নারী হয়ে ওঠা
নারী হয়ে ওঠা


জন্মের পর প্রথম যখন নার্সদিদি পরিচয় করালো আমার পরিজনদের সাথে
আমার কোমরের নিচে স্বল্প আচ্ছাদন তুলে দেখিয়ে বলল
‘দেখে বল, কি সন্তান হয়েছে?’
সবার কৌতূহল যেন উগরে পড়ল এক নিমিষে!
তারপর এক ঝটকায় থমকে গেল সব কৌতূহল।
মুখের বক্র অভিব্যক্তির দরজায় যেন আটকে আমার আগমন।
একজন বললেন ‘ওহ মেয়ে হয়েছে!’
একজন বয়স্ক মহিলা, বোধ হয় বাবার ঠাম্মা,
কিছুটা তীক্ষ্ণ সুরে বললেন 'খোকন, মেয়ে হয়েছে রে তোর!
নে এখন থেকে জমাতে শুরু কর।
হ্যাঁ রে আমার বংশে বাতি জ্বালবে কে রে?'
আমি আসতে না আসতেই সবাই যেন আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত।
সবাই যখন এই সব ঠাট্টা তামাশায় মশগুল।
আমার মা তখন শয্যায় শুয়ে সালাইন চ্যালেনে বন্দী এক অসহায় নারী।
আমিই প্রথম সাক্ষী রইলাম মাতৃত্বের কি যন্ত্রনা! কি অসহ্য কষ্ট!
কাটা মাছের মত কাতরাচ্ছে আমার মা!
আমি বুঝতে পারছি না যে
আমি কাঙ্ক্ষিত না অনাকাঙ্ক্ষিত!
সবাই চলে গেল একে একে
আমাকে এনে শোয়ানো হল মায়ের বুকে মুখ লাগিয়ে।
মা আমার দিকে একটু চেয়ে দেখলো, কিন্তু তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস!
কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বাবা এল কাছে।
আমিও যেন কিছুটা ভীত, শঙ্কিত।
দেখি, বাবা মায়ের কাছে ঝুকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপি চুপি বলল..
‘দেখেছো আরতি, আমার মা ফিরে এসেছে!
সেই কত ছোট্ট বেলায় আমাকে একা রেখে চলে গিয়েছিল।
আমি তখন বার কি তের বছরের খোকা।
আর আজ আমার মা ছোট খুকি হয়ে আবার ফিরে এল তোমার কোলে’।
আমি যখন কথা গুলো শুনতে শুনতে
ট্যাঁ ট্যাঁ করে কেঁদে উঠলাম!
দেখলাম বাবার চোখ দুটো কেমন
চক চক করে উঠলো।
আজ সেই আমি কত বড় হয়ে গেলাম।
নিজেই ছোট খুকি থেকে নারী হয়ে উঠলাম।
তবুও আজও যেন সব কাজের ফাঁকে খুঁজে ফিরি আমার বাবার সেই চকচক করা চোখ দুটো।
স্মিত হাসি মাখা স্নেহশীল সেই মুখটা।
যা এখনো আমাকে বলে
‘তুই অনাঙ্ক্ষিত নোস খুকি মা।
দেখিস, একদিন তুই সবার যোগ্য হয়ে উঠবি’।
সেই মানুষটাই যে ছিল
আমার প্রথম সামাজিক পরিচয়।
আমার দিকে কুদৃষ্টিতে তাকানো পুরুষদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদের সাহস।
আমার একলা চলার পথে প্রথম লড়াই করার ক্ষমতা।
আমার নিজের মত করে বেঁচে থাকার প্রথম প্রেরণা।
অনাহূত আমি থেকে আজ নারী হয়ে ওঠার প্রথম আত্মবিশ্বাস