উদারতা
উদারতা
আমার গল্পটি ২০১০ সালের, যখন আমি দিল্লির একটি পাবলিক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষিকা ছিলাম। এই সময়ে মিসেস সুসান পেরেরা ইংল্যান্ডে পাঁচ বছর থাকার পর সবেমাত্র ভারতে ফিরেছিলেন। তিনি আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত ইংরেজী শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি লম্বা, সুন্দরী, মেধাবী এবং অত্যন্ত যোগ্য ছিলেন। তাঁর একটি দুর্দান্ত শিক্ষণ শৈলী ছিল। মেজাজ বাদে সবকিছুই তাঁর সুন্দর ছিল। তিনি খুব কঠোর ছিলেন এবং ক্ষুদ্রতম ভুল কাজের জন্যেও ছাত্রীদের শাস্তি দিতেন।
শাহীন এবং লতা আমার পঁয়তাল্লিশ শিক্ষার্থীর মধ্যে দুজন ছিল। লতা হিন্দু এবং উজ্জ্বল ছাত্রী আর শাহীন মুসলমান এবং শিক্ষাগতভাবে দুর্বল। তাদের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা সেরা বন্ধু ছিল।
এটি অক্টোবর মাসের গোড়ার দিকের ঘটনা। লতার মায়ের হাত ভেঙে গিয়েছিলো, ঠাকুরদার ছানি অপারেশন, ঠাকুমা জ্বরে আক্রান্ত এবং বাবা ব্যাবসার কাজে শহরের বাইরে ছিলেন। তাই সে তার ঠাকুমাকে সময় মতো ওষুধ দিচ্ছিল, দাদুকে
চোখে ড্রপ এবং রান্নাঘরে তার মাকে সাহায্য করায় ব্যস্ত ছিল। এই সমস্ত অশান্তির মধ্যে সে তার ইংরেজি হোমওয়ার্ক খাতাটি স্কুলে আনতে ভুলে গিয়েছিল। সকালে প্রার্থনার সময় লতা তা বুঝতে পেরে শাহীনকে এ সম্পর্কে জানিয়েছিল। শাহীন লতা কে আশ্বাস দিল যে কোনো চিন্তার কারণ নেই। সাধারণত শনিবারে, আমি বন্ধুদের একে অপরের পাশে বসার অনুমতি দিতাম। প্রতি শনিবার লতা ও শাহীন পাশাপাশি বসত এবং ওদের প্রায় একই রকম হাতের লেখা ছিল। ইংরেজী ক্লাসে যখন মিসেস পারেরা হোমওয়ার্ক খাতা চাইলেন তখন লতা ভয় ভয় উঠে স্বীকার করলো যে সে তার খাতা আনতে ভুলে গেছে (এই প্রথম সে এই ভুল করেছিল)। সে তার বাড়ির পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো কিন্তু মিসেস পেরেরা কিছুই শুনতে চাইলেন না। তিনি কিছু না শুনেই লতাকে খুব বকতে আরম্ভ করে দিলেন। টপ টপ করে লতার গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। শাহীন তক্ষুনি উঠে দাঁড়িয়ে বলল - “ম্যাডাম, লতা আমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এই তো ওর খাতা।দেখুন মলাটে ওর নামও লেখা আছে।” তাই লতার বদলে মিসেস সুসান পেরেরা শাহিনকে শাস্তি দিলেন।
সময়সূচী অনুসারে, পরবর্তী ক্লাস হিন্দি ভাষার জন্য নির্ধারিত ছিল। মিসেস রিতা তিওয়ারি অনুপস্থিত থাকায় আমি তাঁর ক্লাসে গেলাম। পরের দিন বন্ধুত্ব দিবস হওয়ায় আমি আমার ছাত্রীদের এক এক করে তাদের বিশেষ বন্ধুদের সম্বন্ধে বলতে বললাম।। লতার পালা আসায় ও ক্লাসকে জানালো ওর বাড়ির পরিস্থির কথা এবং কি ভাবে শাহীন ওকে সাহায্য করলো। শাহীন লতাকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্যে নিজের খাতার মলাট উল্টে দিয়ে খাতার ওপরে লতার নাম লিখে দিয়েছিলো।
আমি শাহিনের এই উদারতা দেখে গভীরভাবে অনুভূত হয়েছিলাম এবং তার অনেক প্রশংসা করেছিলাম। অবশ্যই, আমি কর্মীদের কক্ষে আমার সমস্ত সহকর্মীদের শাহিনের মহত্ত্বের কথা জানিয়েছিলাম এবং তার নামটি বার্ষিক দয়া পুরষ্কারের জন্য সুপারিশ করেছিলাম । শাহিনের বন্ধুত্বের কথা শুনে মিসেস পেরেরা অত্যন্ত বিব্রত হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর শিক্ষাগত ডিগ্রিগুলি তাকে কেবলমাত্র একটি উচ্চ দক্ষ শিক্ষিকা হিসাবে তৈরি করেছে তবে দশ বছর বয়সী একটি মেয়ে তাঁকে কীভাবে একজন ভাল মানুষ হতে হয় তা শিখিয়ে দিল ।