উমা
উমা


সবে দশে পড়েছে উমা। যেমন পটল চেরা চোখ ঠিক তেমনই মন ভুলানো হাসি কিন্তু জন্ম থেকেই কথা ফোটেনি তার।গরীব ঘরের মেয়ে, দিন আনি দিন খাই তার মধ্যে উমার বাবা প্রতিদিন মদ্য পান করেন তাই তো উমার মা রমা মেয়ের জন্য ডাক্তার কবিরাজ কিছুই করতে পারেননি। বোবা মেয়ের মায়া মায়া দু চোখ দেখে মা তার সব ইচ্ছে পূরণ করত। উমা যাত্রা পালা দেখতে ভীষণ ভালোবাসে তার তাগিদে রমা স্বামীর চোখ এড়িয়ে মেয়েকে পালা দেখাতে নিয়ে যেত।
একদিন রমার ভীষণ জ্বর, জ্বরে গা দপদপ
করে পুড়ছে সেদিন আবার গাঁয়ে পালা হবে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। মেয়ের ওরকম করুণাময়ী এবং উৎসাহিত দুটো আঁখি দেখে মাও উমাকে আদেশ দিয়েছিল একলা প্রস্থান করার। মা এর হাতের ইশারায় বুঝে ছিল উমা, রমা যে মেয়ের অসীম আনন্দের ভিড়ে হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে। চোখের কোনে এক ফোঁটা জল আনন্দের সাগরে বয়ে চলে যায়।
আয়নার সম্মুখীন হয়ে কপালে লাল টিপ পড়ে উমাকে লাগছিল বেশ, সঙ্গে তার গাঁয়ের কন্যার মত আট প্রহরের শাড়ি ও কান বিনুনি করে বেরিয়ে পড়েছিল পালা দেখার তাগিদে।
সেদিন পালাতে ছিল দেবতাদের অস্ত্রের দ্বারা কিভাবে মা দুর্গার আবির্ভাব হয়।দশভূজা মা দুর্গা কে দেখে উমা আকস্মিক ভঙ্গি করে। বাড়িতে ফেরার পর উমা দেখে মাটিতে বাটি ও গ্লাস গড়াগড়ি দিচ্ছে, ভাতের হাঁড়ি উপুড় হয়ে পড়ে আছে, দুয়ার লাগানোর হুড়়কোটি মায়ের চৌকির ঠিক পাশে এবং তার মা ব্যথার চোটে এপাশ ওপাশ ঘুরছে। অবিলম্বে সে বুঝে ফেলল আজও তার মদের নেশায় জর্জরিত জানোয়ার বাবা তার মাকে মারধর করেছে।
পরের দিন সকালে উদিত সূর্যের আলোতে কাশফুলের সারি সারি জমিগুলো খুব সুন্দর দেখাচ্ছিলো আর সেই জমির আল বরাবর হেঁটে যাচ্ছে উমা। উমার চোখ পড়লো আধুনিকতার বাস্তব চিত্রে, সেখানে ছয়-সাত জন শহুরে ছেলে-মেয়ের সমাগম ছিল, হাতে ছিল ক্যামেরা এবং ক্যামেরার সোজাসোজি ছিল জ্যান্ত দুর্গা সেজে তারই বয়সি এক ফুটফুটে মেয়ে। কাশফুলের আড়াল থেকে দেখে ছবি তোলার আদব কায়দা। হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে তাদের মুখে এবং নিজের মনের ক্যানভাসে এঁকে ফেলে মা দুর্গার সাজ।
আবারও সন্ধ্যে সাতটার সময় আছে পালা। 'মা দুর্গার মহিষাসুর বদ' এই ছিল আজকের যাত্রা পালার মূল প্রসঙ্গ। বহু মানুষের ভীড়ে মাদুর পেতে একদম সামনেই বসেছে উমা। বড়ই উদ্দীপিত আছে উমা। স্তম্ভিত হয়ে পালার শেষ টুকু দেখছিল সেই। বাড়িতে ফেরার পর দেখল আবার সেই পূর্বের দুর্ঘটনা। অগোছালো ঘরের টিমটিমে প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়েছে শুধু পাশের ঘরখানা। যেই ঘর থেকে তার আহত মার চিৎকারের ধ্বনী ভেসে আসছে কানে এবং থাপ্পড়ের প্রতিটা চিত্র ধরা পড়ছে পর্দার ওপর ছায়ার মাধ্যমে। অমাবশ্যার কালো ঘন মেঘকে তোয়াক্কা না করে উমা গর্জে উঠলো পিতৃতুল্য এর সাজে মহিষাসুরের মতন রাক্ষসের ওপর। দশ বছরের কন্যা সন্তান দুয়ারের হুড়়কোর দ্বারা আঘাত করলো তার বাবার মাথায় এবং ততক্ষণ আঘাত করে গেল যতক্ষণ না সে হাঁপিয়ে যায়। আহত অবস্থায় পড়ে থাকা স্বামীকে দেখে রমা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। উমার আজ জ্যান্ত দুর্গা হয়ে ওঠার স্বপ্ন পূর্ণতা লাভ করল। অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটল, পরিস্থিতির ঘেরাটোপে উমা নামটি আজ স্বার্থক হল।