প্রকৃতির সাথে পুনর্মিলন।
প্রকৃতির সাথে পুনর্মিলন।
পুজোর ছুটি শেষ হতে না হতেই ঝিল আবার ফিরে এসেছে দমদমে। তার আসল বাড়ি দার্জিলিঙের শান্ত, পাহাড়-ঘেরা, কুয়াশা ঢাকা শহর মিরিকে। আর বর্তমানে সে সরোজিনী নাইডু কলেজে বোটানি অনার্স নিয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রী।
মিরিক আর এখানকার পরিবেশ, আবহাওয়া যেন আকাশ-পাতাল ভিন্ন। দমদমের প্রচণ্ড গরমে ঝিল হাঁসফাঁস করে। যদিও মাঝে মাঝে বজ্র-বিদ্যুৎসহ বৃষ্টি আসে এবং ক্ষণিকের জন্য পরিবেশ শীতল হয়, কিন্তু তার পরেই তাপমাত্রা আবার বাড়ে। বাতাসে আর্দ্রতাও প্রচণ্ড। সন্ধ্যে হলেই শুরু হয় ঘামাচি আর অবিরত ঘাম—যা হয়তো মিরিকে রোজ সকালে পাহাড়ের রাস্তা বেয়ে স্কুলে গেলেও হতো না। প্রায় দু'বোতল জল যেন তৎক্ষণাৎ শেষ হয়ে যায়।
ঝিলের মা-বাবা তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। তাই তাঁরা ওকে হোস্টেলে রাখেননি। একটি বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছেন, যেখানে ওর সঙ্গে থাকে দুই সহপাঠী, তিস্তা আর তটিনী। ওরা বাঁকুড়ার।
ঝিলের সহপাঠীরা যখন প্রথম জানতে পারল যে সে মিরিক থেকে এসেছে, তখন তারা খুব উৎফুল্ল হয়েছিল।
তটিনী চোখ বড় বড় করে বলল—"ইয়ার... তুই তো তাহলে ড্রিমল্যান্ডের রাজকন্যা! আমার দার্জিলিং যাওয়ার খুব ইচ্ছে, কত কিছু দেখার আছে! আমাকে নিয়ে যাবি? শুনেছি ওখানে লয়েড বোটানিক্যাল গার্ডেন ভীষণ বিখ্যাত, আর শিলিগুড়ির সেই ওয়াইল্ডলাইফ পার্ক তো বিস্ময়কর! তা, তোর ড্রিমল্যান্ড ছেড়ে হঠাৎ এই প্যাচপেচে গরম জায়গায় এলি কেন?"
ঝিল একটি মিষ্টি হাসি হেসে উত্তর দিয়েছিল—"কী করব বল? ওখানে সেরকম ভালো কলেজ নেই, যেখানে হাই প্যাকেজ পাওয়া যায়। মনিপালে পড়ারও তেমন ইচ্ছে ছিল না। নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য তো করতেই হবে। এটা ঠিক, আমি মানাতে এখন পারছি না। তবে একসময় সবকিছুই সয়ে যাবে।"
নভেম্বর মাসেও যে কখনো এমন অসহ্য তাপ সহ্য করতে হবে, তা ঝিল ভাবতেই পারেনি। ওর মা-বাবা প্রায়শই জিজ্ঞেস করতে থাকেন, দমদমে ঠান্ডা পড়েছে কিনা। বারবার একই উত্তর দিতে দিতে যখন ঝিলের অসহ্য লাগে, তখন সে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে এবং মনে মনে মুচকি হাসে। তার মনে পড়ে মা সারদার সেই বাণী—‘যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন।’
আর সত্যিই তো, মিরিকে তো অক্টোবর মাসের শেষ থেকেই হাড় কাঁপানো কনকনে শীত শুরু হয়ে যায়। যখন পড়তে ঝিলের মন চায় না, তখন যেন তার মন নিরন্তর মিরিকের শহরে তলিয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার চিরসাথী পাহাড়ের ছবি, বিশাল চা-বাগান, সবুজ গাছ-গাছালি, সেই বিখ্যাত অতি-প্রাকৃতিক হ্রদ আর শৈশবের স্মৃতি-মাখা কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর। প্রকৃতি ওকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া প্রদান করেছিল, আবার নিজের অপার্থিব সৌন্দর্যের মাধ্যমে অনেকের রুজি-রোজগারেরও জোগান দিয়েছিল।তাই জন্যেই তো উত্তরবঙ্গ বাণিজ্য এবং পর্যটনে সেরা। ঠিক তখনই দমদমের অসহ্য আর্দ্রতা যেন তার গলা টিপে ধরল। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সান্ত্বনা দিল, 'আর তো উপায় নেই। স্বপ্ন গড়তে হলে এই উত্তাপ সইতেই হবে।' আর তাই জন্যেই তো কাছের বন্ধু প্রকৃতিকে ছেড়ে আসতে হল।
কিছুদিন যেতে না যেতেই তিস্তা আর তটিনী হুডি,লেগিংস আর মাথায় টুপি পড়া শুরু করল ঘরে,আর কলেজে উলের সোয়েটার এদিকে ও ঘরেও যেমন হাফ হাতা জামা আর টপ পড়ে থাকে তেমনই কলেজেও। কিছু সহপাঠীরা হা হয়ে যায় ওকে দেখে,ঠাট্টা করে বলে – "নর্থ পোল থেকে এসেছে না,ঠান্ডা লাগবে কী করে ? আসলে এগুলি সব ভাওঁতাবাজি নিজেকে অভিক্ষেপ করতে হবে না শক্তিশালী হিসেবে,নয়তো এই ঠান্ডায়!... যখন জ্বর হবে তখন ঠেলা বুঝবে। "
শুধু এই ঠাট্টাই নয়, এরকম অনেক শুনতে হত যখন সে গরম সহ্য করতে পারত না প্রথম-প্রথম যেমন – ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়া,ও এই কলেজের যোগ্য না, ইত্যাদি।
প্রথম প্রথম রাগ উঠত ঠিকই তবে মায়ের সেই মনোমুগ্ধকর বাণী মনে পড়ত, তাছাড়া নিন্দুকের কথায় কান দেওয়া মানে সময় এবং প্রৌঢ়ি দুই'ই নষ্ট করা।
তবে তিস্তা আর তটিনী এই সহপাঠিদের মধ্যেও যেন ওর কাছে দৈত্যপুরের প্রহ্লাদ।
যখন ও এই দূরদেশে পাড়ি দিয়ে নানান কারণে মনটা ব্যথিত হয়ে যেত তখন তারাই ওকে মানসিক শান্তি দিয়ে দিয়েছিল, এবং এখনও নানান প্রকারে উৎসাহিত করে।
তবে রাতে বিস্ময়কর শীত চাগার দিয়ে ওঠে, যখন ফ্যান চালিয়েও ঠান্ডা লাগে আবার ফ্যান বন্ধ করলেও হাঁস-ফাঁস শুরু হয়ে। যেহেতু ওর একার ঘর সেহেতু কেউ দেখার নেই তাই সে ফ্যান চালিয়ে রেখে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমায়।আহ্ , এটাই হয়তো আসল শীতের আমেজ।
এভাবেই এলো ডিসেম্বর মাস। ঝিলের সেভাবে কলকাতা শহরটা ঘুরে দেখা হয়নি তাই এমনই এক দুপুরে ওরা তিনজন দুপুরের খাবার খেয়ে পরিভ্রমণ করতে লাগল। কলকাতার রাস্তায় ভীষণ যানজট তাই রাস্তা ঘোড়ার ইচ্ছে হলো না আবার ট্যাক্সিও ভীষণ ভাড়া চায় ।
তাই যখন বিকেলে সূর্য যখন প্রায় অস্ত যায় তখন ওরা পৌঁছাল প্রিন্সেপ ঘাটে। একটা যেন উতল করা শীতল হাওয়া শিহরণ দিল ঝিলকে। গঙ্গা ভেসে চলেছে, সূর্যের অস্পষ্ট আলো যেন ঝিঁকিয়ে উঠে নদীর জলকে চিকণ করে তুলেছে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য ।ও আর প্রকৃতি যে অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা ও এখন অনুধাবন করতে পেরেছে। মনে পড়ে গেল জন মুইরের সেই বাণী – 'প্রকৃতির সাথে প্রতিটি পথচলায় একজন ব্যক্তি তার চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি কিছু পায়', প্রকৃতি আসলে ঈশ্বরের শিল্প,প্রকৃতি অসীম। ও এই নতুন শহরেও প্রকৃতির অংশ হয়ে উঠবে।
মনে মনে ও গেয়ে ওঠে –
"তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু
কোথা বিচ্ছেদ নাই।।"
