STORYMIRROR

susmita Piu Adhikary

Romance Tragedy

3  

susmita Piu Adhikary

Romance Tragedy

❤অপেক্ষার প্রহর ❤

❤অপেক্ষার প্রহর ❤

8 mins
240


গভীর রাত চারিদিকে নিস্তব্ধ অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে । নিস্তব্ধতা ভেদ করে রাতের ঝীঁঝীঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে । মাঝে মাঝে কিছু কুকুরের চিৎকার জানিয়ে দিচ্ছে এই ঘুমন্ত শহরের প্রহরী হয়ে তারা পাহারা দিচ্ছে । রাস্তার সোডিয়াম আলো পেখমের ঘরের জানালা ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে । পেখম অশ্রুসিক্ত চোখে হাতের মেহেন্দির দিকে তাকিয়ে আছে । মেহেন্দিতে লেখা ময়ুখ নামটা পেখমের এক ফোঁটা চোখের জলে সিক্ত হয়েছে । আজ তার বিয়ের এক বছর পূর্ণ হলো। পেখম ময়ুখের ঘরে ফেরার শুধু প্রহর গুনছে । এই তো একটু আগেই ফোন করেছিল ট্রেন থেকে নেমে বাড়ির উদ্দেশ্যে ট্যাক্সি তে বসেছে । সেই ফোন রাখার পর থেকে পেখমের কান্না যেন থামছে না । সে খুব করে চেষ্টা করেও চোখের জল আটকে রাখতে পারেনি । হয়তো নিজের প্রিয় মানুষটাকে এতোদিন পর নিজের কাছে পাওয়ার আনন্দ। এ যেন বহু প্রতীক্ষার পরে মরূপ্রান্তে বৃষ্টি ঝরে পড়ার মতো ।

ময়ূখ দত্ত সি.আর.পি.এফ এ কর্মরত । একমাসের ছুটিতে এসে পারিবারিক ভাবে পেখমের সাথে তার বিয়ে হয় । দ্বিরাগমনের পরের দিন ময়ুখকে আবার চলে যেতে হয় তার কর্মস্থল মহারাস্ট্রে । পেখমের খুব করে মনে পড়ে আজও সেইদিন টার কথা,

--ময়ুখ পেখমের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পেখমের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কোমল স্বরে বলে উঠলো, পেখম কাল আমি আবার আমার কর্মস্থলে চলে যাব ।

--হুম

--তোমার কি আমাকে মনে পড়বে? আমাকে মিস করবে তুমি?

--পেখম কিছু না বলে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে মিস করবে না বললো ।

--পেখমের মাথা নাড়ানো দেখে ময়ুখ হেসে ফেলল । তুমি আমায় মিস করবে না জেনে খুব কষ্ট পেলাম জানো পেখম । কি আর করবো আমার কপালে বউয়ের মিস করা লেখা ....শেষ করার আগেই পেখম ঝাঁপিয়ে পড়ল ময়ুখের বুকে । ময়ুখ তার বুকের কাছে ভেজা ভেজা অনুভব করতে বুঝতে পারল পেখমের এতো সময়ের আটকে রাখা কান্না বেরিয়ে আসছে । ময়ুখ কিছু না বলে পেখমকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে, তার ও অশান্ত মন কে শান্ত করার জন্য এই মেয়েটার উষ্ণ স্পর্শ খুব প্রয়োজন । এরপর যে আবার দীর্ঘসময়ের বিচ্ছেদ । এইতো সদ্য তাদের দুজনের একসাথে হাতে হাত রেখে চলা শুরু হয়েছিল এর মাঝেই বিচ্ছেদের সূচনা হয়ে গেল ।

--ময়ুখ পেখমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, পেখম তোমার চোখে জল মানায় না । তুমি একজন সৈনিকের স্ত্রী । এক দেশযোদ্ধার সহযোদ্ধা তুমি। তুমি জানো যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে,

তুমি কি করো? তার উত্তরে নিজেকে দেশের সৈনিক হিসেবে পরিচয় দিতে আমার কতো আনন্দ হয় , ভেতর থেকে গর্ববোধ করি, নিজেকে নিয়ে অহংবোধ হয় । সবাই সুযোগ পায় না মাতৃভূমির হয়ে লড়াই করার কিন্তু আমি সেই সুযোগ পেয়েছি এটাই আমার অহংকার । আমি চাই আমার এই অহংকার তোমার মনেও সঞ্চার ঘটুক তাহলে দেখবে আমি কর্মস্থলে যাওয়ার সময় তোমার চোখে জল নয় হাসি থাকবে । আমার পরিবারের সেই গর্ব আর অহংবোধ আছে তারা কাল হাসিমুখে বিদায় জানাবে আমায় । যদি আমি আর ফিরে না আসি সেটা যেন তোমার দুর্বলতা না হয় । তুমি মনে করবে তোমার স্বামী কোনো একজনের জন্য নয় নিজের মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে গিয়ে শহিদ হয়েছে । জগতের নিয়মে মৃত্যু তো সবারই হবে , কিন্তু আমি চাই আমার মৃত্যু যেন দেশমাতার রক্ষার্থে হয় । তুমি এক সৈনিকের অর্ধাঙ্গিনী সেইভাবে নিজেকে প্রস্তুত করো পেখম ।

--পেখমকে বুকের থেকে তুলে পরম যত্নে তার দুচোখের জল মুছে দিল । পেখমের দুহাত নিজের কোলের মাঝে নিয়ে মেহেন্দী দেখতে দেখতে বলে উঠলো আমি যেদিন বাড়ি আসবো সেদিন প্লিজ হাতে আবারও আমার নামে মেহেন্দী পরবে । আমার মেহেন্দি রাঙা হাত দেখতে খুব ভালো লাগে ।

                              **********

দীর্ঘ তিনমাস অতিবাহিত হয়ে গেলো । কখনো ফোনের প্রেমালাপে, আবার কখনো খুঁনসুঁটি ,মান-অভিমানে , আবার কখনো বিরহ যন্ত্রণায় দিন রাত গুলো পেরিয়ে যাচ্ছে । সেদিনের ময়ুখের কথা গুলো মনে পড়লে চোখের কোনে জল আসার আগে মুখে হাসি ফুটে ওঠে । সত্যিই তো আমি একজন বীর দেশযোদ্ধার অর্ধাঙ্গিনী।

--হ্যালো পেখম আমাদের দীর্ঘ অপেক্ষা শেষ হতে চলেছে ।

--সত্যিই বলছেন আপনি?

--ফোনের ওপাশে থেকেও ময়ুখের চোখের সামনে পেখমের হাসিমাখা স্নিগ্ধ মুখ ভেসে উঠছে । সে চুপ করে পেখমের খিলখিলিয়ে হাসির প্রতিটি ঝংকার অনুভব করছে ।

--কবে আসছেন আপনি প্লিজ বলুন না?

--কেন আমায় খুব মিস করছো বুঝি?

--আপনি মজা না করে প্লিজ বলুন কবে আসছেন?

--বলতে পারি একটা শর্ত আছে । তুমি যদি আমায় তুমি করে বলো তাহলে বলবো । কতদিন হয়ে গেলো বিয়ের কিন্তু নিজের বউয়ের মুখে আপনি টা কেমন পরপর লাগে ।

--ময়ুখের কথায় পেখম কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলে উঠলো আপনি বাড়ি এলে তুমি করে বলবো ।

--পরশু ট্রেনে উঠছি । একদিন পরেই তোমার সামনে থাকবো তোমার মুখে তুমি শুনতে বলেই ময়ুখ হেসে ফেলল ।

--পেখম খিলখিল করে বাচ্চাদের মতো হেসে উঠলো ।

--ভালোবাসি পেখম ।

         

                                    *****

ময়ুখের বাড়ি আসার খবরে বাড়িতে যেন উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে । সন্ধ্যা থেকে পেখম আর শাশুড়ি মা মিলে বাজারের ফর্দ করতে ব্যস্ত । ছেলের পছন্দের সব খাওয়ার তৈরির লিস্ট করা হচ্ছে । পেখম কাজের ফাঁকে বারবার আয়নায় নিজেকে দেখে নিচ্ছে তাকে কি নতুন বউয়ের মতো স্নিগ্ধ লাগছে? ময়ুখের কাছে তো সে নতুনই । তাদের সংসার জীবন ঠিক শুরু হয়েও যেন শুরু হয়নি। সেই প্রেমিক-প্রেমিকার মতো রাত জেগে ফোনে কথা বলা, রাগ হলে আদর করে রাগ ভাঙানো,ঝগড়া হলে ব্লক করে দিয়েও তার ফোনের অপেক্ষায় থাকা এইসব মিশ্র অনুভুতি গুলো বিরহের হলেও এই প্রতীক্ষা মধুর । এতোটা দূরে না থাকলে হয়তো এই অনুভূতি গুলো অনুভব করা হয়ে উঠতো না ।

                                  ******

হটাৎ করেই অতিমারি করোনার কবলে সারা বিশ্ব যেন মরণ খেলায় মেতে উঠলো । সারা বিশ্বব্যাপী জুড়ে এই অতিমারি তে হাহাকার পড়ে গেল । প্রতিদিন কত মানুষ তার আপনজন হারাচ্ছে, কোনো মায়ের কোল খালি হচ্ছে, কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে হারাচ্ছে,সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু তার বাবার স্নেহ অনুভব করার আগেই চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে । বিশ্বযেন মৃত্যুক্ষেত্রতে রুপান্তরিত হয়েছে ।

--আজ ময়ুখ ট্রেনে উঠবে সেই আনন্দে পেখম চোখে কাজল লাগাচ্ছে । ময়ুখ বলেছিল তার চোখে কাজল দিলে ভালো লাগে । তার ভাবনায় চ্ছেদ পড়লো মুঠোফোনের শব্দে । পেখম তাড়াহুড়ো করে ফোনটা নিয়ে দেখতে পেলো ওপরে ময়ুখের নাম ভেসে উঠেছে ।

--কেমন আছো পেখম ? কাশতে কাশতে বলল ময়ূখ।

--আমি ভালো আছি । আপনি কেমন আছেন? কাশি হচ্ছে কেন?

--ও কিছু না এমনি।

-- না আপনি কিছু লুকোচ্ছেন আমার থেকে । আপনার কথা শুনে জ্বর জ্বর মনে হচ্ছে। গলা টাও কেমন ধরা মনে হচ্ছে ।

--পেখম একটা কথা বলছি তুমি মন খারাপ করবে না প্রমিস করো ।

--একটু চুপ থেকে পেখম বললো, আচ্ছা বলুন প্রমিস করলাম মন খারাপ করবো না ।

--আমি আজ ট্রেনে উঠিনি । ছুটি ক্যানসেল হয়ে গেছে আমার ।

--পেখম অনেক সময় চুপ থাকল ।ভেতর থেকে আসা কান্নাকে কোনো রকমে আটকে শুধু বলে উঠলো আচ্ছা ।

--পেখম প্লিজ কান্না করো না। এখানে করোনাতে কতো মানুষ রোজ মারা যাচ্ছে । আমাদের সবাইকে তাদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে হবে ।আমাদের কাজ তো দেশসেবা করা। তাহলে এই সময় আমরা কি করে সেই দায়িত্ব এড়িয়ে ছুটি নিতে পারি তুমি বলো পেখম ।

--পেখম কিছু বললো না । সে চায় না তার কম্পিত কন্ঠস্বর শুনে ময়ুখ বুঝতে পারে সে কাঁদছে । সে ময়ুখের শক্তি হতে চায়, দুর্বলতা নয় ।

--পেখম কিছুদিন এইসব কাজে থেকে এখানে সবারই করোনার কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে। কাল আমাদের সবার মেডিকেল চেকআপ হবে ।

--আচ্ছা ঠিক আছে । আপনি আমায় নিয়ে ভাববেন না । আমি দেশ সৈনিক ময়ুখ দত্তের সহযোদ্ধা হয়ে সবসময় তার পাশে আছি । আপনি ওখানে সবাইকে সাহায্য করে আমার অহংকার হয়ে ফিরে আসুন ।

--পেখমের কথা শুনে ময়ুখ তার চোখের কোনে জমে যাওয়া জল মুছে হেসে উঠলো ।

--ময়ুখের হাসির শব্দে পেখম ও তার চোখের জল মুছে হেসে উঠলো ।

                               *******

স্রোতের মতো সময় বয়ে যেতে লাগলো । সংবাদপত্রে, টিভিতে সর্বত্র দেখাচ্ছে এই মহামারি করোনার করালগ্রাসে কতো পরিবার ধ্বংস হচ্ছে প্রতিদিন। মহারাস্ট্রে পারদসীমার মতো দিনদিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে । সেই মৃত্যুপুরীর মাঝে ময়ূখ প্রতিনিয়ত লড়ে চলেছে নিজেকে সুস্থ রেখে তার প্রিয়তমার কাছে ফেরার জন্য । কয়েক'শ মাইল দূরে থাকলেও সে জানে তার প্রিয়তমা তাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করে প্রহর গুনছে তাকে কাছে পাওয়ার জন্য । এই অপেক্ষার প্রহর যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় । সারাবিশ্ব যেন এই অতিমারির দাপট থেকে মুক্তি পায় । সবাই আবার যেন প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারে ।

                                *****

দরজা খোলার আওয়াজে পেখম মুখ তুলে পেছনে তাকিয়ে দেখলো তার সামনে বহু প্রতীক্ষিত মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে । চোখে অজস্র অশ্রুকনা ভিড় জমিয়েছে, সে চাইছে গিয়ে একটু ছুঁয়ে দিতে কিন্তু না ছুঁয়ে দিলেই যদি চলে যায় প্রতিদিনের মতো ।

--পেখম দূরেই দাঁড়িয়ে থাকবে? কাছে আসবে না?

--ময়ুখের কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো পেখম । এটা সত্যি তার ময়ুখ। আগের থেকে শরীর অনেক ভেঙে গেছে,চোখের নীচে কালি জমেছে । ক্লান্তি তার চেহারায় ফুটে উঠেছে ।সে ধীর পায়ে ময়ুখের দিকে এগিয়ে তার গালে হাত ছুঁয়ে চোখদুটো বন্ধ করে নিলো। সে অনুভব করছে এই স্পর্শ । বন্ধ চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে ।

--ময়ুখ কিছু না বলে পেখমকে নিজের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিলো । আমি এসেছি তো এবার তোমার মুখে হাসি দেখতে চাই, তোমার সেই হাসির শব্দ শুনতে চাই যেটা এতোদিন আমাকে সুস্থ থাকতে শক্তি দিয়েছে । আমার সহযোদ্ধাকে ফিরে পেতে চাই ।

--চোখে জল নিয়েও হেসে ফেললো পেখম । ভালোবাসি, আমার হিরো কে ভালোবাসি, প্রতিটি মুহুর্তে তোমাকে নিজের মাঝে নিয়ে বাঁচি । আমার প্রতিটি নিশ্বাসে তুমি মিশে আছো । তোমাকে এক মুহূর্তের জন্য মিস করিনি কারন তোমাকে নিজের মাঝে রেখে অনুভব করেছি । খুব ভালোবাসি তোমাকে বলেই ময়ুখের কপালে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দিলো ।

--জানো এই দীর্ঘসময়ের দূরত্ব আমাদের মাঝে বন্ধনটা খুব শক্তিশালী করে তুলেছে । দূরত্ব এসেছিল বলেই আমাদের একে অপরকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে, দূরত্ব ছিল বলেই এতো দূর থেকে দুজন দুজনের অনুভূতি গুলো অনুভব করতে শিখেছি। কোনো দূরত্ব আমাদের মাঝের অনুভূতিগুলো শিথীল করতে পারবে না কোনোদিন ।

--প্রতিটি অপেক্ষার পরে যদি তোমায় এইভাবে একান্ত নিজের করে পাই তাহলে দীর্ঘদিবস-দীর্ঘরজনী তোমার অপেক্ষায় থাকতে রাজি । ভালোবাসি আমার হিরো।

--প্রতিটি প্রতীক্ষার পর যদি তোমার ছোঁয়া পাই তাহলে আমি দীর্ঘদিবস-দীর্ঘরজনী প্রতীক্ষা করতে রাজি। কিছু অপেক্ষা ভালো হয় । ভালোবাসি আমার সহযোদ্ধা ।

--ভোরের আলোয় রাতের অন্ধকার কেটে এক নতুন ভোর এসেছে পেখমের জীবনে । সেই আলোয় আলোকিত হোক ময়ুখ-পেখমের জীবন । দূরে কোথাও বেজে চলেছে রবীন্দ্র সঙ্গীত- 

ভালোবাসি ভালোবাসি

এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়

বাজায় বাঁশি

ভালোবাসি ভালোবাসি।।

আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে

দিগন্তে কার কালো আঁখি

আঁখির জলে যায় ভাসি

ভালোবাসি

ভালোবাসি ভালোবাসি।।

               



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance