তিনরঙা ভালোবাসা
তিনরঙা ভালোবাসা


বাইরে প্রচন্ড ব্যস্ততা ।একতলা ইটের প্লাস্টারখসা বাড়িটা ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে ।সামনের উঠোনে ত্রিপল, রঙিন কাপড়ের ছোটখাটো একটা প্যান্ডেল ।প্যান্ডেলের বাইরে বাড়িতে ঢোকার গেটে সোলার তৈরি পানপাতার ওপর লেখা 'অঞ্জলি ওয়েডস সার্থক '।কোথাও প্রচন্ড ব্যস্ততায় কেউ ডালা সাজাচ্ছে ,তার পাশে বসে বছর ষোলোর দুই মেয়ে পরস্পরের শাড়ি ঠিক করতে ব্যস্ত ,আবার কোথাও পাড়ার বৃদ্ধারা আচার নিয়মের তদারকি করছেন ।এরই মাঝে এক তলার কোনার ঘরটায় এই কর্ম ব্যস্ততার মাঝে কর্মহীন অলস মেজাজে বসে আছে অঞ্জলি ।লালপেড়ে হলুদ শাড়ি পড়া ।যার চোখে এখন কেবলই ভাসছে পুকুর পাড়ে বটতলায় বসে সার্থকের সাথে কাটানো অলস দুপুর গুলোর ছবি ।
২
-তোর ট্রেনিং শেষ হলে , তোকে কি LOC তে পাঠিয়ে দেবে?
-ধুর ,আর্মি হলেই কি LOC তে পাঠায় নাকি !আর্মির কাজ সারা দেশকে রক্ষা করা ,ভারতমাতাকে রক্ষা করা ....
-আর নিজের জীবনের ওপর বাজি রেখে মৃত্যুকে নিয়ে খেলা ।
-ঠিকই বলেছিস ,কিন্তু মাকে রক্ষা করতে হলে এইটুকু তো করতেই হয় ।ক্ষুদিরাম ,বাদল ,দীনেশ এরকম কত শত বিপ্লবী তো এভাবে মায়ের জন্য প্রাণ দিয়েছেন ।
-আচ্ছা ,তোকে ওরা কোথায় পাঠাবে সার্থক ?
-জানিনা ,এখনো কিছু জানায় নি, তবে মনে হয় আসামের দিকে পাঠাতে পারে ।
-তোর ভয় করছে না ?
-ভয় !আমি একজন সৈনিক ।দেশ মায়ের জন্য লড়াই করা আমার ধর্ম আমার কিসের ভয় !
-কষ্টেরও হচ্ছে না ?
-তা অবশ্য একটু হচ্ছে ।তবে এক মায়ের কোল ছেড়ে আর এক মায়ের কোলেই তো যাচ্ছি ,সেই আমার যত্ন নেবে ।তাছাড়া আমি তো ছুটিতে ছুটিতে আসবোই ,তোর সাথে ,মায়ের সাথে, ভাইয়ের সাথে, এই গ্রামের প্রত্যেকের সাথে দেখা করব ।তুই কাঁদছিস অঞ্জলি ! তুই তো আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ....তুই ভেঙে পড়লে আমার মনোবলও ভেঙে পড়বে .....
-না ,আমি সেই জন্য কাঁদছি না, এই কান্না আমার গর্বের অহংকারের ...
-তুই কষ্ট পাবি না তো ?
-পরে কি পাব না পাব জানিনা,তবে এখন রেগে তো যাচ্ছি বটেই ।
-কেন ,আমি আবার কি করলাম ?
-কালকের দিনটার কথা আবার বেমালুম ভুলে গেছিস।
-কেন আগামীকাল কি?
-Valentine's day
-ওহো ,সেই তোর ঢাক ঢোল পিটিয়ে ভালোবাসা জ্ঞাপন এর দিন তো !থাক ওটি যত ভুলে থাকা যায় ততোই মঙ্গল ..
-আবার নিজের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছিস !!!
-নারে ,সত্যি আমার বড় অদ্ভুত লাগে এই দিনটা। সারাবছর কাটাকাটি মারামারি করে একদিনই ভালোবাসতে হয় ,তাইতো ?
-মোটেই না এই দিন অঙ্গীকার বদ্ধ হওয়ার দিন ,সারাবছর ভালোবাসায় থাকার অঙ্গীকার ।
-তোর সাথে তর্কে পারব না ,তবে এই বছর এইদিনটা আমরা একসাথে যাপন করব পরের বছর এই দিন আমার জীবনে নাও আসতে পারে ,তাই ....
-সার্থক .....
-"অঞ্জলি মা তোর ফোন এসেছে "
-হ্যাঁ ,মা ,যাই ....
-হ্যালো ..................
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় সোলার পানপাতাটাকে ফেলে দিল ।দীর্ঘশ্বাস কি তবে এমনই হয় !
৩
সারা বাড়ি জুড়ে নিদারুণ স্তব্ধতা ।বাড়ির সামনে কান্নার রোল উঠেছে। লাল, নীল, গেরুয়া ,গোলাপি ,সব রং এর ফেস্টুন হাতে জনৈক সব রাজনৈতিক নেতা। সেই ফেস্টুনে লেখা ,"শহীদ সার্থক মিত্রের অকাল প্রয়াণে আমরা গভীর ভাবে শোকাহত। তার পরিবারকে আমাদের আন্তরিক সমবেদনা জানাই", পাশে সার্থক এর একটা ছবি; সার্থকের একার নয় ,আগের বছর ১৫ই আগস্ট এর দিন ও যখন এসেছিল, প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে তোলা একটা ছবি ।ওই ফুলগুলোর মাঝে দাঁড়ানো ওদের সার্থক দাদা আর অঞ্জলী দিদি ,সাদা রংয়ের তেরঙা আঁচলের শাড়ীটা পড়া ,যেটা ১৪ই ফেব্রুয়ারি সার্থক ও কে দিয়েছিল আর বলেছিল ,এই রং ই ওদের ভালোবাসাকে বেঁধে রাখবে আমৃত্যু। আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি ,ভালোবাসার দিন ,সব রঙের পতাকার মাঝে সার্থক এর বাড়ির উঠোনে কাঠের একটা বাক্স, যার ওপরে তেরঙা এক পতাকা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো; তার সামনে সার্থক এর মা আর লাল পাড়ে হলুদ শাড়ির এক মেয়ে ......যার কানে এখন একটাই কথা ভাসছে এক মায়ের কোল ছেড়ে আর এক মায়ের কোলে যাচ্ছি সেই আমার যত্ন নেবে ।