জোকার ও হাসি
জোকার ও হাসি
জোকার ও হাসি
পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত একটি ছোট গ্রামে রমেশ নামের এক অদ্ভুত যুবক বাস করত। রমেশ সবার মতো সাধারণ গ্রামবাসী ছিল না; মানুষকে হাসানোর অসাধারণ প্রতিভা তার মধ্যে ছিল। তার বুদ্ধি ছিল তলোয়ারের মতো তীক্ষ্ণ, এবং সে এমন রসিকতা করতে পারত, নিষ্ঠুর ও কঠোরতম মুখেও আনন্দের হাসি আনতে পারত।
রমেশ মনে করত পৃথিবীতে তারাই সুখী, যারা সবসময়ই হাসিখুশিতে থাকে। সে বিশ্বাস করত যে, হাসি হল দুঃখিদের সর্বোত্তম মহাঔষুধ। এবং হাসিই এক একজনের গভীর থেকে গভীরতম ক্ষতের নিরাময় করার ক্ষমতা রাখে। সে তার মজাদার হাসির কৌতুক এবং উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে, গ্রামের সবার হৃদয় এবং আত্মাকে জয় করেছে।
এক সময় একটি ভ্রাম্যমান সার্কাস তাদের গ্রামে এসেছিল। তাদের সাথে ছিল একজন বিখ্যাত জোকার। সেই জোকার নাকি পুরো সার্কাসের আসরটাকে মাতিয়ে রাখত, বিভিন্ন ধরনের মজাদার জোকস দিয়ে। গ্রামবাসীরা এই অসাধারণ প্রতিভাবান জোকার এর প্রতিভা দেখার জন্য উৎসুক হয়েছিল। তারা বিকেলের শো'তে সার্কাসের তাঁবুতে জড়ো হয়েছিল প্রতিভাবান জোকারের শো দেখার জন্য। সার্কাসের তাবুতে অনেক সময় ধরে অধীর আগ্রহে, জোকারের অভিনয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল তারা।
সেদিন জোকারের ভীষণ এক অসুখ হয়েছিল। তাই সে সার্কাসের মঞ্চে পারফর্ম করতে অক্ষম ছিল। তাকে জোরপূর্বক ভাবে দর্শকের চাহিদা পূরণের জন্য তার মালিক মঞ্চস্থ করল। জোকার মঞ্চে উঠতেই সবাই চিৎকারে, শোরগোল করে, করতালি ও সিটি মেরে তাকে অভিনন্দন জানালো। কিছু সময় পর জনতা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কারণ তাদের হতাশ হতে হয়েছিল। জোকারটি অসুস্থ শরীর নিয়ে কিছুতেই আগের মতো করে জোকস আর রসিকতা করতে পারছিল না। সেদিনকার সার্কাসের মঞ্চে তার পারফরম্যান্স, তার হাস্যরসের প্রচেষ্টা একেবারেই বিশ্রী ভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল। দর্শকদের নিরাশ ও নীরবতার সাথে শো থেকে বের হতে হয়েছিল। গ্রামবাসীরা সার্কাসের প্রতি আগ্রহ হারাতে শুরু করেছিল। জোকারটা নিজেকে পরাজিত মনে করে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মঞ্চ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
জোকারের ব্যর্থ পারফরম্যান্সের কথা রমেশের কানে পৌঁছল। সে সার্কাসের প্রাণ, হাসি ফিরিয়ে আনার জন্য একটি পরিকল্পনা করল। প্রথমে সার্কাসের মালিকের সাথে যোগাযোগ করল। তাকে সে জোকারের অসুখ সারিয়ে, এই নিষ্প্রাণ সার্কাসটিকে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মালিককে একটি পরিকল্পনা দিল। সার্কাসের মালিক কিছু সময় নিল রমেশের প্রস্তাব ভেবে দেখার জন্য। তার পর সার্কাসের মালিক এই এলাকায় রমেশের খ্যাতিসম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে, রমেশ সম্পর্কে ওয়াকিবহুল হলো। অবশেষে তাকে একটি সুযোগ দিতে রাজি হল।
সার্কাসের মালিক রাজি হতেই, রমেশ প্রথমে জোকারের সঙ্গে সলা-পরামর্শ করে নিল। তারপর সার্কাসের লোকেদের দিয়ে, গ্রামবাসীদের মধ্যে একটা খবর প্রচার করে দেওয়া হল। 'সেই চমৎকার জোকার সুস্থ হয়ে গেছে। সে আগামীকাল পারফর্ম করবে।' পরদিন বিকেলে গ্রামবাসীরা আবার জড়ো হল। এবার তাদের চোখে আশার ঝলক। এদিনের সার্কাসে সেই হাস্যকর অসাধারণ জোকারের সাথে রমেশ মঞ্চে উঠল! রমেশ তার মুখ খুলতেই সার্কাসের তাঁবুটা হাসিতে ফেটে পড়ল। অসুস্থ জোকারের হাস্যকর জোকস গুলোকে রসিকতা করে প্রাণ দিল রমেশ। তাদের দুজনের পারফরম্যান্সের ছিল চমৎকার। তাদের টাইমিংস্ ছিল অনবদ্য এবং তাদের ডেলিভারিগুলি ছিল ত্রুটিহীন।
জোকারটি রমেশের সঙ্গে পারফরমেন্স করার সময় তার এত ভালো লাগছিল, সে তার নিজের অসুখ ভুলে গিয়েছিল।গ্রামবাসীরা রমেশ ও জোকারের প্রতিভার পারফরম্যান্স দেখে আনন্দিত হল। তারা এতোটাই উপভোগ করেছিল, তাদের পেটে ব্যথা না হওয়া পর্যন্ত তারা হেসে যাচ্ছিল। তারা সে সময় তাদের সমস্ত উদ্বেগ ও দুঃখ কষ্টের কথা ভুলে গিয়েছিল। রমেশ সেদিন সার্কাসের মঞ্চে শুধু হাসিই ফিরিয়ে আনেনি, হাস্যরসের শক্তির কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। হাসি একজন মানুষের শুধু মনের অসুখ নয়, শরীরের অসুখ কেউ ভুলিয়ে দিতে পারে। সেদিনের এই ঘটনা দূরদূরান্তের গ্রামে সুনামির মতো ছড়িয়ে পড়েছিল।
দিন যত গড়াচ্ছে রমেশ গ্রামের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে লাগল। লোকেরা আনন্দের মুহূর্তের প্রয়োজন হলেই তার সঙ্গ খুঁজত। তাকে প্রায়ই দেখা যেত একটি অনেক প্রাচীন বটগাছের তলায় বসে থাকতে। বিকেল হলেই দুঃখি গ্রামবাসীরা ভিড় জমাতো তার কাছে। তার মজার মজার কৌতুক কাহিনী, জোকস শুনে সবাই তাদের ভারাক্রান্ত মনকে তাজা করে নিত।
কিন্তু রমেশ শুধু মানুষকে হাসাতেই নয়, তাদের নিজেদের জীবনে হাস্যরস খুঁজে পাওয়ার রহস্য শেখানোর উদ্দেশ্য ছিল তার।
বছর যত গোড়ায় রমেশের খ্যাতি তত ছড়িয়ে পড়ে বহুদূরে। আশেপাশের গ্রামের লোকেরা তার কৌতুক শুনতে এবং তার হাসির জাদু অনুভব করার জন্য, মাইলের পর মাইল ভ্রমণ করে তার কাছে আসতে লাগল। একসময় রমেশ হয়ে উঠে কিংবদন্তি মনোরোগির ডাক্তার, যে কেবলমাত্র হাসির গল্প এবং জোকস দিয়ে দক্ষতার সাথে, অসুস্থ মনের জটিল কঠিন রোগমুক্ত করতে পারতো। আজ সে একজন দক্ষ হাসির গল্পকার।
"জীবনের একটি বড়ো অংশ হল হাসি। যদি সেটা আপনি হারিয়ে ফেলেন, তাহলে আপনি মনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়বেন। হাসুন মন খুলে হাসুন। দেখবেন শরীরের রোগ থেকেও মুক্তি পেয়েছেন আপনি ।"
ধন্যবাদান্তে-
আইয়ুব খাঁন
০৯/১০/২৩
