সুপারহিরো
সুপারহিরো
সুপারহিরো
সায়ন কুমার সিংহ
বাবাকে ঠিক বুঝতে পারে না রণিত। মানুষটা কখন যে কী বলে তার কিছু ঠিক নেই। আজ সকালেই তো এক দফা ঝেড়ে দিল ওকে। কী ভুল করেছে না, দাঁত মাঁজতে গিয়ে ব্রাশে টুথপেস্টের জায়গায় ঠাকুমার হাঁটু ব্যথার মলমটা লাগিয়ে ফেলেছিলো।
তারপর ও যেই না ব্রাশটা দাঁতে লাগাতে যাবে ঠিক সেই সময়ই বাবা এসে ধরেছিলো ওকে, “আরে করছিস কী! ওটা যে ব্যথার মলম ওটা দিয়ে দাঁত মাজবি!”
বাবা পেপার পড়তে পড়তে ছুটে এসেছিলো দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল রণিত। ও তখনো বুঝতে পারেনি কী ভুল করেছে। ব্রাশটা নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ শুকে বুঝেছিলো কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে!
কিন্তু মনের অবস্থাও কী এখন আর ভালো আছে রণিতের। সব ঘেঁটে গেছে ওর জীবনের। শ্রেয়া চলে যাওয়ার পর থেকে আর কিছু ভালো লাগে না ওর। খালি মনে হয় বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর বসে থাকে চুপ করে। কিন্তু এসব তো আর বাবাকে বলা যায় না। তাই ভেতরে ভেতরে ভেঙে গেলেও সবার সামনে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করে রণিত। সবসময় পারে না। কিন্তু ও চেষ্টা করে।
দীপ বলে, “শ্রেয়া কেন তোর কাছে থাকবে বল? ও কত স্মার্ট। ওকে দেখতে ভালো। কত ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারে। ওর পছন্দ সুপারহিরো। আর ওর পাশে তুই? নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছিস? চোখে চশমা। মাথার চুল স্কেল মেপে আঁচড়ানো। তোর সাথে ওর হবে না কোনোদিন। তুই বেকার ওর পেছনে ইট পাতিস না। তোর বরং শ্রীময়ীই ভালো।”
দীপ রণিতের বন্ধু। তবে ভালো বন্ধু না খারাপ বন্ধু সেটা রণিত বোঝে না। ও শুধু বোঝে রণিত অনেককিছু জানে। এই যেমন কঠিন কঠিন আলযেবরার অঙ্ক, কেমিস্ট্রির একুয়াশনস - রণিত সব করে দেয় চোখ বন্ধ করে। আর সেখানে রণিত চিরকালের ব্যাকবেঞ্চের। কখনো টেনেটুনে একশোয় তিরিশের বেশি ওঠে না। অঙ্ক করতে হলেই ওর গায়ে জ্বর আসে। সেখানে শ্রেয়ার মত একটা সুন্দরী মেয়ে কিনা ওর সাথে প্রেম করবে! না না এটা সম্ভব নয়।
এই যে দীপ মাঝে মাঝে শ্রীময়ীর কথা বলে, শ্রীময়ী রণিতদের ক্লাসেই পড়ে। গোল ফ্রেমের চশমাটা পরে যখন শ্রীময়ী ক্লাসে ঢোকে, রণিতের তো মনে হয় কোনো স্টুডেন্ট না জিওগ্রাফির অর্চনা ম্যাডাম আসছেন।
সবাই বলে শ্রীময়ী নাকি পছন্দ করে রণিতকে কিন্তু ওর সেটা মনে হয় না। কারোর সাথে ভালো করে কথা বললেই সেটা প্রেম হয়ে যায় নাকি!
ঘর থেকে বেরোতেই আবার বাবার মুখে পড়লো রণিত, “কোথায় বেরোচ্ছিস রে এই দুপুরবেলা।”
রণিত আমতা আমতা করে বলে, “দুপুর কোথায়! ইয়ে মানে চারটে বেজে গেছে তো। আমি একটু খেলতে যাচ্ছি।”
“হুম। পড়াশোনার তো বালাই নেই। বিকেল হতেই উনি বেরিয়ে পড়লেন।” বাবা রাগত স্বরে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
রণিত কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এল বাইরে। তারপর ওর সাইকেলটা বের করে ছুটিয়ে দিল মাঠের দিকে।
“আরে করিস কী! করিস কী! এভাবে বল করে কেউ! শিউর তুইই ডোবাবি ম্যাচটা।” মাঠে যেয়ে সাইকেলটা স্ট্যান্ড করতেই রণিত শুনলো প্রতীকদার গলাটা।
“আর কীভাবে বল করব? এর থেকে বেশি আর ভ্যারিয়াশন জানা নেই আমার।” দীপ বলল।
“তা জানা থাকবে কেন! খালি এদিকে ওদিকে মন দিলে আর খেলাটা হবে কী করে। কতবার বলেছি এই প্রেম জিনিসটা জীবন থেকে বাদ দে দেখবি সব ঠিকঠাক হচ্ছে। সেসব তো বুঝবি না খালি পাকামো! এখন বোঝ…” প্রতীকদা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু রণিতকে দেখতে পেয়েই হাত নেড়ে ডাকলো ওকে, “আরে রনি! আয় আয়! এদিকে আয়! আজ দেরী হল যে?”
রণিত প্রতীকদার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “একটু কাজ ছিল গো বাড়িতে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা তোদের সব কাজ আমি বুঝি। বেশি এক্সপ্লেইন করার দরকার নেই। যা, এখন যেয়ে ফিল্ডিং কর।” প্রতীকদা কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালো না। নিজে ব্যাট করবে বলে স্টান্স নিল।
“এটা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু প্রতীকদা। এটা চিটিং। তুমি সেই কখন থেকে ব্যাট করে যাচ্ছ। আমাদেরও তো ব্যাট করতে মন চাই নাকি।” দীপ বলল বিরক্ত হয়ে।
রণিত জানে এটাই এই মাঠের অলিখিত নিয়ম। সিনিয়রদের বেশিক্ষন ব্যাট করতে দিতে হবে। জুনিয়ররা কমপ্লেইন করলে তাদের জ্ঞান দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হবে।
প্রতীকদা পসিশন নিয়ে বলল, “আহাঃ! আগে শেখ তো কীভাবে ব্যাট ধরতে হয় তারপর ব্যাট করবি।”
দীপ আর কী করবে চুপচাপ বোলিং মার্ক থেকে বল করবে বলে দাঁড়িয়ে পড়লো।
রণিত ওকে চাপা গলায় বলল, “ভালো বল কর না। প্রতীকদা আউট হয়ে গেলেই তো তুই ব্যাট পেয়ে যাবি।”
“তোর কী মনে হয়, এতক্ষন আমি প্রাকটিস করছি! তিনবার আউট করে দিয়েছি তুই আসার আগে। কিন্তু প্রতীকদা একটাও মানতে রাজি নয়। বলছে কোনটা নো-বল। কোনটা ওয়াইড। এরপর আর কী করবি বল।”
“কী রে বলটা করবি তো নাকি!” প্রতীকদা হাঁক মারলো।
কিন্তু বলটা আর করতে হল না দীপকে। কারণ তার আগেই যে মাঠে ঢুকল তাকে গত পাঁচবছরে এই পাড়ায় দেখা যায়নি একবারও।
মাঠে ঢুকল অনুদি।
সাথে শ্রেয়া। রণিত কী করবে বুঝতে পারলো না আর। ও কী কোথাও লুকিয়ে যাবে? নাকি দাঁড়িয়ে দেখবে এখানে কী করতে এসেছে দুই বোন মিলে?
পাঁচ বছর আগে কোনো একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল অনুদি। তারপর থেকে আর বাড়িতে আসেনি। পুপুন কাকু আর রত্না কাকিমা, মানে অনুদির মা-বাবার সাথেও এতদিন যোগাযোগ ছিল না অনুদির। রণিত তো শুনেছেই সবটা। পুপুন কাকু সবসময় দুঃখ করে বলে মেয়ে মানুষ করতে পারেনি। তাহলে আজ এতগুলো বছর পর আবার এখানে ফিরে এল কেন অনুদি? আর এলও যদি বাড়িতে না গিয়ে মাঠে এল কেন?
“তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে প্রতীক! আজ বিকেলে কোনো একটা ক্যাফেতে দেখা করব দুজনে।” অনুদি সোজা গিয়ে দাঁড়ালো প্রতীকদার সামনে।
“কিন্তু আমার যে আর তোমার সাথে কোনো কথা নেই অনুদি।”
“আমি জানি তুই এই কথাগুলো কেন বলছিস। কিন্তু তাও বলছি প্লিজ একবার আসিস দেখা করতে। আমি বেশি সময় নেব না।”
প্রতীকদা কিছু বলল না। ব্যাটটা দীপকে ধরিয়ে বলল, “নে এবার তোরা ব্যাট কর। আমি আর আজ খেলবো না।”
দীপ ব্যাটটা নিল। তারপর মুচকি হেসে বলল, “দেখেছিস প্রতীকদাটা কেমন! আমাদের বলে প্রেম করিস না। এদিকে নিজে হাফ-দেবদাস হয়েই আছে।”
রণিত কিছু বলল না। দেখল শ্রেয়া তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।
২.
“কী বলার আছেন তাড়াতাড়ি বল অনুদি। বেশি সময় নেই আমার।” প্রতীক ভ্রু কুঁচকে একবার তাকালো অনুর দিকে তারপর আবার চোখ সরিয়ে নিল।
“তুই এখনো আমার ওপর রেগে আছিস না খুব!”
“না না। রেগে থাকবো কেন। একদম রেগে নেই আমি। যেটা হওয়ার ছিল সেটাই তো হয়েছে। তোমার ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। এতে রাগ করার তো কিছু নেই।”
কিছুক্ষন চুপ করে থাকে অনু। তারপর বলে, “আমি যে এই পাঁচ বছর বাদে ফিরছি এখানে। কেন ফিরছি জানতে ইচ্ছে করে না তোর?”
“তুমি কেন চলে গিয়েছিলে সেটা জানতেও ইচ্ছে করে না আমার!” প্রতীকের গলাটা ওর নিজের কাছেই খারাপ শোনালো। ও সামলে নিল নিজেকে। এখন উত্তেজিত হওয়া যাবে না।
পাঁচ বছর আগে সেদিন অনুরও তো মনে হয়নি একবার প্রতীককে জানিয়ে যায়, যে ওদের আর কোনোদিন দেখা হবে না। অনু তো সেটা করেনি। হ্যাঁ প্রতীক মানছে ও অনুকে খুব ভালোবাসে। অনু যদি ওকে জানাতো যে ও চলে যাচ্ছে অন্য একটা ছেলের সাথে তাহলে কষ্ট হত ওর। কিন্তু ও কখনো আটকাতো না সেটা। কখনো পায়ে ধরে বলত না আমার কাছে থেকে যাও অনুদি।
তাই সেদিন যখন অনুও বলেনি আজ প্রতীকও কিছু বলবে না।
“অভি ছেলেটা ভালোই বুঝলি। মানে আমি ভাবতাম আর কি। সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকে ওর সাথে রিলেসন ছিল আমার। অভি কলেজ টপার ছিল। দেখতেও ছিল দারুন। কত মেয়ে ওর পেছনে ঘুরত। তাই ওরকম একটা ছেলে আমাকে প্রপোজ করল দেখে আমি আর না করতে পারিনি। আমাদের তিন বছরের রিলেসন ছিল। এর মাঝে কয়েকবার ফিজিক্যালও হয়েছিলাম আমরা। বাট উই অলওয়েজ ইউসড প্রটেকশন। কিন্তু তাও যে কী থেকে কী হয়ে গিয়েছিল!” কান্নায় বুজে আসতে চাইলো অনুর গলাটা। সেই কান্নাটাকে যতটা সম্ভব দমিয়ে রেখে ও বলল, “আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছিলাম। সেইসময় কী করব বুঝতে পারছিলাম না আমি। বাবামাকে কথাটা জানানোর মতো সাহস আমার ছিল না তাই ঠিক করেছিলাম পালিয়ে যাবো। পালিয়েই গিয়েছিলাম তাই। কাউকে না জানিয়ে। কিন্তু আমার ভাগ্য এতই ভালো যে সংসারটাও টিকলো না আমার। ডেলিভারির সময় বাচ্চাটাও মারা গেল। তার পরেও এতগুলো বছর ওখানে মুখ বুজে সব সহ্য করছিলাম আমি। কিন্তু আর পারলাম না জানিস। অভি একটা নতুন বিয়ে করেছে…” আর কিছু বলতে পারলো না অনু।
প্রতীক শুনলো পুরোটা। এতোকিছু ঘটে গিয়েছে মেয়েটার সাথে! আর ও কিনা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিল পুরো ঘটনাটা!
