে সৌম্যদীপার গলার কাছে ছুড়ি ধরে বাঘিনীর মতো গর্জন করে বলে, ‘আর এক পা এগোলে, মাথাটাই দেহ থেকে আলাদা করে দেব’। থমকে যায় ইভান। অপয়া, সৌম্যির বুকের উপর ধারালো ছুড়ির কোপ বসাতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ বড়ো টর্চের আলো পড়ে অপয়ার মুখে আর গাড়ো নিস্তব্ধতায় গুলীর শব্দটা প্রকট হয়ে ওঠে। আলো আঁধারিতে অপুর চিৎকার শুনতে পায় ইভান। সঙ্গে সঙ্গে, টর্চটা মাটিতে ফেলে তমাল ইভানের দিকে ছুটে গিয়ে বলে, ‘ভাই, তুই ঠিকাছিস?’
ইভান মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ তোরা এখানে? অ্যাড্রেস কে দিল?’
‘আসার সময় পার্সটা ফেলে এসেছিলিস তুই, সেখানেই একটা কাগজে লেখা ছিল। তোর পার্সে টাকার থেকে যে লোকের নাম, আর ঠিকানা বেশি থাকে, তা আমি জানি’। ঠিক সময় না পৌঁছলে কি বিপত্তিটাই না হচ্ছিলো বলতো?’
অন্যদিকে, মেয়েপুলিশরা ইতিমধ্যেই অপয়াকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। ইন্সপেকটার অয়নের বন্ধুক থেকে ছোঁড়া গুলিটা একেবারে অপয়ার পায়ে লেগেছে। ব্যথায় ছটফট করছিল বছর ২৪ এর মেয়েটা। গোঁ গোঁ করে বলে চলেছে, ‘ইভু! আমি তোকে ভালোবাসি ইভু! ইভু! ওরা আমাকে আটকে রাখবে ইভু! আমার হাতটা ধর! ইভু!!!ইভু..। ততক্ষণে তাকে ইভানের থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে চলে গেছে কন্সটেবেল অরুনিমা দত্ত।
পাঁচদিন পর
তমালের বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে দুটি নিশ্চুপ প্রাণী; ইভান আর ইভানের সৌম্যি। এই পাঁচদিনে ভুলবোঝাবুঝিটা বেশ অনেকটা মিটে গেছে। অপয়াকে ভালোবেসেফেলাটা একটা ঘোর ছিল আর আখিলের সাথে সৌম্যদীপার ঘরে যাওয়াটা যে সহবাস ছিল না, তা বিশ্বাস করে নিয়েছে ইভান। বেশ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন সবুজ জানালা দিয়ে ব্যস্ত শহর দেখছিল। জানলায় ইভানের হাত ঘষাটায় বোঝা যায় যে তার মনপাখিও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ তমাল পিছন দিয়ে ডাকে, ‘ভাইটি, ঘটকালির টাকাটা মেরে দিবিনা তো?’ সৌম্যির দুধে-আলতা গালে লজ্জার রেশ দেখা যায়। ইভান ইশারা করে তমালকে যেতে বলে। ঘাড় ঝাঁকিয়ে চোখের ভঙ্গিমায় তমাল বলে, ‘এঞ্জয়’।
কথা কীভাবে শুরু করবে তার কিনারা না খুঁজে পেয়ে, বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলে ইভান। ‘তুই কেমন আছিস?’
তাকায় সৌম্যি, গোলাপি ঠোঁটে হাসি ফোটে তার। মিষ্টি গলায় বলে, ‘এতো ভেবে এই প্রশ্ন?’
ইভান অপ্রস্তুতে পড়ে নানা কথা বলতে শুরু করে, ‘না। মানে, আমারই ভুল। অপরাধ আমি করেছি। ওইভাবে অপুকে..তুই কি ,মানে, ক্ষমা করতে পার..। ইভানের মুখে হাত দিয়ে সৌম্যি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ভালোবাসি তো, ক্ষমাতো করতেই হবে, মৃত্যুপর্যন্ত একসাথে থাকতে হবে যে’।
জানলার রেলিং-এ রাখা সৌম্যির নরম হাতের উপর আলতোভাবে হাত রেখে ইভান বলে, ‘আকাশ মেঘমুক্ত হয়েছে। গাছের পাখিগুলোর কলাহলটাও বেশ লাগছে, তাই না? তবে এরপর যতই মেঘ জমুক, বাজ পড়ুক, তোর এই দুইহাত আমি শক্ত করে ধরে রাখব, কথা দিলাম’।
ইন্সপেকটার অয়ন এখনও ঠিক করতে পারেনি, অপয়াকে রিহ্যাবে দেবে নাকি আসাইলামে। সে মানসিকভাবে অসুস্থ এবং এতদিনে গাঁজা, মদ, কোকেন কোনোকিছুই খাওয়া বাদ রাখেনি। ইভান অন্যদিকে প্ল্যান করেছে, অপুর সমস্ত দায়িত্ব সে আর তমাল মিলে নেবে। চলে যাওয়ার সময় তার কণ্ঠস্বরে বিবর্ণ মনের ক্ষতচিহ্নগুলো ফুটে উঠেছিলো। ভালোবাসা না পাওয়ার প্রচণ্ড যন্ত্রণা যে তাকে ঘিরে রয়েছে তা বুঝেছিল ইভান। সৌম্যদিপাও এতে সম্মত। সত্যি, সেতো শুধু ভালোবাসাই চেয়েছিল, গোটা পৃথিবী তাকে সেটুকু পর্যন্ত দিতে পারল না।
তাহলে কি ভালোবাসা এতটাই দামি যা সহজে দেওয়া যায়না অথবা পাওয়াও যায়না? কি জানি, আমার থেকে বর্তমান যুগ এটা বেশি ভালো জানবে যেখানে ভালবাসাটা একটা চয়স, একটা অপশন, একটা টাইম পাশ।

