ট্রেনের গানওয়ালা
ট্রেনের গানওয়ালা


এইভাবে প্রতিদিন চাপ আর নেওয়া যাচ্ছে না, এই ভাবতে ভাবতেই হাওড়া ষ্টেশনে ঢুকছিলাম ।আরও মাথাটা গরম হয়ে গেল টিকিট কাউন্টারে ভিড় দেখে।আজ অফিস বাসটা একটুর জন্য মিস হওয়ার জন্যই এত সমস্যা হল।তবে এটা নতুন কিছু নয় প্রায়শই এইভাবে ৫ মিনিটের জন্য অফিস বাসটা মিস হয়।স্বভাবতই আমায় রাত্রি ১০.৫৫ এর মেচেদা লোকালটা টার্গেট করতে হয়।তবে এইরকম ভিড় খুব কম হয় বিশেষত এতটা রাত্রে।তবে আজ বোধহয় ভাগ্যটা একটু ভালো ছিল।এক পরিচিত সহযাত্রী টিকিটের লাইনের সামনের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাই সহজেই টিকিটটা কাটা হয়ে গেল। নয়তো পরবর্তী পাঁশকুড়া লোকালের জন্য অপেক্ষা করতে হতো।
এরপর মনটা আরো একটু ভালো হল যখন সামনের দিকে একটি খালি বগিতে উঠে জানলার ধারের সিটটা পেলাম।জুতোটা খুলে সামনের সিটটায় পা তুলেদিলাম। ট্রেনটা আজ শিডিউল টাইমের মাত্র ৫ মিনিট পরেই ছেড়ে দিলো তবে টিকিয়াপাড়া ষ্টেশনের একটু আগে একটা এক্সপ্রেস পাস করানোর জন্য সিগন্যালে দাঁড়িয়ে গেল। একটা মৃদু গান শোনা যাচ্ছে কোনো এক বাচ্ছার গলায়, মনে হয় পাশের কামরা থেকে ভেসে আসছে।একটু পরেই ছেলেটি এলো এই কামরাতে।আমার সিটের সামনে আসতে চিনতে পারলাম ছেলেটিকে। কয়েকদিন আগে এই ছেলেটিকে ১০ টাকা দিয়ে বলেছিলাম ৫ টাকা ফেরত দিতে কারণ সেইদিন আমার কাছে খুচরো ছিল না।প্রতুত্তরে ছেলেটি বলেছিল যে বাবু আজ ১০ টাকা দিন পরেরদিন ৫ টাকা ফেরত দিয়ে দেব। তাই আজ ৫ টাকা নিয়ে আমার দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি।আমি ছেলেটির সততা দেখে কিছুটা আপ্লত হয়ে গেলাম।আমি ছেলেটিকে বললাম যে এটা তোর আজকের গানের জন্য। তবে ছেলেটি বলল যে এটা ওইদিনের ৫ টাকা আপনি এটা নিয়ে অন্য টাকা দিন।সত্যি বলতে আজকেও আমার কাছে খুচরো নেই। তাই বললাম যে পরেরদিন আজকের ৫ টাকা মিলিয়ে ১০ টাকা দিয়ে দেব,এই শুনে ছেলেটি চলে গেল।
দেখতে দেখতে আমার গন্তব্য ষ্টেশন এসে গেল। ষ্টেশনে নামার পর এক মুখচেনা সহযাত্রীর প্রশ্নে একটু হকচকিয়ে গেলাম।উনি জানতে চাইলেন যে সেই ছেলেটি ৫ টাকা দিয়েছে কি না।তবে কি ছেলেটি রোজ আমার খবর নিতো এদের থেকে!! আমি একটু আশ্চর্য হয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম আর সঙ্গত কারণেই মনের কোণে উঁকি মারা প্রশ্নটা করলাম। তবে উত্তরটা শোনার জন্য আমি একটুও মানসিকভাবে প্রস্তত ছিলাম না।তিনি যেটা বললেন সেটার সারমর্ম এটাই ছিল যে,গত শুক্রবার যেদিন আমি ক্যাসুয়াল লিভে ছিলাম সেইদিন ওই ছেলেটি আমার কথা খোঁজ নিয়ে এই রামরাজাতলার আগের ক্রসিংয়ে দাড়িঁয়ে থাকা ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে মিডল লাইনে আসা এক্সপ্রেসে কাটা পড়ে।ছেলেটি ক্রসিংয়ের পাশের ঝুপড়িগুলোতেই থাকে। এরপর থেকে প্রতিদিন ওই কামরাতে উঠে আমার কথা জানতে চায়,তাই ভয়ে ওই বিশেষ কামরাটিতে কেউ ওঠে না।আমি এটা শোনার পর হতভম্ব হয়ে পকেট থেকে ছেলেটির দেয়া ৫ টাকার কয়েনটি বের করে দেখি একটু লাল মত রক্ত লেগে আছে। আমার অজান্তেই আমার হাত ওই কয়েনটি সেই বস্তি লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলো আর মুখ থেকে স্বগতোক্তির মত বেরিয়ে এলো "এটা তোর আজকের গানের জন্য....."