স্স্টেরলিং শারদীয়া (শরৎকাল)
স্স্টেরলিং শারদীয়া (শরৎকাল)
পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তৃণা ভাবছে আর মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার।এরপরই ইতি ঘটতে চলেছে তার দুই বছরের বিবাহিত জীবনের।একমাত্র মেয়ের কাছে থাকবেন বলে অনেক শখ করে পাশের ফ্ল্যাটটা কিনেছিলেন ওর বাবা-মা।সব মিলিয়ে ভালোই কাটছিলো দিনগুলো। কিন্তুু কি করে যে কি হয়ে যায়...আমাদের হাতে বোধ হয় সত্যিই সবটা থাকে না! নইলে চার বছরের সম্পর্কের বিয়ে যে এভাবে ভেঙে যাবে স্বপ্নেও কল্পনা করেনিতো সে!
তৃণা নিজে একটি ব্যাঙ্কের ম্যনেজার হওয়া সত্বেও সংসার আর কাজ সবদিক সামলে চলার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে অয়ন প্রাইভেট কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার বলে তৃণা নিজেই কোনদিন মাত্রাতিরিক্ত সময় আশাও করেনি তার স্বামীর কাছে। কিন্তুু নূন্যতম একটু আবদার- আকাঙ্ক্ষা তো থেকেই যায়! সেটাও যদি পূরণ না হয় তো মন আর কয়দিন মানে? এমনিতেই আজকাল অ্যাডজাস্টমেন্ট শব্দটার থেকে বেটার অপশন খুঁজে নেওয়াটা বেশি সহজ! যদিও তৃণা অন্য কারোর কথা ভুলেও ভাবছে না এখন! আপতত এই তিক্ত সম্পর্ক থেকে বের হওয়াতেই দুজনের মুক্তি!
অফিস,সোশ্যাল মিডিয়া আর বন্ধুদের চাপে কখন যে ওদের ভালোবাসাটা হারিয়ে গেলো কেউই টের পেলো না। অয়ন ছেলে হিসেবে বা প্রেমিক হিসাবে সত্যিই অনবদ্য কিন্তুু স্বামী হিসাবে যে এতোটা ব্যর্থ হবে তা আগের থেকে কি করে বুঝবে সে? সত্যিই কি এভাবে বোঝা যায়? প্রেমিকাকে বউ রূপে পেয়ে ওকে হারানোর ভয়টাই হারিয়ে ফেলেছিল অয়ন।বার কয়েক তৃণা বলার চেষ্টা করেছে যে গাছকে যত্ন না করলে যেমন মারা যায় ঠিক তেমন সম্পর্কেও যত্ন লাগে।অন্তত মাঝে মাঝে একটু সময় খরচ করাটা যে বাধ্যতামূলক! সারাদিন অফিসের পর ক্লান্ত তৃণা যতবার স্বামীকে চেয়েছে ততবারই অবহেলা ভরে অয়ন ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।আবার কখনো রাত জেগে পার্টি করে বাড়ি ফিরেই ঘুমিয়ে পড়তো অথচ ওর জন্য যে মেয়েটি না খেয়ে বসে আছে সেদিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেনি কোনদিন। কতোটা অভিমান যে নিজের প্রেমিক তথা স্বামীর ব্যবহারে জমতে শুরু করেছে তা টেরও পায়নি অয়ন। অবশেষে একদিন অসহ্য হয়েই ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটা নিলো তৃণা। অয়ন এতোটাই দূরে সরে গেছিলো যে আর ফিরে আসার রাস্তা পেলোনা! আদরে নিজের স্ত্রীকে কাছে টেনে নেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে অয়ন! যদিও ফেসবুকে প্রেমের পঙক্তি শেয়ার করতে ঠিকই জানে সে! !
ডিভোর্সের আগে আলাদা থাকবে ভাবলেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো এই করোনা ভাইরাসটা।তৃণার মা-বাবা ওদের গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে গিয়ে আটকে আছেন আর রক্তিমের বাবার হার্ট অপারেশন হওয়ায় এখুনি এই দুঃসংবাদটা ওরা দিলো না। অতএব সুখী দম্পতির অভিনয় করা ছাড়া আর উপায় নেই! আর এই হঠাৎ উদয় হওয়া ভাইরাসটার জন্য কোথাও যাওয়ারও উপায় নেই।সারাদিন ঘরে বসে না চাইলেও কিছুটা সময় ওদের নিজেদের দখলে চলেই যাচ্ছে। আজ গোধূলির আলোয় ব্যালকনিতে তৃণা একা থাকলেও একটু পর অয়ন এসে পাশে দাঁড়ালো।বিশেষ কোনো কথা না হলেও দুজনেই দুজনকে অনুভব করলো যেনো অনেকদিন পর ...
এভাবেই দেখতে দেখতে পুজো চলে এলো ...আজ ষষ্টি... নীল জামদানিতে মোহময়ী লাগছে তৃণাকে ... বলাই বাহুল্য আধুনিকতা, চাকচিক্য অভাবে নিষ্প্রাণ হয়ে রইলো পুজো মণ্ডপ! মা যে শিউলির গন্ধে ঠিকই এসেছেন সেটা আর কেউ খেয়াল করলো না! যদিও এবার ভীড় কম তবুও স্নিগ্ধতাতো আছেই! বিকেলে কোথাও বেরোবে না বলে পাড়ার প্যান্ডেলের এককোণে বসে মায়ের প্রতিমার চোখের দিকে তাকিয়ে তৃণা ভাবছে একঘেয়ে ব্যস্ত জীবনে দামী ক্লাব,রেস্তোরাঁ সব কিছুতে পূজাটাও অন্যবার হারিয়ে যায়। মায়ের মুখটাই সেভাবে দেখা হয়ে উঠে না! এবার যেনো নিছক মা দুর্গাকে দেখতে পাচ্ছে সে! অবচেতন মনেই ভাবলো একটাবার অয়ন যদি ক্ষমা চাইতো, ওকে আদরে আবদারে ভরিয়ে দিতো, ঠিক ওদের সম্পর্ক থাকতে যেমন করতো তেমনভাবে, তাহলেই তো সব আবার আগের মতো হয়ে যেতো।
এভাবেই সপ্তমীর বিকেল চলে এলো আর তৃণার বাবা মাও আজ সকালেই ফিরলেন। ঘরে বাবা-মা,শ্বশুর- শ্বাশুড়ী সবাই মিলে খাঁটি বাঙালির আড্ডায় মেতে উঠেছে।এদিকে তৃণা আর অয়ন এই নীরবতা,এই হঠাৎ থেমে যাওয়া জীবনটায় যেনো সবচেয়ে বেশি অকৃত্রিম শান্তি আর ভালোলাগা খুঁজে পাচ্ছে। কতোদিন নিজেদের বুড়ো বাবা-মাকে সময় দেওয়া হয় না! এইতো বেশ লাগছে! একসাথে পুরো পরিবার কতো কথা কতো হাসি! পরদিন অষ্টমীর অঞ্জলিটাও একসাথে নিলো সবাই। লাল-সাদা গরদের শাড়ি আর মানানসই স্বর্ণের অলংকারে আবারও অয়নের চোখে দেবীর মতো পবিত্র দেখাচ্ছে তৃণাকে! সবসময় সুন্দর করে সাজলেও এতোটা সময় নিয়ে শান্তভাবে নিজের স্ত্রীকে দেখার অবকাশ সত্যিই অনেকদিন পর পেলো সে। রাত নটার দিকে পাড়ার পূজোতেই তৃণাকে একটু ঘুরে আসতে অনুরোধ করলো অয়ন।অনেকদিন পর অয়ন কিছু চাইলো তাই মানা করতে পারেনি তৃণাও। দুজনেই গেলো। ছোট্ট প্রাণবন্ত পুজোতে একটু বসে ওদের চেনা গলি ধরেই হাটতে লাগলো দুজন। হঠাৎ ওর ডান হাতটা চেপে ধরে অয়ন।আর বলে 'প্লিজ একটা শেষ সুযোগ দাও! আমাদের মধ্যেতো তেমন বড়ো কোনো সমস্যা নেই। শুধু নিজেদের কাজের চাপ আর বন্ধু, সোশ্যাল মিডিয়াএসবকে সময় দিতে গিয়ে অল্প অল্প করে দূরে সরে গেছি আমরা।আর যখন বুঝতে পারলাম তখন নিজদের ইগো, আত্মসম্মান এসব বাঁধা হওয়ায় আর ফিরে তাকাতে পারছি না।তোমার অভিমান ভাঙানোর সাহসটা পেতে আমার এতদিন লেগে গেলো! হয়তো তুমি চোখের সামনে থাকায় আজ সব বলতে পারছি। যদি ওইদিনই চলে যেতে হয়তো সারা জীবনের জন্য তোমায় হারিয়ে ফেলতাম। সত্যিই আমরা আধুনিকতার মোড়কে মনের অনুভূতির হত্যা করে চলি রোজ। আজ নিজেকে অপরাধী লাগছে ঠিকই কিন্তুু ভাগ্যবান ও মনে করছি। কারণ সত্যিটা উপলব্দি করতে পেরেছি যে! সেই প্রথম দিনের মতো আবার মন খুলে বলছি, ভালোবাসি তোমায়! আই লাভ ইউ নয় আমি তোমাকে ভালোবাসি!' একনাগাড়ে কথা গুলি বলে চুপ হয়ে যায় অয়ন।
দুচোখ জলে ভেসে যায় তৃণার...সব অভিযোগ,অভিমান নিমেষেই কান্নার সাথে ধুয়ে গেলো ওর। নিজেকে সামলে অয়নের হাত শক্ত করে ধরে শুধু বললো 'মর্ডান হওয়াও দরকার। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতেই হয় কিন্তুু প্রেমের খড়কুটো যেনো বাইরের চাকচিক্য আর কৃত্রিমতায় ভেসে না যায় এবার থেকে সেটাই লক্ষ রাখবো আমরা!' মনে মনে দুজনেই ভাবছে এবারের পুজোটা সত্যিই 'স্স্টেরলিং', বাংলায় যাকে বলে 'খাঁটি!' চোখ বন্ধ করে আরও জোরে অয়নকে জড়িয়ে ধরলো তৃণা...
দূরে প্যান্ডেলে গান বাজছে 'হয়তো তোমারই জন্য, হয়েছি প্রেমে যে বন্য...'