খুব লজ্জা লাগলো প্রতীকের। ও কী করবে বুঝতে না পেরে তাকালো অনুর দিকে। কান্নায় অনুর পিঠটা ওঠানামা করছে।
প্রতীক নরম গলায় বলল, “আয়াম রিয়ালি সরি অনুদি। আমি এতকিছু জানতাম না। তুমি ওভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর সবাই খুব খারাপ খারাপ কথা বলছিল তোমার নামে। সত্যি বলতে কী আমিও রেগে ছিলাম তোমার ওপর। আমি তোমায় প্রপোজ করেছিলাম যখন তুমি না বলেছিলে আমায়। বলেছিলে তুমি কখনো এরকম ভাবোইনি আমায় নিয়ে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম অনুদি। আমার কাছে আজও বয়সটা কোনো ম্যাটার করে না। তোমার কথাতেই আমি আর কখনো তোমাকে এই নিয়ে আর কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম আমি যেভাবে চাইছি সেভাবে না হোক তুমি একজন বন্ধু হয়ে তো থাকবে আমার পাশে। কিন্তু তুমি থাকোনি অনুদি।”
“আমরা সকলেই একটা সমাজে বাস করি প্রতীক। এই সমাজের অনেক টার্মস এন্ড কন্ডিশনস রয়েছে। এই সব মেনে চলতে হয় আমাদের। আমি তাই থাকতে পারিনি প্রতীক। কিন্ত এখন থাকতে চাই তোর সাথে আমায় থাকতে দিবি?”
প্রতীক চুপ করে থাকে কয়েক মুহূর্ত। এই কথাটা বলতে এতো সময় নিল অনু? এই কথাগুলো আগে বললেও তো পারত। কিন্তু এখন যে আর কিছু করার নেই।
প্রতীক অল্প হেসে বলল, “আমরা বন্ধু হতে পারি অনুদি। তবে অন্য কিছু নয়।”
অনু কিছুক্ষন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে প্রতীকের দিকে। কিছু বলতে পারে না।
শ্রেয়া কাল নিজেই ফোন করেছিল রণিতকে। রণিত তো পুরো অবাক। হল কী মেয়েটার!
রণিতদের এখনো একটা পুরনো টেলিফোন আছে। সচরাচর এখন আর কারোর বাড়িতে টেলিফোন দেখা যায় না। সবার হাতেই তো স্মার্ট ফোন। তবে টেলিফোনটা কানে ধরলে একটা আলাদা মজা হয় রণিতের।
কাল খেতে খেতে এসেছিলো ফোনটা।
বাবাই ধরেছিলো ফোনটা। তারপর ডেকেছিল ওকে, “এই বাবু তোর ফোন ধর।”
পাতের শেষ মাংসর টুকরোটা শেষ করে রণিত জিজ্ঞেস করেছিল, “কার ফোন বাবা?”
“ধরেই দেখো না কার ফোন! আমার অনেক কাজ রয়েছে।”
“হ্যাঁ। হ্যালো। কে?”
“আমি শ্রেয়া বলছিলাম।” শব্দ তিনটে শুনেই ক্লিন বোল্ড হয়ে গিয়েছিল রণিত। শ্রেয়া? ওকে ফোন করেছে? কেন?
“হ্যাঁ। আমি মানে বল না কী বলবি।”
“কাল একবার কফিশপে দেখা করতে পারবি?”
“পারবো। কিন্তু কখন?
“সন্ধে ছটা। লেট করবি না কিন্তু। তোর সাথে কথা আছে।”
“ঠিক আছে।”
আর কিছু না বলে কলটা কেটে দিয়েছিল শ্রেয়া।
আর আজ হল সেইদিন। ছটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি আছে এখনো। একটা চাপা টেনশন হচ্ছে রণিতের। কী জানি মেয়েটা এসে কী বলবে। ও কখনো আগে তো এরকম করে দেখা করতে বলেনি!
পাঁচ মিনিটও অপেক্ষা করতে হল না ওকে। তার আগেই শ্রেয়া চলে এল। এসেই আগে ওয়েটারকে ডেকে দুটো কোল্ডকফির অর্ডার দিয়ে ও বসল চেয়ারে।
রণিতও বসে পড়লো।
“তুই জানিস আজ কেন এভাবে তোকে ডেকেছি আমি?” শ্রেয়াই কথা শুরু করল প্রথমে।
“না। আমি কী করে জানবো? তুই তো কাল ফোনে কিছু বলিসনি আমায়?”
“দেখ, আমি জানি না তুই আমায় নিয়ে কী ভাবিস। আমি তোকে একজন ভালো বন্ধু ভেবে তোর সাথে কথা বলতাম। কিন্তু তারপর তুই হঠাৎ একদিন আমায় প্রপোজ করলি। আমি সেটা নিয়ে কিছু বলিনি তোকে। তোর কী মনে হয়, আমার কী বলা উচিৎ? হ্যাঁ না, না?”
রণিত কী বলবে বুঝতে পারে না। এরকম প্রশ্নের সামনে ও আগে কখনো পড়েনি।
রণিত বলে, “দেখ, জীবনটা তোর তাই তোর যা ভালো মনে হয় তুই সেই সিদ্ধান্তই নিতে পারিস। আমার এতে কিছু বলার নেই। তবে একটা কথা বলি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিবি না যাতে পরে বিপদে পড়িস। আমি জানি আমি তোর জন্য বেস্ট নয়। ইভেন, আমি তো কারোর জন্যই বেস্ট নয়। আমি একটা বোকা সাধারণ ছেলে যে দাঁত মাজতে গিয়ে ব্রাশে ব্যাথার মলম লাগিয়ে ফেলে, যে আজও ভাঙা তারা দেখে উইশ করে যেন তোর কোনো কষ্ট না হয়, যে বাজে পরীক্ষা দিয়ে ভাবে একশোয় একশো পাবে। আমি জানি যে তুই কখনো আমায় ভালোইবাসবি না কারণ…” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল রণিত। কিন্তু তার আগেই চেঁচিয়ে উঠল শ্রেয়া, “স্টপ ইট! আই সে জাস্ট স্টপ ইট।”
এরকম আচমকা ধমক খেয়ে চুপ করে গেল রণিত। আবার হল কী মেয়েটার এভাবে চেঁচাল কেন? ও কী ভুল করে ভুল কিছু বলে ফেলেছে?
ওয়েটার কোল্ডকফি দুটো দিয়ে যেতেই শ্রেয়া বলল, “কে তোকে জানতে বলেছে এতো? আমি বলেছি? আমি তোর কাছ থেকে শুধু জানতে চাইছি তুই কী উত্তর এক্সপেক্ট করিস আমার থেকে?”
“না। না বলে দে আমায়। কারণ আমার থেকেও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করিস। আর দীপ ঠিকই বলে, আমার জন্য শ্রীময়ীই ভালো।”
কফিতে একটা চুমুক দিতেই যাচ্ছিল শ্রেয়া। কিন্তু তার আগেই একটা ভীষণ বিষম খেল, “শ্রীময়ীর চেহারা দেখেছিস? তোর কিউব! ওর সাথে তোকে মানাবে না।”
“তাহলে আমার জন্য আর কে রইল? আমাকে তো কেউ পছন্দই করে না।”
“উফঃ! বড্ড বোকা তুই! আরে আমি একটা পরীক্ষা নিচ্ছিলাম তোর। তাতে তুই পাশ করে গেছিস।”
“পরীক্ষা?” মাথা চুলকোয় রণিত, “এতক্ষন কী তাহলে ওরাল চলছিল?”
“আমার দিদি কেন ফিরে এসেছে জানিস? দিদি যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে দিদির সাথে। তাই দিদি ফিরে এসেছে। আর দিদি ভাবছে এবার প্রতীকদাকে বিয়ে করবে।”
“এই সত্যি নাকি? আমিও দীপের কাছে শুনলাম ব্যাপারটা।”
“হ্যাঁ।” অল্প হাসে শ্রেয়া, “আমি দিদির মতো আর ভুল করতে চাই না। তাই ঠিক করেছি যে আমি আর ভুল করব না। আই লাভ ইউ রণিত।”
কী বলবে বুঝতে পারলো না রণিত। এভাবেও হয় নাকি? ভাললাগায় মুগ্ধ হয়ে আর কিছু বলতেই পারলো না ও।
শ্রেয়া বলল, “তোর আগেও আমাকে অনেকে প্রপোজ করেছিল জানিস, কিন্তু আমার ভালো লাগেনি কাউকে। তবে এখন মনে হচ্ছে আমি তোর ওপর ভরসা করতে পারি। কিন্তু কথা দে, কখনো আমায় ছেড়ে যাবি না? আমার দিদি সাথে যেমন করেছিল অভিদা, তুই করবি না?”
“তোকে ছুঁয়ে বলছি। কখনো তোকে ছেড়ে যাবোই না। কারণ তোকে ছেড়ে আমার কোথাও যাওয়ারই নেই। আর…”
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল রণিত। কিন্তু তার আগেই গলাটা পেল ও, “এই রণিত! এদিকে আয় তাড়াতাড়ি!”
এটা তো প্রতীকদার গলা। প্রতীকদা কী করছে এখানে? আর ও জানলোই বা কী করে রণিত এখানে রয়েছে!
“তোর জন্য একটা দারুন নিউজ আছে রণিত। ওই দীপটাই তোদের সম্পর্কটা কেঁচিয়ে দেওয়ার মতলব করছিলো। আমি আজ জানলাম সবটা। ও শ্রেয়ার কাছে তোর নামে খারাপ খারাপ কথা বলে ওর সামনে তোর ইমেজটা খারাপ করার চেষ্টা করত কারণ ও শ্রেয়াকে পছন্দ করে। দীপ ওকে প্রপোজও করেছিল। কিন্তু শ্রেয়া রাজি হয়নি। কী ঠিক বলছি তো সব?” প্রতীকদা তাকালো স্নেহার দিকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় শ্রেয়া-ও একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। ও ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ তো। ও-ই তো আমায় রনির নামে উল্টোপাল্টা বল তো। আমি বেশিরভাগ সময়েই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু কয়েকটা কথা বিশ্বাসও করেছি।”
রণিত কী বলবে বুঝতে না পেরে একবার প্রতীকদার দিকে আরেকবার শ্রেয়ার দিকে তাকালো। শেষে দীপ এমনটা করতে পারলো ওর সাথে? ও না রণিতের বন্ধু।
প্রতীকদা তাড়াহুড়ো করে বলল, “নে। এবার কিন্তু হ্যাপি এন্ডিং চাই। আমার আর এখানে কাজ নেই কোনো। আমার জন্য আবার অনু অপেক্ষা করছে।”
প্রতীকদা কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই যেমন হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলো, সেরকম করেই চলে গেল।
শ্রেয়া বলল, “তুই এরপরেও বলবি দীপ তোর বন্ধু? আমার কথা শোন ওর সাথে আর কথা বলবি না একদম।”
রণিত কিছু না বলে ঘাড় নাড়লো শুধু। ও জানে ও কালই আবার কথা বলবে দীপের সাথে। কারণ ও তো বোকা। ও আবার অঙ্কে কম নম্বর পাবে। পাওয়ার কাট হয়ে গেলে ভয়ে হিন্দি গান গাইবে জোরে জোরে। আর হয়ত আবার কাল দাঁত মাজতে গিয়ে ব্রাশে কোলগেটের জায়গায় ঠাকুমার ব্যথার মলম লাগিয়ে ফেলবে। কিন্তু রণিত একটা বিষয়ে নিশ্চিত যে কাল থেকে নিজেকে একটু একটু করে বদলানোর চেষ্টা করবে ও। কারণ নিজের জন্য না হলেও ওকে শ্রেয়ার জন্য সুপারহিরো হয়ে উঠতে হবে।

