TAMALI PAL

Romance Classics

3  

TAMALI PAL

Romance Classics

সিনেমায় যেমন হয়...

সিনেমায় যেমন হয়...

19 mins
235



প্রথম পর্ব:-


"রিমা এই তোমার সবচেয়ে বড় স্টুডেন্ট।" হাসতে হাসতে তিতলি কে এগিয়ে দেয় মিতা,চৌধুরী ম্যানশন এর বড় বউ। রিমা,রিমা চ্যাটার্জী এ বাড়ির একমাত্র আদরের মেয়ে নিশার উনিভার্সিটির বন্ধু। রিমার বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।মেধাবী রিমাকে কষ্ট করে কলেজ অবধি পড়ান উনি।তখন কার দিনে প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের মাইনে যৎসামান্য হতো, যাতে সংসার হয়তো চলে যেত কিন্তু সঞ্চয়ের ভাঁড়ার শূন্য ই থেকে যেত।তাই রিমার কলেজে পড়ার সময় সদ্য অবসরপ্রাপ্ত তার বাবা যখন হটাৎ ব্রেইন স্ট্রোকে মারা যান মা ও মেয়ে অথৈ জলে পরে।রিমা ভেবেছিল যাহোক করে কলেজ শেষ করে সরকারি চাকরির পরীক্ষা গুলো দেবে।কিন্তু বাদ সাধলো তার মা।অঙ্কে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মেয়েকে তিনি কিছুতেই পড়া ছাড়তে দিলেন না।চুক্তি হলো রিমা চাকরির পরীক্ষা দেবে কিন্তু সাথে সাথে মাস্টার্স ডিগ্রিও করবে।বাবার অতি সামান্য পেনশন এর টাকায় সংসার চলে,মা ঠোঙা বানিয়ে শাড়ীতে পাড় বসিয়ে ও আরো নানা টুকটাক কাজ করে রিমার পড়ার খরচ চালান।সাথে সাথে রিমা ও কিছু টুইসন পড়ায় নিজের বাড়িতে।এই প্রথম টাকার জন্য সে বাড়ি গিয়ে পড়াতে রাজি হয়েছে,তাও তার বন্ধুর ছটফটে ভাইঝিকে।

"কি নাম তোমার?" হাত বাড়িয়ে তিতলি কে কাছে টেনে নেয় রিমা।

"আমি তিতলি,তুমি?" ৫বছরের মেয়েটার আধো আধো কথায় হেসে উঠে ও বলে,"আমি রিমা"।

"বেশি নরম হয়োনা রিমা,ও একটি আস্ত হনুমান।প্রথম থেকে স্ট্রিক্ট নাহলে সামলাতে পারবেনা।" মিতার কথায় রিমা তার মিষ্টি হাসিটা হেসে বলে,"আসলে বৌদি এত ছোট বাচ্চা কোনোদিন পড়াইনি।শুধু নিশা ছাড়লোনা তাই এলাম।জানিনা কতদূর কি পারবো।তবে এত মিষ্টি ছোট সোনাকে বকা যায় নাকি? তিতলি তো আমার বন্ধু,ও এমনি আমার কথা শুনবে।কি তিতলি?"

"হ্যাঁ আন্টি" বলে তিতলি মন ভোলানো হাসি হাসলো,আসলে তিতলিরও রিমাকে খুব পছন্দ হয়েছিল।

"তাহলে আর কি যাও তোমার রুম এ আন্টি কে নিয়ে যাও।কি রিমা আজ ছাত্রীর সাথে একটু গল্প করবে তো?" মিতা রিমাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে।

"আজ রবিবার,সব্বাই বাড়িতে আছে।চল তিতলি তোর রিমা আন্টিকে আমরা দুজন পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখাই আর সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিই।" নিশার কথায় রিমা 'না' বলে না।নিশা তিতলির সঙ্গে চলে উপরের ঘরে।ওরা একে একে নিশার বাবা,মা,বড়দা আর ছোটদার সাথে আলাপ করিয়ে দেয় রিমার।সব্বাই কে খুব ভালো লাগে রিমার,শুধু ওর ছোড়দাকে বড় বেশি নাক উঁচু মনেহয়,কেন জানিনা ওকে পাত্তাই দেয়না, শুধুই তিতলির দিদিমণি হিসেবে ওর সাথে ব্যবহার করে,বোনের বন্ধুর পরিচয় ম্লান হয়ে যায়।যাইহোক রিমা মনে নেয়না, কারণ এই টুইসনটা সত্যি ওকে অনেকটাই হেল্প করবে।তাই খারাপ লাগাটা ঝেড়ে ফেলে মন থেকে।


দ্বিতীয় পর্ব:-


দিন কাটতে থাকে,আজ ছমাস হলো রিমা তিতলি কে পড়াচ্ছে।আজকাল ছোট থেকেই কম্পেটিশন এর যুগ,আর তাই মোটেই ৫বছরের বাচ্চা পড়ানো সহজ কাজ না ও বুঝতে পারে।এমনি সব কিছুই ভালো,নিশার মা বৌদি ওকে নিশার মতোই যত্ন করে,উনিভার্সিটি থেকে পড়াতে গেলে নিশার গাড়িতেই চলে যায়।শুধু নীল,নিশার ছোড়দা সামনা সামনি পড়ে গেলে অন্যদিকে মুখ করে চলে যায়। হাই/হ্যালো অবধি বলেনা কোনদিন,যেন রিমার সাথে কথা বললে সম্মানহানি হবে।রিমার প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো এখন পাত্তা দেয়না।নিশার কাছে শুনেছে ওর ছোড়দা প্রচন্ড সিরিয়াস ধরণের পড়াকু ছেলে,স্কুল কলেজে অনেক বান্ধবী ছিল কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েকে তার বেশি গুরুত্ব সে দেয়নি।ওদের বাড়িতে প্রচন্ড হ্যান্ডসাম নীল এর পাত্রী খোঁজা হচ্ছে,কিন্তু নীলের কোনো উৎসাহ নেই।সারাদিন পারিবারিক ব্যবসার কাজেই সে ব্যস্ত।পড়াশোনা ভালোবাসলেও পরিবারের ঐতিহ্যশালী বিরাট ব্যবসা একসময় লোকবলের অভাবে ভরাডুবির মুখোমুখি হওয়ায় পড়াশোনা শেষ করে প্রফেসরীকে পেশা করতে চাওয়া নীল বাবা দাদার পাশে এসে ব্যবসার হাল ধরে।এখন এই ব্যবসাই ওর জীবনের ধ্যান জ্ঞান ,আর নিজের বুদ্ধির বলে সেটাকে যে জায়গায় নিয়ে গেছে ওর বাবা দাদা কোনোদিন কল্পনাও করেনি।তাই হয়তো নীলের কথাই ওদের প্রতিষ্ঠানের শেষ কথা।কিন্তু নিশা বলেছিল নিজের লোকেদের মাঝে নীল অন্য রকম,ভীষণ হাসিখুশি আর হুল্লোড়বাজ।ওর শুধু একটাই এলার্জি 'মেয়েরা'।রিমাও জ্ঞান হয়ে থেকে জীবন যুদ্ধে লড়তে অভ্যস্ত ,তাই সুন্দরী নাহলেও মিষ্টি মুখ আর মনের অধিকারী হয়েও সেও কোনোদিন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবেনি।নিশার স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে,রুদ্র।নীলের আর নিশার একসাথেই বিয়ে হওয়ার কথা আছে।রুদ্রর সাথে আবার রিমার সম্পর্ক বেশ ক্লোজ, রিমাকে রুদ্র বোন বলে।অন্যদিকে নীল ও রুদ্র ছোট থেকেই ভালো বন্ধু।।

    ভালো ছাত্রী রিমা এতদিন বড়দের অঙ্কের দিদি হিসেবেই ভালোবাসা পেয়ে এসেছে,ভাবেনি ছোটো তিতলিও এতটা ন্যাওটা হয়ে যাবে ওর।আগে রবিবার গুলো শুধু রিমা নিজের পড়া আর মার জন্যে রাখতো এখন সকালটা চুরি করে নিয়েছে ছোট্ট মেয়েটা।ওকে সকাল ৮টায় পড়াতে আসে,তখন তিতলির মা মিতা আর ঠাম্মি ছাড়া পুরো চৌধুরী বাড়ি ঘুমের রাজ্যে।তবে মাঝে মাঝে অত সকালেও নীলের গলা পায়।রোববার সকাল গুলো ভালোই কাটে পাকা বুড়িটার সাথে,ওইদিন ওকে স্পেশাল ড্রইং ক্লাসও করাতে হয়।আসলে আঁকাটা রিমার হবি,বলা ভালো লড়াই এর অক্সিজেন।রিমা যখন পড়িয়ে ফেরে তখন ওর বন্ধু নিশা ঘুম থেকে ওঠে আর তিতলির ঠাম্মি নিশাকে রিমার কথা বলে বকুনি দেন।রিমার খারাপ লাগলেও নিশা হাসে আর বলে রিমার মতো হওয়া তার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব না।সব মিলিয়ে ওবাড়িতে সব্বাই রিমাকে নিজেদের মতো করে ভালোবেসে ফেলেছে।

আজ রবিবার সকাল থেকেই খুব বৃষ্টি হচ্ছে,তার মধ্যেও একটু বৃষ্টি ধরতেই রিমা চলে এসেছে তিতলীকে পড়াতে।আসলে এই সপ্তাহে পুচকেটার স্কুলে পরীক্ষা আছে,তাই ছোট হলেও বরাবরের সিরিয়াস রিমা ওকে উপেক্ষা করতে পারেনি। আসার সময় অতটা অসুবিধা হয়নি,কিন্তু ফেরার ঠিক আগে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এলো।রিমা বেরোতে যাবে,তখন নিশার মা আটকে দিলেন।ওদের সাথে জোর করে ব্রেকফাস্ট করতে বসিয়ে দিলেন।নিশা, মিসেস চৌধুরী, মিতা আর তিতলি মিলে গল্প করতে করতে খেতে লাগলো,কিন্তু রিমার মন পরে রইলো ওর বাড়িতে,যেখানে ওর একাকী মা হয়তো না খেয়ে ওর অপেক্ষায় বসে আছে,মার তো আর ফোন নেই আলাদা যে বলে দেবে।যাইহোক কথায় কথায় নীলের প্রসঙ্গ উঠলো।নীলের জীবন সঙ্গিনী খোঁজার কথায় মিসেস চৌধুরী মানে নীলের মার একটাই ইচ্ছা বোঝা গেল,সুন্দরী আর শিক্ষিতা একটা মিষ্টি মেয়ে তাঁর পছন্দ।আর হবে নাই বা কেন তার ছেলে সত্যি তো হিরের টুকরো,যা শুধুই আলো ছড়ায়।তাছাড়া সব সন্তানদের মধ্যে নীলের প্রতি তার টানটাও একটু বেশি,কারণ নীল ছোট বেলায় একটু অসুস্থ ছিল।বেশি ঠান্ডা বা বৃষ্টির জল আজও ওর সহ্য হয়না।একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়,বেশ কয়েকবার হসপিটালেও ভর্তি হতে হয়েছে।সব মিলিয়ে নীলের ব্যাপারে উনি খুবই খুঁতখুঁতে।রিমা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল।তারপর খেয়াল করলো বৃষ্টিটা অনেকটা কম,তাই জোর করেই বেরিয়ে এলো।হয়তো আড়াল থেকে কেউ সব কিছু শুনছিলো,দেখছিল সেটা কেউ জানলোনা।জানলোনা রিমার বেরোনোর সাথে সাথে সেও বেরিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে এই বর্ষার দিনে।

    কিন্তু রিমা বাস স্ট্যান্ডে আসতে আসতে আবার মুষলধারে বৃষ্টি নামলো।স্ট্যান্ডের শেডের নীচে দাঁড়িয়েও ভিজে যাচ্ছিল এত বৃষ্টির বেগ আর হাওয়া।হটাৎ একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো ওর সামনে, জানলার কাঁচ নামিয়ে নীল বললো ,"উঠে আসুন"। রিমা এতটাই অবাক হয়ে গেল প্রথমে কোনো কথা বলতে পারলোনা,তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,"না ঠিক আছে,আমার বাস এখুনি এসে যাবে"। নীল কিছুটা রাগী মুখ করেই ধমক দিয়ে বললো,"আমি জানি এখুনি বাস আসবে,কিন্তু আমি আপনার বাড়ির দিকেই যাচ্ছি।আর তাছাড়া বাস থেকেও নেমে কিছুটা হেঁটে তো যেতে হবে বাড়ি।এখনই তো ভিজে কাঁপছেন।উঠে আসুন বলছি।" বলে সামনের দরজাটা খুলে দিল।রিমা বুঝলো আর না বললে সেটা খারাপ হবে,তাছাড়া গাড়ির মধ্যেও জল ঢুকছিল,ও ছুটে গিয়ে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলো।

 গাড়ির মধ্যেটা একটা সুন্দর গন্ধে যেন অবশ করে রেখেছে।এত শৌখিন গাড়িতে রিমার প্রায় ভিজে যাওয়া জামা নিয়ে বসতে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল,সে জানে এই গাড়িটা নীলের খুব শখের। নীলের চুপ করে গাড়ি চালানো আরো অস্বস্তি বাড়াচ্ছিলো,বাধ্য হয়ে রিমাই কথা বললো প্রথম,"এত বৃষ্টিতে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?"

"কোথাও না।....আপনাকে পৌঁছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাই আছে",নীলের উত্তরে রিমা চমকে গেল।হতচকিত ভাব কাটলে বললো,"মানে?"

"আপনি বেরোবার পরই আবার বৃষ্টি আসায় সবাই চিন্তা করছিল।তাই আমি ...." নীলের সাথে রিমার এই প্রথম এত কথা,কিন্তু ওর কথা গুলো রিমাকে ভাবাছিলো।কিছুক্ষন চুপ থেকে ও বলে উঠলো,"আমার জন্যে চিন্তা করছে শুনে ভালো লাগলেও আপনার কোথাও যাওয়ার নেই জানলে আমি আপনার লিফ্ট নিতামনা।আমার অভ্যেস আছে এরকম ভেজার।কিন্তু আপনার তা নেই।যাইহোক ওই দোকানটার সামনে নামিয়ে দিন।আমি চলে যাবো।আর অনেক ধন্যবাদ ,এতটা কষ্ট করতে হলো আমার জন্যে।"

রিমার কথায় নীল অবাক হলো।ভেবেছিল রিমা খুশি হয়ে যাবে,নীলের একটা লিফটের জন্যে যে কোনো মেয়ে অপেক্ষা করে থাকে।তারওপর ওকে নিজের বাড়িও যেতে বললো না। কিন্তু নীল নিজেই বললো,"আপনার বাড়ি অবধি তো গাড়ি যায়।তাহলে এতটা যখন এসেছি,ঐটুকুও পৌঁছে দিতে পারব।আর মাসিমার হাতের চা শুনেছি অপূর্ব।ওটা খাওয়ার ইচ্ছা অনেকদিনের,তাই আপনি না চাইলেও আজ আপনার বাড়ি যাবো।"রিমা যে নিজের অনুভূতিগুলো গোপন করতে শিখে গেছিল কত আগে থেকে,সেও আজ নিজের বিস্ময় চাপতে পারলোনা।অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো নীলের দিকে।নীল অনুভব করতে পারছিল রিমার দৃষ্টিটা ওর মুখের দিকে না তাকিয়েও,কিন্তু গুরুত্ব না দিয়ে রিমার বাড়ির রাস্তা ধরলো।এবার বোধহয় রিমা এতোটাও চাপ নেয়ার অবস্থায় ছিলোনা,কিছুটা উত্তেজিত স্বরে বলল,"আমার বাড়ি আপনি জানলেন কিকরে?নিশাও একবারই এসেছে,তাও ওর পক্ষেও রাস্তা মনে রাখা সম্ভব না।কিন্তু আপনার গাড়ি ঘোরানো দেখে আমি অবাক হচ্ছি,যেন রেগুলার আসেন।কি ব্যাপার বলুন তো?কোনোদিন আমার সাথে ভালো করে কথাও তো বলেননি।"

নীল বুঝে গেছিল ভুল হয়ে গেছে,ধরা পড়ে যাচ্ছে কোথাও।কিন্তু আজ তো ও যেন ধরা দিতেই এসেছে।হ্যাঁ, নীল আজ ধরা পড়তেই এসেছে।অনেকদিন হলো এবার আর আড়াল ভালো লাগছেনা,অনেক কথা বলার আছে তার।কিন্তু তার আগে কিছু বোঝারও আছে।তাই হয়তো ওর বাড়ি যাচ্ছে।তাই বেশি কথা না বাড়িয়ে মুচকি হেসে বললো,"আমি অনেক কিছুই জানি।"রিমা এমনি বেশি কথা বলার মেয়ে না তাই কৌতুহল চেপে চুপ করে যায়।


তৃতীয় পর্ব:-


রিমাদের বাড়ি এককালে খুব জমজমাট ছিল।এখন সব শরীকি ভাগ হয়ে গেছে।রিমা আর ওর মার জন্যে একতলার দুটো ছোট ঘর বরাদ্দ হয়েছে।"মা,ও মা" ডাকতে ডাকতে রিমা সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ওর মা ভিতর থেকে বলে উঠলো,"ভিজে গেছিস নিশ্চই।জামা বদলে আয়।আমি লুচি ভাজছি,আজ সব তোর পছন্দের জিনিস।তাড়াতাড়ি আয়"। রিমা এই ভয়টাই পাচ্ছিল,নীলের অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,"ভিতরে আসুন"।এইসময় নীলের ফোনটা বেজে উঠলো,"হ্যাঁ নিশা বল।"নীলের একতরফা কথা শুনতে পাচ্ছিল রিমা।"না,না তোরা খেয়ে না ,আমার দেরি হবে।হ্যাঁ এক বন্ধুর বাড়িতে এসেছি।" নীলের কথায় রিমা অবাক চোখে ওর দিকে তাকাতে নীল পাত্তা না দিয়ে ওদের ঘরের মধ্যে ঢুকে এলো।

রিমার মা হটাৎ একজন অচেনা সুপুরুষ ছেলেকে মেয়ের সাথে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে এলেন রান্না ছেড়ে।ঘরের বাইরে এক চিলতে জায়গায় মা মেয়ের রান্না ঘর।রিমাদের পুরো থাকার অংশটা নীলের নিজের ঘরের থেকেও ছোট।

রিমার মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে নীল বললো,"আমি নিশার ছোড়দা মাসিমা।আপনার হাতের চায়ের প্রশংসা নিশার মুখে শুনে আজ বৃষ্টির দিনে চা খেতে চলে এলাম।কিছু মনে করলেন না তো?"রিমার মা আপাত সরল,সাধাসিধে এক মহিলা,নীলের কথায় প্রতিবাদ করে উঠলেন,"কি যে বলো বাবা।তাছাড়া আজ একটা শুভদিন।অতিথি নারায়ণের সেবা তো ভালো লক্ষণ।" রিমা মা কে থামানোর আগেই তিনি বলে উঠলেন,"আজ আমার রিম এর জন্মদিন বাবা।চা খাওয়ার আগে দুটো লুচি দেব,ওর প্রিয় বলে আজ বানিয়েছি লুচি আলুরদম।" নীল রাগত চোখে রিমার দিকে তাকিয়ে বলল,"তাই বুঝি আপনার মেয়ে আমায় বাড়ি আনতে চাইছিলোনা, যদি আমি লুচিতে ভাগ বসাই"। রিমা কি বলবে বুঝতেই পারছিলনা,ও তো কোনোদিন এই নীল কে দেখেনি।নিশার মুখে শুনেছিল,কিন্তু হঠাৎ তার প্রতি এরকম ব্যবহারের কারণ সে ভেবে পাচ্ছিলনা। একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললো,"বসুন।আমি চেঞ্জ করে আসছি।

রিমা ফিরে এসে দেখলো নীল পরম তৃপ্তি ভরে মায়ের হাতের লুচি তরকারি খাচ্ছে।রিমাকেও খেতে দিয়ে ওর মা চা করতে লাগলেন।হটাৎ নীল বললো,"মাসিমা একটা প্রস্তাব নিয়ে আর অনেক আশা নিয়ে এসেছি আমি।যদিও এখানে আসবো সকালেও জানতামনা।কিন্তু এসেই যখন পড়েছি প্রস্তাবটা দিয়েই ফেলি।" রিমার মা শুধু না রিমাও খাওয়া বন্ধ করে তাকালো নীলের দিকে।নীল মুখটা মাটির দিকে করে,নিঃস্বাস প্রায় বন্ধ করে বললো,"আমি... মানে আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।আমি যা উপায় করি,আপনার মেয়েকে খারাপ রাখবনা এটুকু বলতে পারি।আর আমার বৌদি আমাদের বাড়িতে যে সম্মান,ভালোবাসা পায় রিম তার চেয়ে কম কিছু পাবেনা।রিম কে কিছুই বলিনি,সোজাসুজি আপনার কাছেই এলাম।"কথা গুলো বলে রিমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল রিমার সুন্দর শান্ত চোখদুটো যেন তেজ আর রাগের আগুনে জ্বলছে।যে চোখে সে নিজের জন্যেও ভালোবাসা না হোক ভালোলাগা দেখেছিল,সেখানে আজ শুধুই অপমানের আগুন।নীল কিছু বোঝার আগেই আর রিমার মা সরমা দেবী কিছু বলার আগেই রিমা বিছানায় বসে থাকা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,"মিস্টার চৌধুরী,আপনি যদি চান আমি তিতলি কে পড়াবোনা।কিন্তু এভাবে আমাদের অপমান করার কারণ কি? আপনি বোঝেন নিশ্চই নিশা শুনলে আমাদের বন্ধুত্বটাও হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে? তাছাড়া যে আপনি কাল অবধি আমার সাথে ভালো করে কথা বলতেন না,আজ তার মুখে এসব কথার কোনো মানেই তো আমি বুঝতে পারছিনা।”সরমা দেবী নিজেও একটু থমকে গেছিলেন, ভাবছিলেন নিশার ছোড়দার সম্পর্কে রিমার বলা কথা ঠিক না আজকের ঘটনা।যাইহোক ঐ মুহূর্তে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়াই তার শ্রেয় মনে হল।তার মেয়ের ওপর তার বিশ্বাস অপরিসীম ছিল,তাই ভরসা ছিল তার সিদ্ধান্তের ওপরেও।সরমা দেবী ঘর থেকে তাই নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন। নীল এবার রিমার দিকে ফিরল,"ভালোলাগা বোঝ?আমিও প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ার মত বোকা বোকা ধারনায় বিশ্বাসী নই, কিন্তু যে ছেলেটা মেয়েদের থেকে দূরে দূরে থাকতো,প্রেমের মতো বোকা ব্যাপারে কোনোদিন ভাবেনি সে তোমাকে প্রথমদিন দেখেই মনে অস্বস্তি ফিল করেছিল কেন বলতে পারো?কেন সে সপ্তাহে 4দিন সন্ধ্যেবেলা তোমার বাসের পিছন পিছন গাড়ি নিয়ে আসত বাড়ি ঠিকঠাক পৌঁছেছো কিনা দেখতে!কেন রবিবার তিতলির ঘরের কাছাকাছি ঘুরতো গলাটা শুনবে বলে!কেন সে কাল মাঝরাত থেকে জেগে বসে আছে এই ভেবে এত বৃষ্টিতে তার রিম কাল আসতে যদি না পারে এই চিন্তায়।"একটু দম নিয়ে আবার নীল বললো,"আজ অত বৃষ্টির মধ্যে তোমার একা ফেরার চাপ আমি নিতে পারতামনা বলে এগিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই তোমায় লিফট দিয়েছিলাম।কিন্তু গাড়িতে তোমার এক হাতের মধ্যে বসে তোমার সাথে কথা বলে আমি আমার এতদিনের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি।বাড়িতে আমার বিয়ের জন্যে সবাই উপযুক্ত মেয়ের খোঁজ করছে,তাই আর দেরি করলামনা।তবে তোমার যদি আপত্তি থাকে তাহলে কিছু বলার থাকেনা"।রিমা যেন নিজেকে এতক্ষন গুচ্ছছিলো মনে মনে।শান্ত আর প্রাকটিক্যাল মেয়েটা ঠিকই করে নিয়েছিল কি বলবে,কারণ ও আজ সকালেই নীলের মায়ের কাছে শুনেছিল নীলের জন্যে কেমন মেয়ে ওরা খুঁজছে,যার সাথে রিমার কোনো মিল নেই। "আমার আপত্তি থাকবেনা আপনি ভাবলেনই বা কেন?আমরা গরিব বলে আর আমার বাবা নেই বলে?আপনি তো আমায় জিজ্ঞেস করার দরকারই মনে করেন নি।কিন্তু আমি দুঃখিত আমি এই প্রস্তাবে রাজি হতে পারলামনা বলে।আপনি আসতে পারেন।" নীল ভাবেনি রিমা এভাবে ব্যবহার করবে,প্রেম হয়তো কোনোদিন করেনি কিন্তু রিমার চোখে ও বারবার ওর জন্যে অন্য কিছু একটা দেখেছিল।রিমার প্রতি ওর ভালোলাগা এতটাই তীব্র ছিল যে ওদের আর্থিক অবস্থার পার্থক্য নিয়ে কোনোদিন ভেবেও দেখেনি।আর তাছাড়া ওর বড় বৌদিও মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে তাই ওর বাড়ির লোক,মা বাবা এদের মত নিয়েও বিশেষ ভাবেনি।রিমার কথায় ওর মন যে কতটা কষ্ট পেলে সেটা হয়তো রিমাও বুঝলো।আর একটাও কথা না শুধু ব্যথা মাখা চোখে একবার রিমার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ও বেরিয়ে গেল।নীলের গাড়ির স্টার্ট পাওয়ার আওয়াজ পেতেই রিমা ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো।আজ নীলের চোখ বলে দিয়েছে নীলের ভালোলাগা ভালোবাসা কতটা ।কিন্তু রিমা জানে নীলের বাড়িতে এই সম্পর্ক কোনোদিন মানবেনা।তাতে হয়তো নীলকে পরিবার ছাড়া হতে হবে, নীল যা একগুঁয়ে।রিমা কে নীলের মা বলেছেন,ওনার একমাত্র চাহিদা নীলের বউ যেন খুব সুন্দরী হয়,আর বড় বউ ভালো হলেও ছেলের পছন্দ করা তাই ছোটছেলের বউ কে উনি নিজে পছন্দ করে আনবেন।সরমা দেবী আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে রিমার মাথায় হাত রাখলেন।মেয়েকে উনি ভরসা করতেন,জানতেন তার ঠান্ডা মাথায় অল্প বয়সে পরিণত মেয়ে ঠিক সিদ্ধান্তই নেবে,কিন্তু নীলকে ওনার খুব পছন্দ হয়েছিল,অন্য কারণে না ছেলেটার চোখদুটো বড়ো মায়ামাখা।রিমা মা কে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে,মা বুঝলেন মেয়ের চোখে হয়তো জল এলোনা কিন্তু বুকটা ভাঙছে,কারণ মেয়ের ডাইরি একদিন উনি পড়ে ফেলেছিলেন,যেখানে শুধুই ছিল মায়াভরা চোখের এক রাজপুত্রের কথা,যাকে রিমা ছুঁতে না পারার কষ্টটাই লিখেছিল।


চতুর্থ পর্ব:


গঙ্গার ধারে একটা বেঞ্চে চুপ করে প্রায় ঘন্টা তিনেক বসে আছে নীল।বৃষ্টি আসছে,ভেজাচ্ছে,আবার আসছে ,আবার ভেজাচ্ছে তাকে।বাইরের কঠিন আবরণে মোড়া ছেলেটা যে এখন ছোট ছেলের মতোই অভিমানী।রিমার সাথে একা একা কত কথা বলেছে এতদিন,তাই বড়ই নিজের সে ওর জন্যে।তাই অভিমান এত তীব্র।হ্যাঁ এটা শুধুই অভিমান,অহংকারের রেশ বা 'না' শোনার অপমান নয়,কারণ রিমা নীলের কাছে কতটা আপন সেটা শুধু নীলই জানে।নীল শুধু ভাবছে কি কারণে রিমা তাকে অযোগ্য ভাবলো,নাকি এতদিন ধরা পরার ভয়ে নীলের ওকে এড়িয়ে যাওয়াটা ওর খারাপ লেগেছে,সম্মানে লেগেছে,তাই আজ এমন করলো তার রিম।কিন্তু সেতো তার দুর্বলতা প্রকাশ হওয়ার ভয়ে সামনা সামনি দেখা হলে চোখ নামিয়ে নিত, কারণ সবাই যে বলে মেয়েরা ছেলেদের চোখ পড়তে পারে!তাই তো নিজের কাছে কিছুটা সময় নেয়ার জন্যে ও রিম কে এড়িয়ে যেত।দূর থেকে দেখতো,কাজ পাগল নীল চৌধুরী অফিসের শত কাজের মধ্যেও রাত ৮টাই পৌঁছে যেত বাস স্ট্যান্ডে তার রিম যাতে কোনো বিপদে না পড়ে তাই অনুসরণ করত।নীল আসার আগেও রিমা রাতে একা বাড়ি ফিরেছে,কিন্তু রিমার প্রতি দুর্বলতায় সেসব যুক্তি মানতে পারতোনা।নীল বুঝতে চেয়েছিল রিমার মন,সেও নীল কে পছন্দ করে কিনা।তিতলি কোনোসময় তার ছোটকার গল্প করলে যে রিমা মন দিয়ে শুনতো নীল দেখেছিল,তাও শিওর হতে পারছিলনা।কিন্তু আজ তার বাড়িতে তার হবু জীবন সঙ্গিনীর কেমন হবে শুনতে শুনতে যখন রিমার মুখ ছোট হয়ে যাচ্ছিল,আর চোখ উদাস হয়ে যাচ্ছিল নীল তখন অনেকটাই বুঝে যায়।তারপর গাড়িতে ওতো কাছে বসে হয়তো মনটা বুঝতে পারে রিমার মনের কথাও।কিন্তু নীল ভাবেনি রিমা এভাবে তাকে ফিরিয়ে দেবে।কিন্তু কারণটা.....না আর ভাবতে পারছেনা।অনেকক্ষণ থেকে শীত শীত করছে,বৃষ্টির জল মাথায় পড়া যার বারণ এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা বৃষ্টিতে বসে থাকা তার কাছে প্রায় আত্মহত্যার সমান সেটা নীল বুঝেও কেন বসে আছে ও জানেনা।ছোট থেকেই ও এরকম।কারোর ওপর,বিশেষ করে মার ওপর অভিমান হলে নিজেকে কষ্ট দেয়,কিন্তু এত প্রাকটিক্যাল ছেলে আজ যেটা করছে তা যে কত বড় ভুল...বিশেষ করে যে তাকে ভালো করে জানেনা তার জন্যে,যেন ছায়া যুদ্ধ করতে নেমেছে সে।

না আর বসে থাকা যাচ্ছেনা,শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।আসলে প্রাকটিক্যাল ছেলেটা হয়তো ভেবেছিল এভাবেই তার প্রিয় মানুষটাকে বোঝাতে পারবে নিজের ভালোবাসা,বাড়ির লোককে বলতে পারবে জীবনে প্রথম ভালোবাসা ব্যর্থ হতে দিতে সে পারবেনা।নীল হয়তো চাপা স্বভাবের ছেলে বলেই নিজের বিপদ ডেকে এনে সব সহজ করার চেষ্টা করছিল,কিন্তু জানতোনা নিজের কত বড় ক্ষতি করতে চলেছে।খুব মন চাইছে রিম এর গলাটা শুনতে,ফোন নম্বরও আছে।প্রায় রাতেই তো শোনে নিজের এক অচেনা নম্বর থেকে।আজ নিজের পরিচিত নম্বর থেকেই রিমার নম্বর টিপল।শুধু গলাটা শুনলো,নীলের গলা চিৎকার করে বলতে চাইলো,'ভালোবাসি,ভালোবাসি।তোমায় বড্ড ভালোবাসি।বাঁচতে পারবোনা তোমায় ছাড়া।'...কিন্তু অভিমানী মন গলা শুনে ফোনটা কেটে দিলো।অনেক কষ্টে ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরল যখন বিকেল শেষ হয়ে এসেছে।ড্রয়িং রুমে কেউ নেই।শরীরটা সোফা অবধি টেনে এনে ওখানে বসেই অতিরিক্ত জ্বরের ঘোরে জ্ঞান হারালো নীল।

         নিশার কদিন ধরেই একটা সন্দেহ হচ্ছিল।মেয়েদের থেকে শত হস্ত দূরে থাকা তার ছোড়দা একটা মেয়ের ব্যাপারে আজকাল অল্প বিস্তর খোঁজ রাখছে।সেদিন উনিভার্সিটি গেটে দাঁড়িয়ে দূরে ছোড়দার গাড়িটাও দেখেছিল,কিন্তু নিশা কে কিছু বলেনি বলে ও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু আজ রিমা দুপুরবেলা ফোন করে ইনডিরেক্ট ছোড়দা বাড়ি আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে সন্দেহটা অনেকটাই বিশ্বাসে পরিণতি পাচ্ছিল।তবে কি রিমা ও ওকে লুকোচ্ছে,ওর দাদা বলে।ঠিক বুঝতে পারছেনা।রিমা কে বোঝার জন্য আগে ছোড়দার গল্প করে দেখেছে চুপ করে শোনে,যদিও নিজে যেচে কিছু জিজ্ঞেস করেনা।রিমা ওরকমই,নিজের গন্ডির বাইরে কখনো বেরোবে না।কিন্তু ছোড়দা রিমা কে দেখলেই তো এড়িয়ে যায়,এটা রিমার খারাপ লাগে নিশা বোঝে।কে জানে ওর ছোট দাদা টাকে বোঝা ভূতের বাবারও অসাধ্য।কোথায় যে গেছে সকাল থেকে,সন্ধ্যে হতে চললো।এসব ভাবতে ভাবতে হটাৎ মনে হলো নীচে ড্রইং রুমে কিসের যেন চেঁচামেচি হচ্ছে।কৌতূহলী হয়ে নেমে এসে দেখে পা কেঁপে গেল,একি অবস্থা ছোড়দার।সম্পূর্ণ জ্ঞান হারিয়েছে।কি হয়েছে?! বাবা ডক্টর সেন কে ফোন করছিলেন,দাদাভাই আর বৌমনি মিলে ছোড়দার ঘরে নিয়ে গেল,ওকে চেঞ্জ করতে হবে,জামাকাপড় ভিজে আছে।মা কাঁদছে কেন? কিন্তু কিন্তু....ছোড়দা ভিজেছে!!!!!! যার মাথায় বৃষ্টির জল অবধি পড়া বারণ,যে সারাবছর ঠান্ডা গরম মেশানো জলে চান করে,এসি ব্যবহার করে 29ডিগ্রিতে তাও খুব দরকারে,শীতকালে মা তো পারলে ওকে তুলোয় মুড়ে রাখে তাহলে?!!!ও ভিজলো কেন?

"ও বৌমনি কি হয়েছে ছোড়দার?ওর জামা ভিজে কেন?কখন ফিরেছে ও?" নিশার প্রশ্নের উত্তরে মিতা যা বললো নিশার হার্টবিট যেন বেড়ে গেলো।"জানিনা আমি তিতলীকে নিয়ে নাচের স্কুল থেকে ফিরে দেখি নীল সোফাতে শুয়ে,কাছে গিয়ে দেখি জ্ঞান নেই প্রায়,গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে,জামা কাপড় ভিজে।আমি ভয় পেয়ে তোমার দাদা কে ডাকি,মা বাবাও নেমে আসেন। কিছুই বুঝতে পারছিনা। দারোয়ান বললো আধ ঘন্টা হলো নীল ফিরেছে।গীতা মাসিও ভেবেছিল নীল সোফায় শুয়ে আছে।"বলে বৌমনি আর নিশা ছুটলো নীলের ঘরে।

    ১০মিনিটের মধ্যে ফ্যামিলি ফিসিসিয়ান ডক্টর সেন চলে এলেন।উনি দেখে ওষুধ ইনজেকশন দিলেন,কিন্তু দু ঘন্টা অপেক্ষা করেও জ্বর সামান্য কমলেও জ্ঞান এলোনা,উল্টে হাত পা নীল হতে শুরু করলো। উনি হসপিটালে এডমিট করার পরামর্শ দিলেন। রাত ১০টায় শহরের নামি প্রাইভেট হসপিটালে নীল কে ভর্তি করতে হলো।শ্বাস কষ্ট শুরু হওয়ায় ওখানে আই.সি.ইউ তেই এডমিট করলো।

একটা এত প্রাকটিক্যাল ছেলে কী করে এরকম ছেলে মানুষী করতে পারে কেউ ভেবে পেলোনা।নীলের মা খুবই ঠান্ডামাথা, কিন্তু সবচেয়ে প্রিয় সন্তানের শোকে তিনি যেন পাথর হয়ে গেলেন।তার ওপর ডক্টর বললো,নীল ঘোরের মধ্যে ভুল বকছে,কারোর ছেড়ে যাওয়ার কথা বলছে,তবে কি মা হয়ে তিনি ছেলের মনের খবর কিছু পাননি? মানসিক কষ্ট কিসে পেলো তার অভিমানী ছেলেটা? ছোট থেকেই ছেলেটার বাইরেটা কঠিন,চাপা স্বভাবের নীলের মনটা শিশুর মতো।কে তাতে আঘাত দিলো এতটা যে নীল কারোর কথা না ভেবে নিজের এত বড় ক্ষতি করে বসলো!এসব ভাবনায় কখন হসপিটাল করিডোরে ভোরের হালকা আলো এসে পড়ল কেউ খেয়ালই করলো না।


পঞ্চম পর্ব:-


সারারাত এপাশ ওপাশ করেই ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল রিমার,ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে দেখে সকাল ৭.১৫বাজে। ফোনে নাম দেখে একটু আড়ষ্ট হয়েই ফোনটা ধরলো।জানেনা,নীল কাল বাড়ি ফিরে কিছু বলেছে কিনা।তাছাড়া কাল দুপুরে অত বৃষ্টির মধ্যে খালি মনে হচ্ছিল নীল বাড়ি ফিরেছে তো ঠিক করে,সেই দুশ্চিন্তায় নিশা কে ফোন করে নীল কোথায় জিগেসও করে ফেলে।সকালেই ও বুঝেছিল নীল যে ওকে বাড়ি পৌঁছতে বেরিয়েছে কেউ জানেনা।রিমা ফোন ধরে 'বল' বলতেই নিশার কিছুটা জড়ানো গলা শুনতে পেল,

"রিমা,আজ আমি উনিভার্সিটি যেতে পারবোনা রে।স্পেশাল পেপারের ক্লাসে ম্যাম জিজ্ঞেস করলে বলিস আমার ছোড়দা কাল রাতে ICU তে ভর্তি হয়েছে।অবস্থা সিরিয়াস।"নিশা অনেক চিন্তা করে কিছুটা আন্দাজেই রিমাকে ফোন করেছে।৪৮ঘন্টা সময় দিয়েছেন ডক্টর টিম।শারীরিক লড়াইটা তখনই নীল জিতবে যদি মনটা সারে,কারণ ডাক্তারদের অনুমান মনের কষ্ট নীলকে শারীরিক ভাবে সুস্থ হতে বাধা দিচ্ছে।রিমার মনে হলো কেউ যেন কানে গরম সিসা ঢেলে দিল। অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করলো ,"কি হয়েছিল?" কান্নাভেজা গলায় নিশা যা বললো পুরোটা শুনে শুধু জিজ্ঞেস করলো,কোন হসপিটাল আর নিশা ওখানে আছে কিনা?"আমি আসছি" বলে ফোনটা কেটে দিলো।সরমা দেবী এতক্ষন মেয়ের পাশে বসে ছিলেন,ওর ভেঙে পরা মুখটা দেখে আর মেয়ের মুখে শুনে রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ,"শান্ত থাক মা।যদি তোর ভালোবাসার জোর থাকে আর ছেলেটাও সত্যি তোকে এতটা ভালোবেসে থাকে তাহলে ভগবান কোনো অনর্থ করতে পারেননা।"রিমা কোনো উত্তর না দিয়ে সব হারানো দৃষ্টিতে একবার মা কে দেখলো। যে মেয়েটা কাল অবধি জানতো তার স্বপ্নের প্রেম ডাইরির পাতাতেই সীমাবদ্ধ,আর সেই স্বপ্ন পুরুষ তাকে জীবনে গুরুত্বও দেয়না।কিন্তু হঠাৎ এক সুখ স্বপ্ন এসে তাকে জানান দিলো যে ভালোবাসা এক তরফা নয়,হয়তো অন্য দিকের ভালোবাসা তার থেকেও বহুগুণ বেশি....কিন্তু সময় অনুকূল থাকলনা... অনেকের অনেক কথা ভেবে....নীলের ভালোবাসা মোহ কিনা বুঝতে বুঝতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হলো,যেখানে মন বা হৃদয় না,বাস্তববাদী রিমা শুধুই মাথার কথা শুনেছিল,ভাবেনি নীল এরকম ছেলেমানুষি করতে পারে,আসলে ওদের পরিচয়ই বা কতটুকু যে ও নীলকে বুঝতে পারবে।কিন্তু এখন কেন বুকের মধ্যেটা ভেঙে যাচ্ছে, কেন হটাৎ বাবা কে হারিয়ে যে শুন্যতা গ্রাস করেছিল সেরকম মনে হচ্ছে।হসপিটালে গিয়ে ও কাকে কি বলবে,বা কিকরে নীলের কাছে পৌঁছবে জানেনা,কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছতে হবে।রিমা ১০মিনিটে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো।

            রিমা দেখলো নিশা আর রুদ্র হসপিটালের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।রিমাকে দেখে এগিয়ে এলো ওরা।রিমার বসে যাওয়া চোখ মুখ দেখে নিশা হয়তো বুঝলো ওর অনুমান ভুল না।রিমাকে বললো,"তুই আই. সি. ইউ. র ভেতরে যেতে চাস, আমরা ডাক্তারের সাথে কথা বলে রেখেছি?জানিনা আমি কিছুই কিন্তু তোকে তো গত দুবছর দেখছি,তাই মনেহল তুই হয়তো সেই একমাত্র মেয়ে,যাকে ছোড়দা সাধারণ অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা করেছিল।এখন তোকে দেখে মনে হচ্ছে আমি হয়তো ভুল ছিলামনা।" এতক্ষন নিজেকে ধরে রাখা রিমা আর পারলোনা,সব কিছু ভুলে নিশাকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।নিশা জানে রিমাও কতটা চাপা,কত কষ্ট হলে তবেই চোখে জল আসে।ওকে ধরে ভিতরে নিয়ে গেল সেখানে ওদের বড়দাও ছিল।নিজেকে কিছুটা সামলে রিমা বললো ও নীলের কাছে যেতে চায়।কিন্তু নীলের কাছে যাওয়া মানে যে মনের জোরে ও নীলকে ফিরিয়ে দিয়েছিল আর তা পুনরাবৃত্তি করতে পারবেনা,কারণ নীল না তখন রিমাও শেষ হয়ে যাবে।নিশা বললো,"কি হয়েছিল তোদের মধ্যে?"রিমা কিছুটা থেমে বললো,"কিছু হয়নি সেটাই হয়তো কারণ।আমি সবসময় ভেবেছি তোর ছোড়দা আমায় পছন্দ করেনা।আর সেটাই স্বাভাবিক।কোনোভাবেই আমি ওর উপযুক্ত তো নই।আর আমি জানতাম তোরা ওর উপযুক্ত মেয়ে খুঁজছিস।বিশেষ করে মাসিমার ইচ্ছা সুন্দরী উপযুক্ত বৌমার।তাই কাল ওর হটাৎ দেয়া প্রস্তাব আমার কাছে স্বপ্ন মনে হলেও ভেবেছিলাম সাময়িক ভালো লাগা,তাই যা সম্ভব না সেটাকে এগোতে দিতে চাইনি।নীল আমার মার কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব রাখবে এটা এই সাধারণ মেয়েটা কি করে ভাববে বলতো?!" রিমা জল ভরা চোখে নিশার দিকে তাকায়। নিশা স্মিত হেসে বলে,"কার কাছে কে অসাধারণ হয়,সেকি বোঝা সম্ভব!উনিভার্সিটির অংকের মেধাবী লড়াকু মনের পরিণত মেয়েটাকে যে আমার দাদার মতো ছেলের ভালো লাগবে সেটাই তো স্বাভাবিক।আর রূপের বিচার হয় কি দিয়ে?আমরা কোনোদিনই অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে কাউকে মাপিনা সেটা কি তুই আমার সাথে মিশেও বুঝিসনা?আমি তোকে দোষ তো দিচ্ছিনা,তুই যে খাঁটি হিরে সেটা দাদাকে ফিরিয়ে দিয়েই প্রমান করে দিয়েছিস।কিন্তু রিম ছোটদার মনের হদিস না পেয়েও তো তুই ওকেই ভালোবেসেছিস, নাহলে আমার কাছে ওর কথা তুই এত মন দিয়ে কেন শুনতিস?আমি হয়তো আমার দাদার ভালোলাগাটা বুঝতে পেরেছিলাম সেদিন যেদিন উনিভার্সিটির বাইরে ওর গাড়ি দেখেছিলাম,কিন্তু ও আমায় কিছু বলেনি।তোর পড়াতে আসার রবিবার গুলো ওর তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পরা।তোকে পাত্তা দিতে না চেয়েও তোর কথা জানতে চাওয়া,সব মিলিয়ে আমি বুঝেছিলাম।শুধু আমি না মাও।তাই মা তোর মন বুঝতে তোকে সুন্দরী বউয়ের গল্প করেছিল।কিন্তু আমরা অপেক্ষা করছিলাম ছোড়দার মুখের কথার জন্যে।পাগলটা সেই সুযোগটাও দিলোনা।" মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ফেললো নিশা।রুদ্র বললো,"কিছু হবেনা।এখনো অনেক সময় আছে।রিমা তুই চল,আমি ডাক্তারের থেকে পারমিশন নিয়ে রেখেছি।তুই এখন ওর একমাত্র ওষুধ।শুধু একবার নিজের মুখে বল নীলকে তোর পছন্দ তো?" রিমা কিছু না বলে একটা ডাইরি এগিয়ে দিল।রুদ্র একবার শুধু খুললো,যা বোঝার বুঝে বললো,"আয় আমার সাথে,আর এটা সাথে রাখ।যদি মিরাকেল ঘটাতে পারিস এই মুহূর্তে তাহলে নীলের হাতেই দিয়ে আসিস এটা,তাহলে হয়তো ঠান্ডা লাগার ওষুধ ছাড়া আর কিছু ওষুধই লাগবেনা ওর।"


অন্তিম পর্ব:-


আই. সি.ইউ. এর ঠান্ডা ঘরে তার স্বপ্নের রাজপুত্র কে ওরকম ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে রিমা কেঁপে উঠলো,চোখ ঝাপসা হয়ে গেল এমন যে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলনা।শুধু ওর জন্যে ওই আপাত গম্ভীর অহংকারের মুখোশ পরা ছেলেটা যে এরকম ছেলেমানুষি করতে পারে রিমা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।বাবা মারা যাওয়ার পর শুধুমাত্র মাথা দিয়ে সব সিদ্ধান্ত নেয়া,ঠান্ডা মাথায় মেয়েটা একছুটে নীলের কাছে গিয়ে ওর হাত টা জড়িয়ে ধরলো,কেউ বাধা দিলোনা কারণ এতক্ষনে সবাই বুঝে গেছে নীল চৌধুরীর আসল রোগের উৎস।আকুল ভাবে রিমা ডাকতে লাগলো নীলকে।প্রায় 12ঘন্টার বেশি পর নীলের চোখের নিচে নড়াচড়া দেখা গেল।যে নীল কারোর ডাকে,কোনো ওষুধে সারা দিচ্ছিলোনা সে যেন কিছুটা হলে সারা দিলো।নার্স শুধু বললেন,"কোনোভাবে বেশি উত্তেজিত করবেননা।আপনি পাশের চেয়ারে বসুন।"রিমা দুহাতের মধ্যে নীলের ডান হাতটা ধরে বসে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো,"নীল দেখো আমি এসেছি।চোখ খোল নীল।আমি জানতামনা সব ব্যাপারে সিরিয়াস ছেলেটা আসলে এত বোকা।এত সহজে হার মেনে নেয়।আমি তোমার রিম নীল।" রিমা আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।মনে হলো নীলের ঠোটটা কাঁপছে।আস্তে আস্তে ওর হাত পা স্বাভাবিক উষ্ণতায় ফিরতে লাগলো।কিছুক্ষন পর রিমা আস্তে আস্তে ওর ডাইরির পাতা গুলো পড়তে লাগলো......এক পশলা বৃষ্টি হয়ে মেঘ কেটে রোদ উঠলো বাইরে।

     প্রায় ৩টের সময় নীল আধ চোখ মেললো।এতক্ষন কেউ রিমাকে সরাতে পারেনি ওই চেয়ার থেকে।ঝাপসা চোখে নীল দেখলো এতক্ষন ও স্বপ্ন দেখেনি সত্যি ওই কঠিন মনের মেয়েটা ওর পাশে বসে।জল গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ থেকে।কিন্তু অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।রিমা আলতো হেসে ওর মাথায় হাত রেখে বললো,"ভালোলাগা কি বুঝিনি যতদিন না তোমায় দেখেছি।তাই তো তোমার আচরণে এত অভিমান হতো।অনেক কষ্ট দিয়েছো অকারণ।আর আমার দেয়া একটু কষ্ট নিতে পারলে না?" নীল মুখ ঘুরিয়ে কাঁপা হাত বাড়িয়ে রিমার গলাটা জড়িয়ে ধরলো।

   বাইরে অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলো কে গিয়ে ডক্টর বললেন , "বিপদ কেটে গেছে।কিন্তু বিয়ের নিমন্ত্রণ থেকে যেন বাদ না পরি।"

 শুরু হল আর একটা গল্পের......




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance