Sonamani Khanra

Inspirational Others

3  

Sonamani Khanra

Inspirational Others

শরতের উমা

শরতের উমা

5 mins
230



'বাজলো তোমার আলোর বেনু'

উমা রে এবার আয় মা ব্রেকফাস্ট করে নিবি, সারা সকাল গান শুনেই কি পেট ভরাবি , আয় মা আয়।

মা সুনন্দা দেবী মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরার পথে একগোছা কাশফুল তুলে এনেছে। ডাইনিং এ রাখা কালো রঙের ফুলদানি'টার শোভা বেড়েছে চর্তুগুন। মেয়েকে সারপ্রাইজ দিতে চাইছেন। তিনি জানেন মেয়ে বড্ড খুশি হবে।


 টিফিনে রয়েছে লুচি আলুর দম। সকাল সকাল লুচি, উমা খুব একটা পছন্দ করে না। কারন সে যে আজকালকার মেয়ে, চেহারার সৌন্দর্যের প্রতি একটু বেশি যত্নশীলা। তবু সবার কথা ভেবে মানা করল না। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন। উপলক্ষ্য - ঠাম্মীর জন্মদিন। বয়স্ক মানুষকে কতখানি গুরুত্ব দিতে হয় , তা উমা ও সুনন্দা দেবীর কাছে শেখা উচিত। 


সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে, উমা'র ইচ্ছের মান রেখে সবাই বেরিয়ে পড়ল- বাইপাস সড়কের ধার ঘেঁষে শরতের মেঘ ছুঁতে। সে যে কি অপরূপ দৃশ্য তা চোখে না দেখলে অনুমান করা যায় না!

যেন নীলাভ সমুদ্র'টার ওপর সাদা সাদা ফেনা সক্ষতা মেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক কয়েক মুহূর্ত পরেই রূপ রঙ কতখানি বদল ঘটল! সূর্য যে পশ্চিম দিগন্তে, তার দুরন্ত আভা পুরো আকাশ'টাতে ছড়িয়ে দিয়েছে। যেন সারাদিনের সকল অভিমানী রঙ আকাশের বুকটাকে রক্তাত্ব করে দিয়েছে। আর সহস্র কাশফুল মাথা নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে সেদিনের তরে। আবার'ও শিশিরস্নাত হয়ে অপেক্ষায় থাকবে নতুন ভোরের। হেলে-দুলে খেলা করবে প্রভাতী কিরণের সাথে। 

উমা বেশ কিছু ছবি তুলে নিল। ফেসবুকে বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করতে হবে কিনা। সত্যি কথা বলতে এমন শোভা দেখার ভাগ্য সবার তো আর হয় না। তবু ফেসবুকের হাত ধরে কত শত নতুন কিছু আমরা দেখতে পাই।


নতুন নতুন ভাবনায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে উমা বড়ই মনোগ্রাহী। ইংরেজি সাহিত্যের ওপর বি.এ , এম.এ । বি.এড ও কমপ্লিট। এখন চাকরির অপেক্ষায়। তবে অযথা সময় নষ্ট করতে নারাজ; তাই সেলাইয়ের কাজ , পোশাকে নানান ডিজাইনের ভেলায় ভরিয়ে তুলছে হৃদয় দিয়ে। এছাড়া কবিতা লেখা ,বই পড়তে সমান আগ্রহী।

ব্যানার্জী বাড়ীর একমাত্র মেয়ে উমা। উমা তার ডাকনাম । খাতা কলমে সবার কাছে বৃহস্মিতা। নাম রেখেছেন ঠাম্মী। বাবা মা ঠাম্মীকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। বাবা রেলওয়েতে কর্মরত। মা গৃহবধু। তবে তখনকার দিনে বি.এ পাশ দিয়েছে। 


শরত পেরিয়ে শীত বিকেলে হঠাৎ একদিন দুরসম্পর্কের এক কাকু এসে হাজির। চা টিফিন শেষে আসল কথায় আসতেই জানা গেল - উমার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে। বিয়ের কথা শুনে রুক্ষ শুষ্ক কলেবরে অনাবিল হাসিটা ফিকে হয়ে গেলো। তবু বয়স যে বাড়ছে , সবদিক ভেবে রাজি হল।ছেলে বিক্রমপুর কলেজের প্রফেসর । 

উমা যে রূপে লক্ষী গুনে সরস্বতী - তা চিল্কাগড় গ্রামে কারো অজানা নয়। সকাল থেকে মা বারে বারে বলছে- ভালো একটা সম্বন্ধ এসেছে, আজ একটু সেজে গুজে ওদের সামনে বেরোস মা। হলুদ রঙের কাঞ্জিভরম তোর জন্য গুছিয়ে রেখেছি। আজ ওটাই পরিস। নতুন , আবার বিশেষ লোকজন আসবে কিনা- সারাবাড়ির রূপ বদলে দিয়েছেন সুনন্দা দেবী। বসার ঘরে পর্দা , শোফার কভার পরিবর্তন হয়েছে। ডাইনিং টেবিলের ফুলদানিতে ফুল। নিত্য নতুন স্টাইলের জলের বোতল , দামী কাঁচের গ্লাস। দরজার মুখে পাপোশ'টা পর্যন্ত। চাকচিক্যে অভিনবত্ব ভরপুর। বিকেল চারটে নাগাদ পাত্রপক্ষ উমাকে দেখতে এলো । উমার পরনে হলুদ কাঞ্জিভরম, মিষ্টি লাল রঙের কাশ্মীরি শাল, আর তাঁর চেহারার স্বর্নালী আভা - সবটা মিলিয়ে 'অপরূপা' অলংকার'টি লজ্জিত প্রায়! পাত্রপক্ষের মেয়ে পছন্দ না হওয়ায় কোন কারণ ছিল না। উমার পরিবারকে ডেকে পাঠালেন। 


সেদিন টা ছিলো রবিবার। সুকুমার বাবু (উমার বাবা) ছুটি নিয়েছেন। মা স্ত্রীকে নিয়ে ছেলের বাড়ির গেলেন ফাইনাল কথা সেরে আসতে। সন্ধ্যা আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরে এলেন ঠিকই, কিন্তু মুখগুলীতে যেন ঘোর অমাবস্যা নেমে এসেছে। উমার মনে সহস্র প্রশ্ন ঝাঁক বেঁধে এলেও বিবেকে বাঁধছে। প্রায় ঘন্টা খানেক পর ঠাম্মীর কাছে শোনা গেল- "ছেলের বাড়িতে পাঁচ লাখ টাকা নগদ, দশ ভরি গহনা , আর অবাঞ্ছিত আবদার - মেয়ের চাকরি করা চলবে না"। 


পরিবারে সবার মতো উমার ও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কিন্তু সুকুমার বাবু মেয়ের সুখের কথা ভেবে রাজি হয়ে কথা দিয়ে এসেছেন। 

সারা রাত ধরে পূর্নিমার চাঁদের আলোয় নিজের শৈশব , নিজেকে নিজের হৃদয়ের মতো গড়ে তোলার দিনগুলো, পরিবারের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে চোখের সামনে এসে ধরা দিল। যা চাঁদের আলোয় আরো একটু স্নিগ্ধ স্নাত রূপে উদ্বেলিত।


সকাল আটটা নাগাদ রায় বাড়িতে ফোন গেল । ফোনের এই প্রান্তে উমা, আর ওই প্রান্তে রায় বাড়ির ছেলে সুখ্যাত প্রফেসর। উমা পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিল - 'আমার পক্ষে এ বিয়ে করা সম্ভব নয়'। মা বাবার সহস্র প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া স্বাভাবিক ছিল। উমা বলেছিল - "যারা এমন করে পণ চাইতে পারে , আর যাই হোক তারা ভালো মানুষ নয়। তুমি তোমার মেয়েকে একটা খারাপ মানুষের হাতে তুলে দিতে চাও বাবা!? ওরা আমায় চাকরি করতে দেবে না! আমার একটু করে দেখা স্বপ্নগুলোর কি হবে!? আমায় ক্ষমা করো বাবা"


তারপর বেশ কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছে , কিন্তু রাজি হয়নি উমা। কেটে গেল দু'মাস । হঠাৎ উমার জীবনে অন্ধকার ছায়া ছেয়ে গেলো। বাবা গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা গেলেন। পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। সেই প্রথম সুকুমার বাবুকে ছাড়া বাড়িতে তিনটে মেয়ে, একেবারে অসহায় হয়ে পড়ল। সেই শোক মস্তকে ধারন করে অনেক ছোটাছুটির পর উমা বাবার চাকরিটা পেয়ে গেল। এটুকু ভরসা পেল যে কারো কাছে হাত পাততে হবে না। 


ঋতুচক্রের মতো মানুষের জীবনে রূপ রঙ বদলে যেতে থাকে। গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার নীরবতা পেরিয়ে আবার'ও যেমন স্বর্নালী শরৎ এসে পড়ে , তেমনি জীবনে'ও । সবসময় একই রকম চলে না । ভালো মন্দ মিলিয়ে জীবন- তা কারোরই অজানা নয়। বরাবরের মতো শরৎকাল উমার জীবনে আলাদা রকম মাধুর্যতার বাতাবরন। এবছর আরো একটু স্পেশাল হলো। অবন্তিক এর আবির্ভাব উমার জীবনে ।  

একই অফিসে দুজনে কাজ করে। যদিও অবন্তিক এর তরফ থেকে প্রস্তাব এসেছে। বৃহস্মিতা'র ও মনে মনে, তাই মানা করেনি। শোকগ্রস্ত নীরব জীবনে শারদীয়ার রঙিন ভুবন। ছেলের কেবল মা রয়েছেন। দুই পরিবার রাজী হয়ে যায়। দুই পরিবারের একই প্রস্তাব- একেবারে বিয়ে পিঁড়িতে বসতে হবে। দিন ঠিক হলো। সময় এলো চার হাত এক হওয়ার।


২৫শে আশ্বিন। দধিমঙ্গল সেরে শিশির স্নাত পথে কোমল কিছু পা এগিয়ে চলেছে জল সইতে। তখন'ও ওঠেনি সূর্য। দীঘির পাড়ে শিউলি তলায় হাট বসছে শিউলি রানীর। কেউ কুড়ালো সযতনে, কেউ মাড়ালো অচেতনে। ফেরার পথে একগোছা কাশফুল সঙ্গী হল । এমন দিনে সাক্ষী হয়ে থাকবে যে। 

ওই দূরে সূর্যটা কিঞ্চিত কুয়াশা মেখে- যেন বিজয়ার রক্তিম খুশি ললাট জুড়ে, একটু একটু করে সময় পেছনে ফেলে আগমনী। সূর্য প্রকট হয়ে নয়নতারা, মাধবীলতা, গোলাপী গোলাপ এর শরীর জুড়ে আলোকময়। নীলাভ শরীরে সাদা মেঘের ভেলা সারি বেঁধে । অভিনন্দন জানাতে চাইছে নবদম্পতিকে। নির্দিষ্ট সময়ে চার হাত এক হলো ,সাক্ষী রইল- বোবা পৃথিবী! আর তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।

যুগ পাল্টেছে , মানুষের চিন্তাধারার বদল ঘটা একান্তই বাঞ্ছনীয়। পণপ্রথা আমাদের সমাজে কেবল অভিশাপ নয়, বিকৃত মানসিক রোগও বটে। সমাজ ,সমাজের মানুষ শিক্ষিত হয়েছে, তবু সমাজের বুক থেকে পনপ্রথা আজও নির্মূল করতে পারেনি। 

উমা আজ বড্ড সুখী, মেয়েদের গুনের মর্যাদা- বাস্তবে আদর্শ জ্ঞানী মানুষের কাছেই পেয়ে থাকে।

উমার সংসার উমা'কে সম্মান করে। সকলের ভালোবাসা উমা'র জীবনে নির্মল স্নিগ্ধতা ছড়ায় । এই সুন্দর জীবন, শক্ত একটা মাটি , স্বধীনচেতা ভুবন- সহস্র উমা নির্মাণ করতে পারে, আবেগে শরীর না ভাসিয়ে, নিজ হৃদয়ের পবিত্রতা দিয়ে!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational