শুভ অপরাহ্ন..❤️
শুভ অপরাহ্ন..❤️
- কি রে ঘুম হলো ওঠ এবার!আর কত ঘুমাবি ?
ফোনের এপার থেকে মৃদুকণ্ঠে বলে উঠলো স্নেহলতা।তখন সবেমাত্র ভোর পাঁচটা।ফোনটা রিসিভ করে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে অনুরাগ বলে ওঠে,
- এই তো পাঁচটা এখন উঠে কি করব?
- কেন আমাকে পরামর্শ দিবি আজ কি পরে যাব!
- বাবাহ পরামর্শ! তাও আবার ফুলন দেবীকে! হয়ে গেলো।শেষে গুলির শব্দে খুলি উড়ে যাবে আমার।
- এই খবরদার বলছি আমাকে ফুলন দেবী বলবি না!আমি কিন্তু অত রাগিও নই।
- আচ্ছা আচ্ছা রাগ করছিস কেন!এই শোন না....
এবার আর ফোনের ওপারে কোনো শব্দ নেই।অনুরাগ আবার বলে উঠল,
- কি রে কি হলো?রাগ করলি নাকি?
- না বল,কি বলবি বলছিলি!
- হ্যাঁ বলি।আজ ওই লাল - হলুদ কুর্তি টা পরবি রে?যেটা তোকে আগের জন্মদিনে দিয়েছিলাম।আর সাথে চোখে ঘন কাজলের মায়াবী আস্তরণ,কপালে একটা ছোট্ট লাল টিপ।
- বাবাহ ছেলের এই ভোরবেলায় প্রেম করার ইচ্ছে জেগেছে নাকি! আচ্ছা বেশ তাই পরে আসব।আর তুই কি পরবি?
- বল কি পরে আসব?
- তুই ওই নিল রঙের চেক শার্টটা,আর বাদামি রঙের জিন্স টা পরে আসিস।ওটায় কিন্তু তোকে খুব সুন্দর লাগে।
- যথা আজ্ঞা মহারানী। হুকুম কি তামিল হোগা..!!
- আচ্ছা শোন না এবার রাখছি।মা এখনি অ্যালার্ম শুনে ওঠাতে এসে যদি দেখে জেগে গেছি তাহলে সন্দেহ করবে।
- আচ্ছা বেশ।কিন্তু সময়ে আসিস।আবার আয়নার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত করে দিস না যেন!
- আবার!
- আচ্ছা বাবা রাখি এবার ।টাটা.
এই প্রসঙ্গে গল্পের প্রধান দুটি চরিত্রের সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক।অনুরাগ চ্যাটার্জী,প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যায় স্নাতক স্তরে ভর্তি হয়েছে।অন্যদিকে স্নেহলতা সেনগুপ্ত , সেও একই স্থানে বাংলা বিভাগে স্নাতক স্তরে প্রবেশ করেছে।এই যে দুজনের কথা বললাম এরা পারিবারিক সূত্রে ছোটবেলা থেকেই একে অপরের বন্ধু,সুখ দুঃখের ভাগীদার।পড়াশোনা ছোটো থেকেই এক স্কুলে।কিন্তু এই অভিন্ন হৃদয় বন্ধুত্ব যে কখন ভালোবাসার বেড়াজাল অতিক্রম করে গিয়েছিল তার হদিস কেউই পায় নি।মাধ্যমিক শেষ করে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হবার পরই তারা দুজন সম্পর্কটাকে নতুন নামকরণ করে।বন্ধুত্ব থেকে সেটাকে জীবন পথের সঙ্গী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মনস্থির করে।তারপর যা হয় আর কি! বন্ধুত্ব যতদিন আছে কোনো গোলমাল নেই।কিন্তু একবার তা প্রেমের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হলেই শুরু হবে গোলমাল ,ঝামেলা,অভিমান।ওদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।অনুরাগ বরাবরই একটু বদমেজাজি।তবে স্নেহলতা কে সে খুবই ভালোবাসে।আবার স্নেহা ও রাগি অবশ্যই।কিন্তু অনুরাগের রাগের সামনে কিছু বলার সাধ্য তার নেই।
- ধুর কি যে করে না এই মেয়েটা।বারবার বললাম জলদি আসিস।কে কার কথা শোনে।
- নে চল চল,আমি এসে গেছি।
- কি এসে গেছি!এসে আমায় উদ্ধার করেছিস।১০ টা বাজলো তারপর তোর আসার সময় হল।কলেজের প্রথম দিনেও ঠিক সময়ে ঢুকতে পারবি না।সত্যি কিছু বলার নেই।
কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে গেল স্নেহা।আজ আসলে সে একটু ভালো ভাবে নিজেকে সাজিয়ে এসেছিল,ভেবেছিল অনুরাগ দেখে আর চোখ ফেরাতে পারবে না।কিন্তু নাহ এরকম ভাবে তাকে কড়া সুরে ধমক পেতে হবে এমনটা সে কল্পনা করে নি।চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল জমে এলো তার।
- নে আবার হা করে দেখছিস কি!উঠে বস বাইকে।আরো দেরি করবি নাকি!
উঠে বসল স্নেহা।কিন্তু তার মন একদম ভালো নেই।অনুরাগ ও পুরো রাস্তায় একটা কথাও বলে নি।কুড়ি মিনিট পরে কলেজে পৌঁছেই বাইক থেকে নেমে দৌড়ে চলে গেল স্নেহা আর্টস বিল্ডিং এর দিকে।অনুরাগ বাইকটা পার্কিং করতে করতে শুধু নীরবে সেদিকে চেয়ে রইল।তারপর সেও সাইন্স বিল্ডিং এ ঢুকে গেল।ক্লাসে বসে আছে ঠিকই,কিন্তু অনুরাগের পড়াতে সেরকম মন নেই একটুও।শুধু ভেবে চলেছে স্নেহার কথা,
- নাহ ওকে এভাবে না বকলেই ভালো হতো।
নিজের মনেই বলে উঠল অনুরাগ।সাথে সাথে চোখের সামনে স্নেহার সকালের সেই পরিপাটি করা রূপটা দৃশ্যমান হয়ে উঠল।ঠিক যেমন ভাবে সে তাকে দেখতে চেয়েছিল স্নেহা ঠিক তেমন ভাবেই এসেছে তার কাছে। কিন্তু তখন রাগ এতটাই বেশি প্রাধান্য পায় যে অন্য কোন দিকে তার লক্ষ্য ছিল না। কোন রকমে ক্লাস টা শেষ করে বেরিয়ে এল অনুরাগ।আজ প্রথম দিন হওয়াতে একটু জলদি ছুটি হয়ে গেল।স্নেহা কে ওদিক থেকে আসতে দেখে কাছে গেল অনুরাগ।
- কি রে ক্লাস কেমন হল?
কিন্তু স্নেহা কোনো উত্তর দিল না।অনুরাগ আবার বলল,
- কি রে কি হল বল কিছু?
- হ্যাঁ হ্যাঁ হল মোটামুটি ...
কোনো রকমে কথাটা বলল সে।অনুরাগ লক্ষ্য করেছে স্নেহার এই ঔদাসীন্য।এবং কারণটাও সে জানে।
- আচ্ছা চল আজ প্রিন্সেপ ঘাট যাবি?ওখানে একটু বসা যাবে ?
- হম চল তবে।
যথারীতি তারা প্রিন্সেপ ঘাট এসে পৌঁছল।একটা নিরিবিলি গাছের নিচে বসল দুজনে।প্রায় কুড়ি মিনিটের ও বেশি সময় তারা নিশ্চুপ।কোনো কথা নেই।অনুরাগ ই তারপর প্রথম কথাটা বলল,
- কি রে রাগ করেছিস?
- না তো ,কেন রাগ করব।কিছু হয় নি রে।
কথাটা কিছুটা বেসুরো ভাবেই বলল স্নেহা।
- বল না রাগ করেছিস কি ?
এবার কিছুটা কড়া ভাবেই স্নেহা বলে উঠল,
- যদি করেও থাকি তাতে তোর কি কিছু হবে?
- বাবাহ হবে না বলছিস!
- না হবে না,
এবার তার গলা রীতিমতো ধরে এসেছে,অনুরাগ বুঝতে পারছে এবার হয়ত স্নেহা কেঁদেই ফেলবে।আর হলোও তাই।কাঁদতে কাঁদতেই বলে ফেলল,
- আজ আমি শুধু তোর জন্য এরকম ভাবে সেজে এসেছিলাম,কিন্তু তুই সেটা দেখলি না,শুধু একটু দেরি হয়েছে তাই নিয়ে বলেই গেলি।
- আচ্ছা আচ্ছা চুপ চুপ...
স্নেহা কে থামাতে চেষ্টা করে অনুরাগ।চোখ বেয়ে নেমে আসা অশ্রুধারা মুছিয়ে বলতে শুরু করে,
- তোকে বকেছিলুম বলেই একটা ক্লাসেও মন দিতে পারি নি।শুধু তোর কথাই ভেবেছি।আর তোর আজকের এই রূপসজ্জা,সে আমার চোখে এখনো লেগে আছে রে। তোর এই কুর্তি,তোর চোখের কাজল,কপালের লাল টিপ, আলতায় রাঙা চরণ,সব সব আমার মনে গেঁথে আছে।শুধু তখন এতটাই রাগ হয়েছিল যে কিছুই আর বলতে পারি নি।
আবার কেঁদে ফেলল স্নেহা।বলল,
- তুই যদি একবার আমাকে বলে দিতিস যে আমি তোর মনের মত ভাবে সেজে এসেছি তাহলেও আমার এতটা কষ্ট হতো না।
- আচ্ছা আর কাঁদিস না।
একটু চুপ থেকে অনুরাগ আবার বলল,
- সত্যি তোকে আজ মহারানীর রূপে সুসজ্জিত লাগছে রে।আর এই অপরাহ্নের সূর্যাস্তের প্রাক্কালে তুই যেন আরো আরো সুন্দরী হয়ে উঠেছিস।
কান্না থেমে গেল স্নেহার।মুখে হাসির ঝলক ফুটে উঠল তার।ঠোঁটের কম্পনে বলে উঠল,
- সত্যি বলছিস? তোর সত্যি ভালো লেগেছে?
- হ্যাঁ মহারানী।সত্যি।
বিকেলের গঙ্গার ধারে দুজনে আরো কিছুটা নিকটে এসে বসল। অনুরাগের কাঁধে মাথা রাখল স্নেহলতা।তার ললাটে আলতো করে প্রেমের চুম্বন এঁকে দিয়ে অনুরাগ মৃদু স্বরে বলে উঠল," শুভ অপরাহ্ন "

