STORYMIRROR

Hasibur Rahman

Romance Classics Others

4  

Hasibur Rahman

Romance Classics Others

শেষ ট্রেনটা আজ থামেনি

শেষ ট্রেনটা আজ থামেনি

19 mins
30

📘 শেষ ট্রেনটা আজ থামেনি

সমসাময়িক প্রেম ও প্রতীক্ষার এক নিঃশব্দ অথচ হৃদয়ভাঙা গল্প

🗂 অধ্যায়

১. স্টেশনের সেই মেয়েটা
২. প্রতিদিনের বিকেল
৩. ছায়া আর ছুঁয়ে থাকা
৪. প্রশ্নের ভেতর উত্তর
৫. নীলের প্রথম অশ্রু
৬. দূরত্ব বলে কিছু নেই
৭. হঠাৎ কোনোদিন
৮. পাঁচদিন পর…
৯. কিছু না বলার দায়
১০. ভালোবাসা শব্দ চায় না
১১. সময় যখন ফিরেও আসে না
১২. শেষ ট্রেনটা আজও থামে না




অধ্যায় ১: স্টেশনের সেই মেয়েটা

বর্ষার সন্ধ্যা সবসময়ই একটু বেশি কাঁপুনি ধরে।
আকাশ থেমে নেই, আবার কাঁদেও না—ঠিক রেললাইনের মতো। ধুলোভেজা বাতাস আর পিচ্ছিল প্ল্যাটফর্মের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল একজন তরুণ, সাদামাটা পোশাকে, চোখে ক্লান্তির ছায়া। নাম—নভিন।

নভিনের হাতে একটা পুরনো বই। রেললাইনের পাশ থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে, দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের হুইসেল। আর সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো বেঞ্চটার পাশে, ঠিক যেখানে একসময় বসত একজন মেয়ে।

বাতাসি।

আজ তার আসার কথা ছিল না, জানে সে। তবু অভ্যেস বড্ড জেদি।
যেমন একবার তুমি কোনো মানুষকে নিজের অভ্যাস বানিয়ে ফেলো—তার অনুপস্থিতিও অভ্যাস হয়ে যায়।
তবে কষ্টের।

বাতাসির সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল এই স্টেশনেই। হঠাৎ বৃষ্টি এসেছিল, ছাতার নিচে জড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা দুইজন—অচেনা হয়েও যেন এক মুহূর্তেই কাছের কেউ।

মেয়েটা বলেছিল, “আপনার ছাতাটা একটু ভাগ করে নেব? আমারটা ভেঙে গেছে।”
নভিন হেসে বলেছিল, “নেবেন তো শুধু ছাতা? গল্পও নিতে পারেন।”

বাতাসি হেসে ফেলেছিল।
হাসিটা এমন ছিল, যেন হঠাৎ সন্ধ্যার ভেতরে একটা বাতি জ্বলে উঠল।

তারপর তাদের দেখা হতো প্রতিদিন।
কোনো মোবাইল নাম্বার নয়, কোনো স্যোশাল মিডিয়ার আদানপ্রদান নয়।
শুধু প্ল্যাটফর্মের ওই নির্দিষ্ট জায়গা, বিকেল ৫টা ২০ মিনিট, আর দুজন মানুষ—যারা একে অপরকে অপেক্ষায় রাখতো।

তারা গল্প করতো—চা নিয়ে, আকাশ নিয়ে, বইয়ের পৃষ্ঠা নিয়ে।
আর সেই গল্পের ভেতরেই, তারা একে অপরকে রেখে দিতো একটু একটু করে।

তবে আজ গল্প নেই, বৃষ্টি নেই। ছায়া আছে।
আর আছে এক নিঃশব্দ প্রতীক্ষা।

নভিন আস্তে করে পকেট থেকে একটা ছোট্ট খাতা বের করল। একটা বাক্য লিখল—

> “কেউ কথা রাখে না বলে দুঃখ হয় না,
কেউ কথা রাখবে—এই বিশ্বাসটাই কষ্ট দেয়।”



তারপর চোখ তুলল…
রেললাইন জুড়ে ছুটে চলেছে একটা ট্রেন।
আর সেই ট্রেনের জানালায় নেই কোনো হালকা নীল সালোয়ার পরা মেয়ে।

আজো বাতাসি আসেনি।
নভিন জানে—হয়তো আসবেও না।

কিন্তু পরেরদিন সে ঠিক আবার আসবে…
ঠিক যেমন অভ্যাস।

অধ্যায় ২: প্রতিদিনের বিকেল

সময়কে বোঝা যায় না—সে কখন ধীরে চলে, কখন ছুটে চলে।
তবে কারো পাশে সময় যখন থেমে যায়, তখনই সেটা জীবন হয়ে ওঠে।

নভিনের জীবনে এমনই ছিল বিকেল পাঁচটা কুড়ি।
টিউশনি শেষে সে সব সময় ছুটে আসতো পুরনো মিরপুর স্টেশনে।
হাতে থাকতো একটা বই, মনটা থাকতো অপেক্ষার মোডে।
তারপর ঠিক সময়মতো এসে দাঁড়াত বাতাসি।

প্রথম কয়েকদিন দুজনেই নীরব ছিল।
একসাথে বসা, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা, মাঝে মাঝে হালকা হাসি—এর বেশি কিছু না।

কিন্তু নীরবতা কখনও কখনও সবচেয়ে বেশি বলায় ভরা থাকে।

একদিন বাতাসি হঠাৎ বলে উঠল,
— “আপনি কি জানেন, মানুষ কেনো কাউকে ভালোবাসে?”

নভিন একটু অবাক হয়ে তাকাল।
সে উত্তর জানে না।
তবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “হয়তো... অভ্যাস হয়ে গেলে?”

বাতাসি হেসে বলল,
— “না, আমি ভাবি… মানুষ ভালোবাসে কারণ সে একা। আর কাউকে একা দেখতে পারে না।”

সেই দিন থেকেই তাদের কথাবার্তা একটু গভীর হতে লাগল।
বাতাসি জানাল, সে ঢাবির ইংরেজি বিভাগে পড়ে। তবে সে সাহিত্যে নয়, বাস্তবতায় বেশি বিশ্বাস করে।
নভিন জানাল, তার ইচ্ছে বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে যাবার—কিন্তু সেটাও সে চায় শুধু মায়ের মুখটা একটু শান্ত করতে।

তাদের গল্পে ছিল না প্রেমের চিরাচরিত সংলাপ, ছিল না “তোমায় ছাড়া বাঁচি না” টাইপ ভাঙা রেকর্ড।
তবে ছিল একটা অভ্যন্তরীণ টান, যা কোনো নাম চায়নি।

নভিন নিজের অজান্তেই প্রতিদিন নতুন জামা পরা শুরু করল, নিজের চুল একটু বেশি সময় ধরে আঁচড়াতে লাগল, আর প্রতিদিন বইয়ের ভেতর একটা করে কবিতার লাইন লিখে আনত—যদি কখনো বাতাসিকে পড়ে শোনাতে হয়।

একদিন বাতাসি নিজেই বলল,
— “তোমার হাতে লেখা কাগজগুলো আমি সব সময় খেয়াল করি। নিজের জন্য লেখো?”

নভিন একটু লাজুক হেসে বলল,
— “হয়তো না। কারো জন্য… যে প্রতিদিন আসে, আবার হারিয়ে যায় ট্রেনের ভেতর।”

সেদিন বাতাসির চোখে কিছুটা নরমতা এসেছিল।
সে শুধু বলেছিল,
— “তুমি খুব অন্যরকম। একেবারে... বাতাসের মতো। ধরা যায় না, কিন্তু ফিল করা যায়।”

নভিন চুপ করে ছিল।
তারপর বইয়ের মাঝখানে গুঁজে রাখা ছোট কাগজে একটা লাইন লিখে দেয় বাতাসিকে।

> “তোমাকে বুঝি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভালোবাসি,
বলার কিছু নেই—তবুও প্রতিদিন বলি।”



ট্রেন এসেছিল। বাতাসি উঠে গিয়েছিল।
বিদায়ের সময় কিছু বলেছিল না।
তবে চোখের ভেতর একরাশ শব্দ ছিল।

তারপর প্রতিদিনই তাদের দেখা হতো।
একটা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হচ্ছিল, যেটা কেউ স্পষ্ট করে বোঝাতে পারতো না, কিন্তু দুজনেই বুঝতো।

তারা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিল না, বন্ধু বললেও কিছু কম পড়ে যেত।

তারা ছিল দুজন—যাদের মধ্যে কিছু বলার ছিল না, তবুও প্রতিদিন বলা হতো।



অধ্যায় ৩: ছায়া আর ছুঁয়ে থাকা

স্টেশনটা বড় একটা সিনেমা হলের মতো—প্রতিদিন নতুন চরিত্র আসে, কিছু পুরনো চলে যায়।
কিন্তু কিছু দৃশ্য রয়ে যায় অদৃশ্য স্মৃতির মতো, কোনোদিন মুছে যায় না।

নভিন আর বাতাসি ঠিক তেমন দুটো দৃশ্য—যারা একই সিনেমার দুই চরিত্র হয়েও একে অপরের সংলাপ হয়ে উঠছিল।

সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা।
বাতাসি এসেছিল একটু ভেজা ভেজা চুলে, চোখে ক্লান্তি। গায়ে জড়ানো একটা ধূসর শাল, ঠোঁটের কোণে অনুচ্চারিত কিছু বলার ইচ্ছা।

নভিন বলেছিল,
— “আজ কেমন লাগছে তোমায়?”

বাতাসি চোখ বন্ধ করে বলেছিল,
— “যেন নিজেকেই বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয়… সবকিছু ছুঁয়ে থাকা সত্ত্বেও আমি কেমন জানি দূরে দূরে।”

একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে এসেছিল তাদের মাঝে।
নভিন নিচু গলায় জিজ্ঞেস করেছিল,
— “তুমি কী কারো ছায়া হয়ে বাঁচো, বাতাসি?”

বাতাসি হেসে ফেলেছিল—একটা বেদনাভেজা হাসি।

— “না… আমি নিজেই আমার ছায়া। যতবার আলোতে দাঁড়াই, ততবার মনে হয় কেউ আমার পাশে নেই—শুধু আমি, আর আমার একলা হওয়া।”

সেদিন তারা কোনো গল্প করেনি।
কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টায়নি।
শুধু বসে ছিল একসাথে—একটা নীরব অনুভবে ভিজে। যেন কেউ কারো কান্না বুঝে ফেলেছিল।

হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছিল, হালকা ঝিরঝিরে।
নভিন ছাতাটা খুলে বাতাসির দিকে বাড়িয়ে দিল।
বাতাসি প্রথমে কিছু বলল না, তারপর আস্তে করে বলল,
— “জানো? আমি চাই তুমি একদিন আমার ছায়া হও… যে আমাকে রোদে দাঁড়াতে দেবে, তবুও পাশে থাকবে।"

নভিন কোনো উত্তর দেয়নি।
শুধু ছাতার নিচে একটু সরে এসে দাঁড়িয়েছিল, যাতে বাতাসির কাঁধ না ভেজে।

সেই মুহূর্তটা ছিল কোনো শব্দ ছাড়াই বলা ‘ভালোবাসি’র মতো।

ট্রেন এসেছিল, বাতাসি উঠে গিয়েছিল।
পিছন ফিরে একটা হাত নাড়িয়েছিল—ছায়ার মতো, ছুঁয়ে যাওয়া কোনো অনুভূতির মতো।

সেদিনের পর বাতাসি একটু বেশি চুপ হয়ে গিয়েছিল।
আর নভিন একটু বেশি লিখতে শুরু করেছিল—নিজের খাতায়, বাতাসিকে ঘিরে, ছায়ার মতো ভালোবাসা নিয়ে।

অধ্যায় ৪: প্রশ্নের ভেতর উত্তর

নভিনের হাতে একটা কাগজ। তার উপরে ছোট ছোট করে লেখা—
“তুমি কেমন? তুমি কাকে ভালোবাসো? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”

তিনটা প্রশ্ন।
কোনোটাই করা হয়নি কখনও।
তবু প্রতিদিন সে কাগজটা নিজের খাতায় ভাঁজ করে রেখে দেয়।
ঠিক যেমন বাতাসি প্রতিদিন কিছু না বলেই চলে যায়—তবু একটা ছায়া রেখে যায় নভিনের ভেতর।

সেদিন বাতাসি একটু আগে এসেছিল। চোখে চশমা, হাতে একটা ডায়রি, আর মুখে অদ্ভুত এক নীরবতা।
সে হঠাৎ বলল,
— “তুমি কল্পনায় বাস করো, না বাস্তবে?”

নভিন একটু থেমে বলল,
— “বাস্তব যতদিন তুমি আসো। তুমি না এলে কল্পনা।”

বাতাসি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “তুমি কী চাও আমার কাছে, নভিন?”

নভিন কিছু বলল না।
তার মুখে কোনো জবাব ছিল না—শুধু চোখে একটা না-বলা আকুতি।

বাতাসি তাকিয়ে বলল,
— “আমি খুব খারাপ মানুষ। কারো সাথে বেশিদিন থাকতে পারি না। আমি পালিয়ে যাই, অভ্যেস মতো।”

নভিন বলল,
— “তুমি চাইলে পালিয়ে যেও। শুধু একটা কথা রেখে যেও, কেন পালালে?”

বাতাসি হেসে ফেলল।
— “তুমি জানো, আমি কখনোই কারো প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিই না। কারণ উত্তর দিলেই সম্পর্ক পরিষ্কার হয়ে যায়… আর আমি চাই সম্পর্কটা যেন ধোঁয়ার মতো থাকে—অস্পষ্ট, তবু স্পর্শ করা যায়।”

নভিন এবার প্রথমবার একটা প্রশ্ন করল,
— “তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”

বাতাসি চোখ নামিয়ে বলল,
— “তুমি কী মনে করো?”

নভিন বলল,
— “মনে হয়… আমি প্রশ্ন করি, তুমি উত্তর হয়ে থেকেও দাও না।”

বাতাসি চুপ করে বসে থাকল।
তারপর হঠাৎ করেই একটা পাতলা কাগজ বের করে দিল নভিনের হাতে।
তাতে লেখা:

> “ভালোবাসা কোনোদিন সরাসরি বলা হয় না।
যাদের বুঝতে হয়, তারা চোখ দেখেই বুঝে নেয়।”



ট্রেন এসেছিল। বাতাসি উঠে গিয়েছিল।
তবে যাওয়ার আগে বলেছিল,
— “কাল নাও আসতে পারি। পরীক্ষা আছে।”

নভিন মাথা নাড়ল।
তবে জানত—কাল সে ঠিক আসবে।
কারণ সে বাতাসির অপেক্ষায় নয়, সে অভ্যাসের অপেক্ষায় থাকে।

অধ্যায় ৫: নীলের প্রথম অশ্রু

নভিন জানত না, বাতাসি কখনো নিজের অতীত নিয়ে কথা বলবে কি না।
কিন্তু একদিন, এক সন্ধ্যায়, বাতাসি তাকে এমন কিছু বলেছিল, যা কখনো কল্পনাও করেনি নভিন।

এদিনও তারা বসেছিল স্টেশনের পুরনো বেঞ্চে।
বাতাসি কিছুটা উন্মাতাল ছিল, চোখে এক ধরনের উদ্বিগ্নতা ছিল—যেন একটা ভারী বৃষ্টি আসার মতো।

নভিন তাকে কিছু না বলে শুধু দেখছিল।
সামনে আকাশ ছিল গা dark ়, আর বাতাসি যেন অদৃশ্য কোনো storm-এর ভিতরে।
হঠাৎ বাতাসি হেসে বলল,
— “তুমি কখনো ভেবেছ, আমি কেমন ছিলাম ছোটবেলায়?”

নভিন একটু চুপ করে শুনল,
— “না, কখনো ভাবিনি। তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, তুমি ছিলে একেবারে অন্যরকম—খুব শান্ত, একটু দূরের মতো। মনে হয়নি তুমি অতীত নিয়ে কিছু ভাবো।”

বাতাসি কিছুটা হাসল, কিন্তু হাসিটা খুবই কৃত্রিম।
— “তবে, অনেক কিছু লুকিয়ে রাখা হয়, নভিন। আমি কখনো কাউকে আমার অশ্রু দেখাইনি, কখনো আমার ভেতরের কষ্টগুলো কারো কাছে প্রকাশ করিনি।”

নভিন কোনো উত্তর দেয়নি, শুধু তার চোখে একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে তাকাল।
বাতাসি এক সময় বলল,
— “আমার নাম আসলে বাতাসি না, ঠিক না। এটা শুধু একটা পরিচয়, একটা খালি নাম। আমার আসল নাম ছিল নীল। তবে কোনোদিন আমি এই নাম আর ব্যবহার করি না।”

নভিন অবাক হয়ে গেল।
— “নীল? কেন?”

বাতাসির চোখে অস্পষ্ট এক ঝাপসা দুঃখ জমে গিয়েছিল।
সে কিছুক্ষণ নীরব ছিল। তারপর এক অজানা ঘোরের মধ্যে বলল,
— “নীল ছিল আমার প্রথম ভালোবাসা। সে ছিল আমার জীবন, আমার পৃথিবী।
আমরা একসাথে থাকতাম, একসাথে বাঁচতাম।
তবে তার একদিন মৃত্যুর পথে চলে যাওয়ার পর, আমি আর কিছুই অনুভব করি না। সে ছিল আমার শ্বাস, সে ছিল আমার অশ্রু। আর তার চলে যাওয়ার পর আমি কিছুই বাঁচলাম না, নভিন। আমি কেবল খুঁজে চললাম তার ছায়া, যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না।”

নভিন শোনার পর এক মুহূর্তে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিল।
সে শুধু বাতাসির দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন তার চোখ থেকে অশ্রু না পড়ুক—কিন্তু একটাও পড়ল না।

বাতাসি আরও একটুখানি থেমে বলল,
— “তুমি জানো, নীল যখন মারা যায়, তখন আমি প্রথম জানলাম—একজন মানুষ কখনো চিরকাল বাঁচতে পারে না। সেদিন থেকে আমি আমার নাম বদলে ফেলি। কারণ নীলের চলে যাওয়ার পর আমি আর কোনো নাম ধরে কাউকে ভালোবাসিনি।”

নভিনের বুকটা ভেঙে গেল।
সে চুপচাপ থাকল।
এবার কিছু বলার ছিল না—কেবল বাতাসির অতীতটাকে একটু বুঝতে চেষ্টা করছিল।
সে একবার বলল,
— “তুমি চেয়েছিলে তাকে ফিরে পেতে?”

বাতাসি মাথা নাড়িয়ে বলল,
— “না, নভিন। ফিরে পাওয়ার মতো কিছু নেই। কখনো কখনো কেউ চলে যায়—এটাই জীবন। তবে তার চলে যাওয়ার পর তুমি যেন অন্য এক রূপে বেঁচে থাকো, কিন্তু সেটা আর তোমার হয়ে ওঠে না। তুমি শুধু তার ছায়া হয়ে থাকো।"

ট্রেনের হুইসেল ভেসে এল, বাতাসি উঠে গেল।
কিন্তু এবার তার চোখে এক ধরনের প্রশান্তি ছিল, যেন কিছুটা ভারমুক্ত।
নভিন তাকিয়ে ছিল, আর অনুভব করছিল—আজ তার সাথে গল্পের কোন দিক শেয়ার করল বাতাসি, যা খুবই ব্যক্তিগত ছিল, কিন্তু এক অব্যক্ত কষ্টে পূর্ণ।

আজ বাতাসি তার প্রথম অশ্রু দেখিয়ে গেল।
আর নভিন জানত—আজ থেকে তার পৃথিবী একেবারে বদলে গেছে।

অধ্যায় ৬: দূরত্ব বলে কিছু নেই

নভিন গত পাঁচ দিন স্টেশনে একাই বসে আছে।

বাতাসি আসছে না।

প্রথম দু'দিন মনে হয়েছিল হয়তো ব্যস্ত, পরীক্ষার চাপ।
তৃতীয় দিন থেকে ফোনে মেসেজ পাঠানো শুরু করেছিল নভিন—
"ভালো আছো তো?"
"আজ আসবে?"
"তুমি যদি না আসো, তাহলে এই জায়গাটায় বসে থাকা বড় অচেনা লাগে।"

কোনো রিপ্লাই আসেনি।

চতুর্থ দিন নভিন একটু দুশ্চিন্তা করেছিল।
পঞ্চম দিনে আর কিছু ভাবল না—শুধু বই নিয়ে স্টেশনের বাঁধানো বেঞ্চে চুপ করে বসে থাকল।

বাতাসির জায়গাটা ফাঁকা।
তার জায়গায় রাখা একটা পুরনো শুকনো পাতা—যেন বাতাসির কোনো স্মৃতি।
নভিন সেই পাতাটাকে খুব যত্ন করে নিজের খাতায় গুঁজে রাখল।

চোখে জল আসেনি।
তবে মনের ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা জমে উঠল।

সে হঠাৎ নিজের খাতার পুরনো কবিতাগুলো খুলে পড়তে লাগল—
যেগুলো একসময় বাতাসিকে শুনানোর জন্য লিখেছিল।

> “তুমি আসো না ঠিকই,
তবু তোমার না-আসাটাও একধরনের আসা।
তুমি দূরে থাকো,
তবু প্রতিটি নিঃশ্বাসে আমি তোমাকে ছুঁয়ে ফেলি।”



সেদিন সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরল না।
পুরো রাত কাটিয়ে দিল স্টেশনের এক কোণে।
নীরব আকাশ, একাকী বাতাস, আর একটা দীর্ঘ অপেক্ষা।

পরদিন সকালে যখন সূর্য উঠল, তখন একটা চিরকুট এসে পড়ে তার সামনে।

সাদা কাগজ, হাতের লেখা চেনা।

> “নভিন,
আমি কোথাও পালিয়ে যাইনি।
শুধু নিজেকে খুঁজছি।
যদি কখনো ফিরে আসি,
তুমি কি তখনো এখানে থাকবে?”



নভিন কাগজটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকল।

হ্যাঁ, সে থাকবে।
এখানেই, এই স্টেশনে।
যেখান থেকে ভালোবাসা শুরু হয়েছিল,
যেখান থেকে প্রতিদিন তার অনুভব ভেসে বেড়ায় বাতাসে।

দূরত্ব তো আসলে কখনোই কারো মাঝে তৈরি হয় না।
এটা হয় কেবল শরীরের।
আর মন?
মন তো কেবল সেই জায়গায় পড়ে থাকে, যাকে ভালোবেসে ফেলা হয় চুপিচুপি।

অধ্যায় ৭: ফেরার কথা ছিল

সময় পেরিয়ে গেছে প্রায় দুই মাস।

স্টেশনের ওই পুরনো বেঞ্চে এখন আর কেউ আগের মতো অপেক্ষা করে না।
নভিন আর প্রতিদিন আসে না, তবে সপ্তাহে একদিন এসে বসে।
বসে থাকে সেই ঠিকানায়, যেখানে বাতাসির মুখ একদিন বিকেলের আলোয় সেজে উঠেছিল।

আজ বুধবার।
নভিন এসেছে—চোখে একটু পরিণত ক্লান্তি, হাতে একটা ডায়েরি।

সে এখন আর কবিতা লেখে না, শুধু ছোট ছোট বাক্য লিখে ফেলে—
"তুমি ফেরোনি, তবু আমি হেরেও যাইনি।"
"তুমি বলেছিলে, ফিরে আসবে—তাই অপেক্ষা করাই আমার ধর্ম।"

আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ বৃষ্টি নামে।
হালকা ঝিরঝিরে নয়, বরং অঝোর।

নভিন ছাতা আনেনি।

সে জানে, সেই প্রথম দেখা সন্ধ্যায় বাতাসির গায়ে ছাতা ধরেছিল সে—
আজ যেন তার অনুপস্থিতির মাঝে সেই স্মৃতি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে।

ঠিক তখন… ট্রেন এসে থামে।
নভিন উঠে দাঁড়ায় না।

সে জানে, বাতাসি আসবে না।
আজও নয়।

কিন্তু এই প্রথম, অনেকদিন পরে, একজোড়া পায়ের ছায়া পড়ে তার সামনে।

নভিন মাথা তোলে।

একটা মেয়ের সাদা কুর্তি, চুলগুলো ভেজা, চোখে সেই পুরনো চশমা।

বাতাসি।

নভিন কিছুই বলতে পারে না। শুধু তাকিয়ে থাকে।
বাতাসি এগিয়ে এসে ধীরে বলে—

— “আমি আসতে পারতাম না, তবু চলে এলাম। কারণ ফেরার কথা ছিল…”

নভিনের চোখে জল আসে না, কিন্তু ভেতরে হু হু করে কান্না ওঠে।

সে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে—

— “তুমি ভালো আছো?”

বাতাসি মাথা নাড়ে।
— “ভালো থাকার সংজ্ঞা পালটে গেছে। এখন শুধু শান্ত থাকতে চাই। আর তোমাকে দেখে শান্ত লাগে।”

নভিনের বুকের মধ্যে যেন কেউ আলো জ্বালিয়ে দিল।

দুই মাস ধরে জমে থাকা সেই অপেক্ষার ছায়া আজ ধীরে ধীরে গলে যেতে থাকে বৃষ্টির মতো।

বাতাসি আবার বলল—
— “তুমি কি এখনো সেই বেঞ্চে বসো?”

নভিন হেসে বলল—
— “এখানে না আসলে তো বোঝা যায় না, কে ফিরবে আর কে নয়।”

একটা শব্দহীন মুহূর্ত তাদের ঘিরে রাখে।

বাতাসি বলল,
— “চলো হাঁটি? অনেক পথ জমে আছে মনে হয়। আর আমি আর পালাতে চাই না।”

নভিন কোনো উত্তর দেয় না।
শুধু এগিয়ে গিয়ে বাতাসির পাশে হাঁটতে শুরু করে।

পিছনে ফেলে আসা অপেক্ষার সব গল্প যেন একে একে হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে।

আজ সত্যিই ফেরার কথা ছিল…
আর বাতাসি ফিরে এসেছে।

অধ্যায় ৮: সম্পর্কের নিঃশব্দ সংলাপ

ফেরার পর বাতাসি প্রতিদিন স্টেশনে আসে না।
তবে সপ্তাহে দুই দিন সে আসবেই।
আর যে দিন আসে, সে দিন তার মুখে অল্প কথা, চোখে দীর্ঘ অভিব্যক্তি।

নভিন বুঝে গেছে—বাতাসি বদলে গেছে।
আর সে নিজেও আর আগের মতো নেই।

একদিন সন্ধ্যায়, ট্রেন আসার মিনিট দশেক আগে বাতাসি এসে বলল—

— “তুমি কি জানো, কোনো সম্পর্ক আসলে একদম শব্দহীনভাবে গড়ে ওঠে?”

নভিন হালকা হেসে বলল—
— “তুমি বুঝি এখনো কবিতা লেখো?”

বাতাসি মাথা নাড়িয়ে বলল—
— “না। এখন শুধু অনুভব করি। শব্দ আর অনুভব এক নয়, নভিন। অনেক সময় আমরা চিৎকার করে বলতে চাই ‘ভালোবাসি’, কিন্তু একটুও আওয়াজ হয় না।”

নভিন কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল।
তারপর বলল—

— “তবে আমি বুঝতে পারি, বাতাসি। তুমি না বললেও, তোমার চুপ করে থাকা, চোখ নামিয়ে রাখা, চলে যাওয়ার সময় পেছনে একবার না তাকানো—সবই ভাষা। সবই যেন এক ধরনের চুপচাপ ভালোবাসা।”

বাতাসি গভীর চোখে তাকিয়ে বলল—
— “তুমি সব বুঝে ফেলো কিভাবে?”

নভিন বলল—
— “কারণ আমি অপেক্ষা শিখেছি।
আর যে অপেক্ষা করতে জানে, সে নীরবতাকে ভাষা বানাতে জানে।”

সেদিন বাতাসি প্রথমবার নভিনের হাত ধরেছিল।

অল্প কিছুক্ষণ।

কিন্তু সেই সংস্পর্শে ছিল এক পৃথিবী কথা।

কোনো প্রতিশ্রুতি নয়।
কোনো ভবিষ্যতের দাবি নয়।
শুধু এই মুহূর্তটা—যেখানে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে দুই পাশে, তবু একটা অনুভবে বাঁধা।

স্টেশনের স্পিকারে ঘোষণা হচ্ছিল,
ট্রেন আসছে।

বাতাসি আস্তে করে বলল—
— “আমি আজ যাচ্ছি, তবে মনে রেখো, কিছু কিছু কথা চুপ থাকলেই বেশি সত্য হয়। আমি যদি কখনো আর কিছু না বলি, তাও জেনে নিও—তোমার পাশে হাঁটার ইচ্ছেটা এখনো হারায়নি।”

নভিন কিছু বলল না।
শুধু বাতাসির চোখের দিকে তাকিয়ে জানিয়ে দিল—
তার অপেক্ষা আজ আর একাকীত্ব নয়, সেটা এখন সম্পর্ক।

একটা নিঃশব্দ সম্পর্ক।
যার প্রতিটি সংলাপ ভাষাহীন।

অধ্যায় ৯: গল্পটা অন্যরকম হতে পারত

একদিন, স্টেশন বন্ধ ছিল।
রেলের লাইন মেরামতের কাজ, প্ল্যাটফর্মে ঝাড়ুদার ছাড়া আর কেউ নেই।

নভিন তবু এসেছিল।

সে জানত বাতাসি আসবে না।
তবু তার খাতা আর কলম নিয়ে বসে থাকল।

হঠাৎ করে তার মনে হলো,
“যদি আমি ওকে সেদিন স্টেশনে প্রথম না দেখতাম?”
“যদি বাতাসি কখনো ফিরে না আসত?”
“যদি ওর নাম নীলই থাকত, আমি কিছুই না জানতে পারতাম?”

তার খাতার এক পৃষ্ঠায় লিখল:

> “গল্পটা অন্যরকম হতে পারত।
হয়তো আমি একটা ব্যস্ত শহরের ভিড়ে হারিয়ে যেতাম,
কিংবা বাতাসি তার নতুন নামটাও পেত না।
আমরা হয়তো দুজনেই অচেনা থেকে যেতাম,
এবং কোনো এক কবিতা হারিয়ে যেত অপ্রকাশেই।”



সন্ধ্যার আগে বাতাসি এল।

নভিন একটু অবাক হলো।
বাতাসি বলল—
— “স্টেশন বন্ধ, আমি জানতাম। তবু এলাম, কারণ আজ মনে হচ্ছিল—গল্পটা হয়তো কিছুটা বাকি আছে।”

তারা একসাথে বসে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে ছিল।

বাতাসি বলল—
— “তুমি কি কখনো ভেবেছো, আমাদের জীবনটা যদি অন্যরকম হতো?”

নভিন বলল—
— “প্রতিদিন ভাবি।
তুমি না এলে, আমি হয়তো খুব সাধারণ একটা জীবন কাটিয়ে দিতাম—সেই ক্লাস, সেই হোস্টেল, সেই ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা।
তোমার জন্যই আমি অনুভব করতে শিখেছি।”

বাতাসি বলল—
— “আর আমি? আমি শিখেছি ফিরে আসার সাহস।
যে ফিরে আসতে জানে, সে হারিয়ে যেতে ভয় পায় না।”

সেদিন তারা কিছুক্ষণ চুপ ছিল।

তারপর বাতাসি ধীরে বলল—

— “নভিন, আমরা কখনো বলতে পারিনি ঠিক মতো—ভালোবাসি কিনা।
তবু এটুকু জানি, তোমাকে ছাড়া আমার কিছুই সাজে না।”

নভিনের চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ল।

সে প্রথমবার স্বীকার করল—

— “তোমার জন্যই আমি মানুষ হতে চেয়েছি।
তোমার জন্যই এই গল্পটা লিখতে চাই, যেন অন্য কেউ পড়ে বলে—গল্পটা অন্যরকম হলেও, ভালোবাসা একই থাকে।”

সেদিন বাতাসি হেসেছিল।

একটা দীর্ঘ, গভীর হাসি।
যেখানে ছিল অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন।

সেই রাতে নভিন তার ডায়েরির শেষ পাতায় লিখল:

> “গল্পটা অন্যরকম হতে পারত,
কিন্তু আমি খুশি, কারণ তুমি ছিলে,
একবার হলেও, সত্যি করে।”

অধ্যায় ১০: শেষ ট্রেনটা আজ থামেনি

সেই দিনটায় আকাশ অদ্ভুত রকম ঘোলা ছিল।
হালকা বাতাস বইছিল, যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু জবাব পায় না।

নভিন খুব সকালে উঠে স্টেশনে গিয়েছিল।
আজ একরকম অস্থির লাগছিল।
বাতাসি সকালে একটাই মেসেজ দিয়েছিল—
"আজ শেষবার দেখা করতে চাই। প্লিজ আসো।"

নভিন জানত না, কেন 'শেষবার' লিখল বাতাসি।

সে শুধু তার পুরনো নীল খাতা, ভাঁজ করা একটা শুকনো পাতা, আর ছোট একটা চিরকুট সঙ্গে নিয়ে এসেছিল।

স্টেশন তখনো ফাঁকা।
কেবল রেললাইনের ওপাশে কয়েকটা ছেঁড়া কাক বসে।

ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে।

ঘণ্টা পেরিয়ে গেল।
বাতাসি এল না।

নভিন উঠে দাঁড়িয়ে রেল লাইনের দিকে তাকাল।

তখনই এক লোক ছুটে এসে বলল—
— “এইটা কি আপনার?”
তার হাতে এক পাতলা স্কার্ফ।
চেনা রঙ, চেনা গন্ধ। বাতাসির।

নভিন কাঁপা হাতে স্কার্ফটা নিল।

লোকটা বলল,
— “আজ সকালবেলা, কাছের ব্রিজ থেকে একটা মেয়ে ট্রেন ধরার চেষ্টা করছিল… শেষ ট্রেনটা আসেনি, স্যার। তবে সে খুব কাঁদছিল। বারবার বলছিল—‘শেষ ট্রেনটা যদি আজ থামে!’”

নভিন চুপ। কিছু বলতে পারে না।

হাতে শুধু স্কার্ফ, পাশে পড়ে থাকা সেই পুরনো পাতার মতো সম্পর্ক।

সে জানে না, বাতাসি কোথায় গেছে।
হারিয়ে গেছে কিনা, নাকি কোনো নতুন শহরে পাড়ি দিয়েছে।
সে শুধু বুঝতে পারে—

শেষ ট্রেনটা আজ থামেনি।

তবে একটা ট্রেন হয়তো ভিতরের ভেতর কোথাও চলে গেছে।
একটা ট্রেন, যেটা নিয়ে যায় স্মৃতি, ব্যথা, না বলা কথাগুলোকে।

নভিন চুপচাপ নিজের খাতার শেষ পাতায় লিখল—

> “আজ তুমি আসোনি,
ট্রেনটাও নয়।
তবে প্রতিদিনকার আসার মতোই
আজকের না-আসাটাও অভ্যস্ত করে দেবে আমাকে।”



> “তোমার অপেক্ষায়
আমি এখনো বসে থাকব—
কোনো ট্রেন নয়,
শুধু আমার ভেতরের বাতাসির জন্য।”



স্টেশনের শেষ বাঁধানো সীমানায় বসে থাকে নভিন।
চারদিক নীরব।
শুধু কানের কাছে বাতাস বলে যায়—

"শেষ ট্রেনটা আজ থামেনি।"

অধ্যায় ১১: সময় যেখানে থেমে থাকে

বাতাসি চলে গেছে।

চলে যাওয়াটা যেন মৃত্যুর মতো নয়, বরং এক জীবন্ত অভাব।
নভিন এখন আর স্টেশনে যায় না।
সে যায় নদীর ধারে—যেখানে বাতাস বয়ে চলে শব্দহীন।

তার প্রতিদিনের জীবন ঠিকই চলছে—
ক্লাসে যায়, পড়ায়, ফেরে, খায়, ঘুমায়।
তবে মনে হয়, ভিতরে কোনো এক ‘ঘড়ি’ অনেক আগেই থেমে গেছে।

একটা নোটবুক খুলে সে প্রতিদিন একটা করে প্রশ্ন লেখে।
প্রশ্নগুলো কারো জন্য নয়, কেবল বাতাসির ছায়ার জন্য—

> ● "তুমি কি এখনো বৃষ্টি দেখলে আমার কথা মনে পড়ে?"
● "আমরা কি ভুল সময়ে ভালোবেসে ফেলেছিলাম?"
● "ভালোবাসা কি সব সময় ফেরে?"
● "তুমি কি সত্যিই চলে গেলে, নাকি এখনো কোথাও আছো?"



এইসব প্রশ্ন জমে ওঠে, উত্তর হয় না।
কিন্তু একদিন হঠাৎ পোস্টবক্সে একটি চিঠি আসে।

খামের গায়ে প্রেরকের নাম নেই।
ভেতরে লেখা কেবল কয়েকটা লাইন—

> “তুমি ঠিক বলেছিলে,
যে অপেক্ষা করতে জানে,
সে নীরবতাকেও ভালোবাসা বানিয়ে ফেলে।
আমি বেঁচে আছি, শুধু অন্য এক জায়গায়।
ফিরে আসা হয়তো হবে না,
কিন্তু তোমাকে ছাড়া একটাও দিন যায় না আমার...”



চিঠিতে নাম ছিল না,
তবু নভিন জানত—এই লেখা কেবল বাতাসিই লিখতে পারে।

সে চিঠিটা বুকে চেপে ধরে জানালার পাশে দাঁড়ায়।

চোখের সামনে সূর্য ডুবছিল।

সেদিন সে নিজের খাতায় লিখে ফেলে—

> “যে সম্পর্ক ফিরে না এসেও বেঁচে থাকে,
তাকে আমি মৃত্যুর পরে বেঁচে থাকা বলি।”



> “সময়ের অনেক কিছু চলে যায়,
কিন্তু কেউ কেউ থাকে—
সময় যেখানে থেমে থাকে, ঠিক সেখানে।”



নভিন জানে, বাতাসি আর ফিরবে না।
তবু তার ভিতরে এখনো বাতাসি বেঁচে আছে—
একটা চিঠির মধ্যে, একটা চোখের জলে, একটা না বলা কথায়।

অধ্যায় ১২: প্রতিশ্রুতির পরে

বছর তিনেক কেটে গেছে।

নভিন এখন একটি কলেজে স্থায়ী প্রভাষক।
তার চোখে নতুন শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন, অথচ নিজে খুব নিঃশব্দ জীবন বেছে নিয়েছে।

তার নোটবুকে এখনো লেখা হয়—
তবে কবিতা নয়, ভাবনা।
বাতাসির নাম কখনো লেখা হয় না, কিন্তু প্রতিটি শব্দে যেন বাতাসির ছায়া।

একদিন কলেজের লাইব্রেরিতে এক পুরনো বইয়ের ভাঁজে সে পায় আরেকটি চিঠি।
লেখা ছিল খুব পরিচিত কাঁচা হাতের লেখায়:

> “তুমি বলেছিলে—যে ফিরে আসা জানে, সে হারায় না।
আমি ফিরিনি, তবু হারাইনি।
এই দূরত্বের মধ্যেও আমি তোমাকে প্রতিদিন ভালোবেসেছি।
তুমি আমার জীবনে ছিলে, থাকবে, হয়তো দেখা হবে না,
তবুও প্রতিশ্রুতি রয়ে যাবে।”



চিঠির নিচে ছিল কেবল এক নাম—

“বাতাসি”

নভিন জানে, এ চিঠি পুরনো, হয়তো বহু বছর আগেই কেউ ভাঁজ করে রেখে গেছে।
তবু তার কাছে মনে হয়—এই মাত্রই বাতাসি তার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল।
চুপচাপ, একবারও না তাকিয়ে।

সেদিন সে শহরের বাইরে সেই পুরনো রেলস্টেশনে যায়।
সবকিছু অনেক বদলে গেছে।

প্ল্যাটফর্মে বসে, সে নিজের খাতায় শেষবারের মতো লেখে—

> “শেষ ট্রেনটা যেদিন থামেনি, সেদিনই আমি চিরদিনের অপেক্ষা হয়ে গেছি।
তুমি আসো বা না আসো, আমি থাকব—
একটা না বলা প্রতিশ্রুতির পরে।”



হঠাৎ করে হালকা বাতাস বয়ে যায়।
একটা শুকনো পাতা উড়ে এসে তার পায়ে পড়ে।

নভিন মাথা নিচু করে, হেসে ফেলে।
হয়তো সে জানে—এটাই বাতাসির উত্তর।

নীরব ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না।
তারা শুধু থেকে যায়—প্রতিশ্রুতির পরে।


📚 শেষ

গল্প: শেষ ট্রেনটা আজ থামেনি
লিখেছেন: মো: হাছিব খান


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance