STORYMIRROR

প্র হে লি কা 🍁

Inspirational Others

4  

প্র হে লি কা 🍁

Inspirational Others

অপেক্ষা ❣️

অপেক্ষা ❣️

6 mins
533


--- "উফফ এই নীল দা টাও না! কোনোদিন ঠিক টাইমে এসে পৌঁছল না! চারটের সময় আসতে বলেছিলাম, সন্ধ্যা পার করে দিলো! এদিকে আমি মরছি চিন্তায়! শেষ পর্যন্ত না সবটা গুলিয়ে ফেলি!"  


হ্যাঁ চিন্তা তো হ‌ওয়ার‌ই কথা! যত‌ই হোক, শ্রীতমা আজকে কিশোরীবেলার প্রথম ভালোবাসা নীল ওরফে নীলাদ্রি কে নিজের মনের কথা বলবে ভেবেছে। আর সেইজন্যই নীলাদ্রিকে ডেকেছিল এই পার্কে, কিন্তু নীলাদ্রির তো কোনো পাত্তাই নেই। 


বিকেলের আলো শেষ হতে চলেছে, শ্রীতমা একবার তাকাল রাস্তার দিকে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে তাকালো মাঠের দিকে। ছোটোছোটো ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে ফুটবল খেলছে। 


শ্রীতমার ওদের দেখে মনে হলো, ছোটোবেলাটাই কত ভালো ছিল তাই না! কি সুন্দর সবাই মিলে এক সাথে খেলাধুলা করেই গোটা দিনটা চলে যেত! সেখানে না ছিল কোনো জটিলতা আর না পরিবারের বোঝা মাথায় নিয়ে চলা! না ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় সন্তান হয়ে গোটা সংসার চালানোর চিন্তা! সবটাই খুব সুন্দর ছিল! কিশোরী বেলাটাও তো স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কেটেছে। যত জটিলতা সব একসাথে এসে জড়ো হয়ে এই কুড়ির আশেপাশের বয়সে! 


বাচ্ছাদের খেলা দেখতে দেখতে ওদিকেই হারিয়ে গিয়েছিল শ্রীতমা। কিছুক্ষণ আগের করা নীলাদ্রি কে নিয়ে ওর চিন্তাগুলো এক পাশে সরে গেছে। 


ছোটছোট বাচ্ছাদের খেলা দেখতে দেখতে ওর মুখেও হাসি ফুটে উঠেছিল। হঠাৎ করে ফুটবল টা ওর দিকে গড়িয়ে এল। শ্রীতমা পা দিয়ে আটকালো ফুটবল টাকে। 


বাচ্ছাগুলো ওপাশ থেকে চেঁচাতে লাগল, 

--- "কিক মারো দিদি, জোরে মারো।"


ওদের উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে শ্রীতমা ফুটবলটায় জোরে কিক মারল, ফুটবলটা গিয়ে সোজা গোলপোস্টে ঢুকে গেলো! বাচ্ছাগুলো "গোওওওল" বলে চেঁচিয়ে উঠল! শ্রীতমা‌ও হাততালি দিয়ে উঠল আনন্দে। 


হঠাৎ করেই শ্রীতমার চোখদুটো পেছন থেকে কে যেন একটা চেপে ধরল, শ্রীতমার এতদিনের অভিজ্ঞতা বুঝতে পারল ওটা কে হতে পারে, তাই ও সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, 


--- "তোমার সাথে আমার আড়ি নীল দা।"


নীলাদ্রি শ্রীতমার চোখ থেকে হাত সরিয়ে ওর সামনে এসে বলল, 

--- "সরি সরি শ্রী, একটুখানি লেট হয়ে গেলো! আসলে সব ওই জ্যামের জন্য! আরে বাবা তুই তো জানিস বল, কলকাতার জ্যাম কেমন!"


শ্রীতমা তাও মুখ ঘুরিয়ে আছে দেখে নীলাদ্রি বলল, 

--- "আচ্ছা বেশ ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু একজনের জন্য যে চকলেট নিয়ে এসেছিলাম সেটাও কিন্তু আমি খেয়ে নেব।"


বলে নীলাদ্রি চকলেটের প্যাকেটটা বের করে পাশের বেঞ্চে বসে প্যাকেটের র‍্যাপারটা ছিড়তে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে চকলেট টা কেড়ে নেয় শ্রীতমা। ওর পাশে আয়েশ করে বসে চকলেটের র‍্যাপার ছাড়িয়ে খেতে খেতে বলে,


--- " সব বিষয়ে কম্প্রোমাইজ চলবে কিন্তু চকলেটের বিষয়ে মোটেই না। আর তাছাড়া তুমি অলরেডি কতক্ষণ লেট করেছ দেখেছো পরে আমাকে ট্রিট দেবে এই জন্য।"


শ্রীতমার চকলেট খাওয়া দেখে নীলাদ্রি হেসে ফেলে‌। তারপর বলল,

--- " আচ্ছা বেশ সে হবে খন, এবার বলতো কি বলছিলি তুই, এত জরুরী তলব কেন ম্যাডামের...?"


নীলাদ্রির কথা শুনে এতক্ষণ ধরে চাপা পড়ে যাওয়া টেনশনটা আবার চাগার দিয়ে ওঠে শ্রীতমার! টেনশনটা সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে ও বলল, 


--- " হ্যাঁ সে বলছি কিন্তু তার আগে তুমি বলো তোমার ওই চাকরিটার কি হলো? যেটার ফর্ম ফিল আপ করেছিলে তুমি...??" 


নীলাদ্রির মুখটা এতক্ষণ হাসিতে ঝলমল করছিল কিন্তু শ্রী তো আমার প্রশ্নটা শুনে ওর ঝলমলে মুখে অন্ধকার নামল। মুখ নামিয়ে বসে রইল কিছুক্ষন নীলাদ্রি।


শ্রীতমা নীলাদ্রির মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারল ও বলল,


--- "কি হয়েছে নীল দা...?? চাকরিটা হয়নি...??"


নীলাদ্রি একবার আকাশের দিকে তাকালো তারপর শ্রীতমার দিকে তাকিয়ে বলল,


--- " না চাকরিটা হয়েছে তবে..."


--- "তবে কি নীল দা...?"


--- " ওরা বলেছে প্রথম কয়েক বছর বিদেশে চাকরি করতে হবে।"


নীলাদ্রির কথা শুনে শ্রীতমা তো প্রায় আনন্দে লাফিয়ে উঠল! 


--- "সত্যি! বাহ... এত বড় সুখবর!" 


শ্রীতমার উচ্ছাস দেখে নীলাদের মুখ আরো কালো কালো হয়ে গেল! সেটা লক্ষ্য করেই শ্রীতমা বললো,


--- " এটা তো অত্যন্ত ভালো খবর নীল দা তুমি এরকম মুখ কালো করে বসে আছো কেন বলতো..!!"


নীলাদ্রি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

--- "মোটেই ভালো খবর নয় শ্রী, আমি বিদেশে যেতে পারব না।"


নীলাদ্রির কথা শুনে শ্রীতমার মুখেও অন্ধকার নামলো ও বলল,


--- "কেন যাবে না নীল দা! কত বড় সুযোগ পেয়েছ তুমি বলত...!! সবাই কিন্তু বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পায় না, তুমি পেয়েছ, আর তোমার মা মানে কাকিমার কত দিনের ইচ্ছা ছিল বলোতো যে তুমি বিদেশ যাবে, আর সেই সুযোগ পেয়েও তুমি না বলছ! কেন নীল দা...!?"


নীলাদ্রি আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরাসরি শ্রীতমার দিকে তাকিয়ে বলল, 

--- "কারণ আমি তোদের ছাড়া থাকতে পারব না, তোকে ছাড়া থাকতে পারব না আমি!" 


শ্রীতমার হৃৎস্পন্দন থমকে যায়! এটা কি শুনছে ও! তার মানে ওর নীল দাও...


--- "হ্যাঁ শ্রী, তোকে ছেড়ে অতগুলো বছর আমি কোনোমতেই থাকতে পারব না বিদেশে! যাকে ছেড়ে একটা দিন আমি ঠিকমত থাকতে পারি না, তাকে ছেড়ে আমি অতগুলো দিন থাকব কি করে বলত!"


শ্রীতমার শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে, ও কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, 


--- "নীল দা, তার মানে তুমি আমাকে..."


--- "আমি ঠিকমত জানি না এই অনুভূতি টাকে কি বলে, সত্যিই জানি না, এই একদিন অন্তর দেখা না হলে, তোর সাথে কথা না বললে, তোর হাসিমুখ টা না দেখলে, আমার ভেতর যে অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয়, সেটাকে ওই চার অক্ষরে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই শ্রী। শুধু এতটুকুই বলতে পারি আমি, তোকে ছেড়ে থাকার ক্ষমতা অন্তত আমার নেই!"


এসব কি সত্যি! শ্রীতমার বিশ্বাস হয় না! যে মানুষটার জন্য ওর মনে এত অনুভূতি জমা আছে, সেই মানুষটার‌ও এক‌ই অনুভূতি ওর জন্যও জমা আছে! এত ভাগ্যবতী ও! শ্রীতমার চোখ দিয়ে দু - ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল, সেটাকে মুছিয়ে দিল নীলাদ্রি। তারপর বলল, 


--- "আর তুইও থাকতে পারবি না আমাকে ছাড়া, এই চোখের জল‌ই তার প্রমান শ্রী! সুতরাং আমাকে যেতে বলিস না প্লিজ!"


শ্রীতমা বলল, 


--- "না নীল দা, তুমি যাবে।"


--- "থাকতে পারবি তো আমাকে ছাড়া...?"


--- "পারব। কি জানত নীল দা, অপেক্ষা হচ্ছে ভালোবাসার গভীরতার একক। অপেক্ষা যত বেশী হবে, ভালবাসার গভীরতাও তত বাড়বে। আর তুমি বুঝতে পারবে, তোমার ভালোবাসার মানুষটার মায়ায় কীভাবে জড়িয়ে পড়েছ তুমি। আর যখন‌ই অপেক্ষার দিনগুলো এক এক করে শেষ হতে থাকবে, ওই মানুষটার সাথে দেখা করার দিনটা এগিয়ে আসবে, তখন যে অনুভূতি টা হয়, সেটা ভাষায় বোঝানো যায় না।" 


নীলাদ্রি অবাক হয়ে গেল শ্রীতমার কথা শুনে ও চোখ বড় বড় করে বলল,


--- " তুই এত বড় কবে হয়ে গেলি শ্রী!" 


--- "হয়ে গেলাম হুট করেই। কিন্তু তুমি যাচ্ছ।" 


--- "কিন্ত শ্রী..." 


--- "কোনো কিন্তু না নীল দা, তুমি যাবে। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।"


--- "কতদিন অপেক্ষা করবি শ্রী...? শেষপর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবি তো...?"


--- "পারব নীল দা, ঠিক পারব।"


--- "বেশ, তবে আমিও করব অপেক্ষা।"


শ্রীতমা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল, 

--- "তাহলে যাচ্ছ তো তুমি...?"


--- "হ্যাঁ যাচ্ছি।"


--- "বাহ, বেশ এবার তাহলে বিদেশী হ‌ওয়ার প্রস্তুতি শুরু করো।"


নীলাদ্রি হেসে বলল, 

--- "তা করছি, কিন্তু তুই যেন কি বলবি বলে ডেকেছিলি...?"


শ্রীতমাও হেসে বলল, 

--- "আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে নীল দা...? যেই মানুষটা সারাজীবন তোমার জনন অপেক্ষা করতে রাজি, তাকে আর কিছু নতুন করে বলতে হবে...? হ্যাঁ তাও যদি শুনতে চাও, তাহলে...."


--- "তাহলে কি...?" 


শ্রীতমা মুচকি হেসে বলল, 

--- "অপেক্ষা করো‌।"


              **********



--- "সূর্যাস্তের দৃশ্যটা এক‌ই সাথে মন খারাপ আর মন ভালো করার একটা দৃশ্য বলো শ্রী...?"


বছর পঁয়ষট্টির নীলাদ্রি সবে ষাট পেরনো শ্রীতমা কে বলল।

শ্রীতমা মুচকি হেসে বলল,

--- "হুম তা তো অবশ্য‌ই। একটা দিনের শেষ হলো, আবার নতুন একটা দিনের আশায় বসে থাকার শুরু!"


--- "অনেকটা আমাদের অপেক্ষার মত তাই না...?"


--- "একদম। আমরা অপেক্ষা করেছিলাম বলেই তো আজ তোমার কাঁধে মাথা রেখে আমি সারাটাজীবন পার করতে পেরেছি।"


--- "তা ঠিক।"


--- "তুমি সেই যে ফিরে এসে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব জানালে, তারপর আমাদের বিয়ে হলো, দেখতে দেখতে আমাদের বিয়ের তিরিশ বছর পার‌ও হয়ে গেলো।"


--- "আমাদের অপেক্ষার মূল্য আমরা পেয়েছি।"


--- "অবশ্যই। সবাই সবার অপেক্ষার মূল্য পায় না, আমরা পেয়েছি। আমাদের মনের টান দুইদিক থেকেই সমান ছিল তাই পেয়েছি। যান্ত্রিক এই দুনিয়াতে প্রেম কে যত‌ই 'ন্যাকামি' বলে গালাগালি দেওয়া হোক না কেন, ভালোবাসার মানুষটার কাঁধে মাথা রেখে সারাজীবন পার করে দেওয়া কিছু মানুষ আজ‌ও পৃথিবীতে বেঁচে আছে বলেই কিনা পৃথিবীটা এত সুন্দর!"


--- "সত্যিই তাই!" 


--- "যান্ত্রিক এই পৃথিবীতে সবাই প্রেমহীনতার গল্প লিখুক, আমরা নাহয় অপেক্ষা কালি দিয়ে ভালোবাসার গল্প লিখে গেলাম।"


শ্রীতমা নীলাদ্রির কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দেয়, ওদের মন রোমন্থন করতে থাকে পুরোনো সেইসব স্মৃতি, যেগুলো ওরা অপেক্ষা দিয়ে তৈরী করেছিল!




             ✨সমাপ্তি




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational