STORYMIRROR

Priyanshu Datta

Drama Tragedy

4  

Priyanshu Datta

Drama Tragedy

স্মৃতির খড়কুটো।

স্মৃতির খড়কুটো।

4 mins
28

বিয়ের প্রায় আট বছর পর তিস্তা তার স্বামী অভিক এবং তাদের দুই বছরের ফুটফুটে মেয়ে আত্রেয়ীকে নিয়ে বালিগঞ্জে তার মামার বাড়িতে এসেছে, কারণ মামা চিকুনগুনিয়ার কারণে গুরুতর অসুস্থ।
তিস্তার মা-বাবা ছিলেন না। মামা-মামীর কাছেই সে মানুষ হয়েছে, এবং তাদের নিজস্ব কোনো সন্তান না থাকায় তিস্তাই ছিল তাদের কাছে নিজের সন্তানের মতো।তিস্তার এম.কম শেষ হওয়ার পর, মামা-মামী তিস্তার সাথেই অভিকের বিয়ে দেন। অভিক মামার এক ঘনিষ্ঠ প্রবাসী বন্ধুর ছেলে। অভিকরা মুম্বাইয়ের বাসিন্দা। বিয়ের পর তার এই দ্বিতীয়বার কলকাতায় আসাটা কিছুটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও।
 শ্বশুরবাড়িতে কোনো কাজের লোক না থাকায় তিস্তাকেই সব কাজ করতে হয়, এমনকি শ্বশুর-শাশুড়িকেও ভীষণ যত্নে রাখে।অভিক একটি প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করে। বাড়িতে ফিরতে তার রাত সাড়ে আটটা বেজে যায়। এরপর ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপে কাজ করা, খাওয়া-দাওয়া, আর তারপরই ঘুম। ছুটির দিনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সে এতই ব্যস্ত থাকে যে, স্ত্রীকে সময় দিতে পারে না।প্রথম প্রথম ভীষণ খারাপ লাগতো, প্রায়শই ঝগড়াও হতো দু'জনের, তবে এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। সম্ভবত অভিকের কাছে বিবাহ মানে শুধু স্ত্রীকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা,দাম্পত্যের মূল্যবান মুহূর্তগুলো উপভোগ করা নয়। কিন্তু আত্রেয়ী তিস্তার জীবনে আসায়, ও যেন হাতে চাঁদ ফিরে পেলো। কাজের পর আত্রেয়ীকে খেয়াল রাখতেই সময় কখন পার হয়ে যায় বোঝাই যায় না।
মামাবাড়িতে এসে রোজনামচা থেকে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।
বেশ কয়েকদিন কেটে গিয়েছে,এখন মামা প্রায় সুস্থ। তাই কখনও-কখনও অভিক,আত্রেয়ীকে নিয়ে ঘুরতে যায় মামার পুরোনো গাড়িতে করে।অভিকের ব্যবহারে একটা মারাত্মক বদল ঘটেছে, সে যেমন আত্রেয়ীকে ভীষণ খেয়াল রাখছে তেমনই তিস্তাকে অনেকটা ভালবাসতে পেরেছে।তিস্তা যেন এই অভিক কে চিনতেই পারছে না।
হঠাৎই এক সকালে তিস্তা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে একটি শিরোনামে এসে থমকে দাঁড়ালো: 'কলকাতার আইকনিক হলুদ ট্যাক্সি বয়স এবং নিয়মকানুন মিলিয়ে বিলুপ্তির পথে।'
হলুদ ট্যাক্সির সঙ্গে জড়িত ওর প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে,এবার কি ঈশ্বর এতটাই নিষ্ঠুর হয়েছেন ওর প্রতি যে সেই মানুষটার সাথে জড়িত স্মৃতিও মুছে যেতে বসেছে। 
মনে পড়তে লাগলো কলেজের দিনগুলির কথা। তখন তিস্তা যোগমায়া দেবী কলেজে বিকম দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত। একদিন কলেজ শেষে প্রচণ্ড গরমে তিস্তা অটোর জন্য অপেক্ষা করছিল। অনেকক্ষণ পর একটা হলুদ ট্যাক্সি পেয়ে সে উঠে পড়লো।ড্রাইভার গলা ভারী করে বললো, 'আমি এখান থেকে বালিগঞ্জে যেতে ১০০ টাকা নিই, কিন্তু আপনার জন্য ৮৫ টাকা করলাম।' বলেই সে তিস্তার দিকে তাকিয়ে হাসল।
তিস্তা ভার্গব শর্মাকে দেখে প্রায় খুশিতে লাফিয়ে উঠেছিল। ভার্গব আর সে পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি একসঙ্গে পড়েছে। প্রত্যেক বছর ভার্গব ক্লাসে প্রথম হতো। তার ইচ্ছে ছিল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আইআইটি-তে পড়বে, কিন্তু আজ সে ট্যাক্সি ড্রাইভার?
তিস্তার জিজ্ঞেস করার আগেই ভার্গব বললো— 'আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্তদের আশা সবসময় পূরণ হয় না রে...আমার উচ্চ-মাধ্যমিক দেওয়া হয়নি।'"
"কেন?"
ভার্গবের হাসি মিলিয়ে গেলো। বেদনা-মিশ্রিত গলায় সে বললো–"ডিসেম্বরেই বাবার হঠাৎ স্ট্রোক করে। আমরা হাসপাতালে ভর্তি করি। বাবা দু'দিন পর কোমায় চলে যান। ফেব্রুয়ারিতে তিনি আমাদের ছেড়ে যান।বাবার ট্যাক্সিই এখন আমি চালাচ্ছি। মা লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে।আমার ছোটো ছোটো দুটি বোন আছে, একজন মাধ্যমিক দেবে, তাদেরও তো কত স্বপ্ন আছে, একজন আই.এ.এস. হওয়ার জন্য দিনরাত মেহনত করছে। ওদের স্বপ্নপূরণ হলেই, আমি স্যাটিসফাইড।"
তিস্তা কিছু বলতে পারল না, শুধু ভার্গবের দিকে চেয়ে রইলো। ভার্গব কোনো বিভ্রান্তি ছাড়াই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে।
তিস্তা বালিগঞ্জে পৌঁছে ভার্গবকে ন্যায্য ভাড়াটা ভার্গবের আপত্তি সত্ত্বেও হাতে গুঁজে দিলো। সে বললো, "আজ মামা অফিসের মিটিংয়ে আছেন তাই আসতে পারেননি, কিন্তু কাল থেকে তুইই আমায় নিয়ে আসবি ট্যাক্সি করে, চিন্তা করিস না, পুরো ভাড়াটা পেয়ে যাবি"।
এভাবেই প্রত্যেক দিন কলেজ শেষে ভার্গব তিস্তাকে বালিগঞ্জে পৌঁছে দিত। সেই সময় ভার্গব কোনো যাত্রীকে ট্যাক্সিতে ওঠাত না। তাদের পরস্পরের মধ্যে চলতো নানান রকমের গল্প। এরপর ওরা একে অপরের ফোন নম্বর নিলো।
ছুটির দিন সন্ধ্যেবেলায় ওরা রবীন্দ্র সরোবরে সময় কাটাত। তাদের বন্ধুত্বটা ক্রমশ প্রেমে পরিণত হল।একবার ভার্গবের ভাড়া বাড়িতেও গিয়েছিল। ভার্গবের বোনদের দেখে তিস্তা খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে,ওদের উজ্জ্বল চোখে কত স্বপ্ন।ভার্গবের বাড়িটি সংকীর্ণ হলেও ভালোবাসায় ভরা আশ্রয়, যেখানে অভাব থাকলেও পরিবারের সদস্যরা একে অপরের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে।
এই তিন মাস সব কিছু'ই বেশ কাটছিল,তিস্তা একদিন ওর কলেজ শেষে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ভার্গবের জন্যে, কিন্তু প্রায় আধ ঘণ্টা পার হওয়ার পরও যখন ভার্গবের দেখা নেই তখন অভিমান করে একটা অটো করেই রওনা হলো। এমনই করেই প্রায় ১ সপ্তাহ কেটে গেল।
সেইদিন ছিল বৃষ্টিমুখর সোমবারের সন্ধ্যে,তিস্তা সেইদিন ছাতা মাথায় ভার্গবের ভাড়া বাড়িতে পৌছালো, কিন্তু বাড়ির দরজা তালা বন্ধ। রাস্তা দিয়েই একজন মহিলা যাচ্ছিলেন সে তিস্তা'র সামনে এসে বললেন–"তুমি শর্মা পরিবারকে খুঁজছো মা?"
তিস্তা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে–"হ্যাঁ ,আপনি ওনাদের চেনেন?"
"আসলে আমরা এই বাড়ির মালিকের প্রতিবেশী।"
তিস্তা হাতজোড় করে ওনার সামনে বলল –"আপনি কি জানেন ওনারা কোথায় আছেন?প্লিজ বলুন না!!"
"ওদেরকে মালিক ৪ দিন আগেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন ঘরের ভাড়া মেটাতে পারছিলেন না বলে, এবং পাড়া-ভর্তি লোকের সামনে হেনস্থা করেন।এখন ওঁরা মা-২ মেয়ে মিলে পথে বসবে।"
"ওনার...ওনার ছেলে কোথায়, ছেলের কি হয়েছে?"
শেষ কথা তিস্তা প্রায় চেঁচিয়েই বললো। 
মহিলাটি কাষ্ঠ হেসে বললেন–"গরীবদের কি কষ্টের অভাব থাকে মা!! এক সপ্তাহ আগে ওই হতভাগা ছেলের একটা ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট হয়,ড্রাইভার মদ্য অবস্থায় ছিল।হলুদ ট্যাক্সি প্রায় পিষে দিয়ে চলে যায়, ব্যাস ছেলেটার ওখানেই স্পট ডেড... বড়ো সাধের ট্যাক্সি ছিল ওর...আর এই মোক্ষম সুযোগই মালিক খুঁজছিলেন...।"
মহিলাটি কথা শেষ করতে পারলেন না কোথায় যেন প্রচন্ড জোরে বাজ পড়লো,মহিলাটি তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লেন বাড়িতে। তিস্তার ছাতা হাত থেকে ছিটকে পড়ল, কানফাঁটা আর্তনাদ করে রাস্তাতে বসেই কাঁদতে লাগল, তবে সেই কান্না বৃষ্টির তীব্র আওয়াজে মিলিয়ে গেলো। 
তিস্তা খবরের কাগজ বন্ধ করে ভাবে-'মানুষ এতটাই নির্মম যে তাঁদের অধীনে যারা থাকেন তাদেরকে অত্যাচার করতে ভীষণ মজা পান।এই পৃথিবীতে ভার্গবের মতো'ই কত মানুষ থাকে যাদের আত্মত্যাগের গুরুত্ব নেই, ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকে, যেমন হলুদ ট্যাক্সি নতুন মডেলের সাথে সংগ্রাম করতে পারছে না বলে বিলুপ্ত হতে বসেছে। আচ্ছা,আজ যদি ভার্গব বেঁচে থাকত সে কি এই খবরটা মেনে নিতে পারতো?' 
তিস্তার চোখ দিয়ে হঠাৎ'ই জল গড়িয়ে পড়লো।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama