STORYMIRROR

Hasibur Rahman

Others

4  

Hasibur Rahman

Others

প্রতিশ্রুতির পথে

প্রতিশ্রুতির পথে

7 mins
23

প্রথম অধ্যায়: সেই শুরুর দিনগুলো

সবুজে মোড়া নিস্তরঙ্গ এক গ্রাম—মেঠোপথে হেঁটে গেলে দূরে দেখা যেত সরিষা ফুলের হলুদ সমুদ্র, মাঝে মাঝে জোনাকির মতো জ্বলে ওঠা পাখিদের কলতান। সেই শান্ত প্রকৃতির বুকেই বাস করত নীল, বয়স তখন মাত্র এগারো কিংবা বারো। একরত্তি ছেলেটা ছিল দুরন্ত, তবুও চোখে মুখে এক অদ্ভুত মনোভাব—যেন দুনিয়ার সব কিছু জানার আগ্রহ লুকিয়ে ছিল ওর ভেতর।

সকালের কুয়াশায় ভেজা স্কুল ড্রেস, সাইকেলের চাকা ঘোরার শব্দ, দুপুরে পুকুরে ডুব—এই ছিল তার জীবন। তার ছোট্ট দুনিয়াটাকে আরও রঙিন করেছিল একটি মুখ—রুমি, দূরসম্পর্কের মামাতো বোন। রুমি ছিল নীলের চেয়ে প্রায় চার বছরের ছোট, তবুও ওদের বন্ধুত্ব ছিল যেন দুটো সমবয়সী আত্মার।

নীল তাকে স্নেহভরে ডাকত—"রুমি আফা"। এই ডাকের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত মায়া, যা রুমির মুখে সবসময় ফুটে থাকা মিষ্টি হাসির মতোই কোমল। ছোট্ট মেয়েটির চোখে ছিল অপার বিস্ময়, আর হৃদয়ে ছিল নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। তারা একসঙ্গে মাটির পুতুল খেলত, তাল গাছের পাতা দিয়ে নৌকা বানাত, কখনও কখনও সন্ধ্যার আগে গোরস্থানের পেছনের তালবনে লুকিয়ে গিয়ে আকাশের তারা গুনত।

নীলের জীবনে প্রেম নতুন কিছু ছিল না—তার স্কুলে একাধিক মেয়ের সঙ্গে "বন্ধুত্ব" হয়েছিল, একধরনের কৌতূহল আর আবেগ নিয়ে। কিন্তু সেগুলো ছিল খেলাচ্ছলে আসা অনুভব, এক ঝলকে এসে ঝরে যাওয়া পাতার মতো। রুমি ছিল আলাদা—সে আসেনি জোর করে, কিন্তু থেকে গিয়েছিল মনের গভীরে, নিজের অজান্তেই।

রুমি জানত নীলের অনেক কিছু—তাকে নিয়ে গল্প, হাসির ফোয়ারা, রাগ, জেদ, এমনকি তার দুর্বলতাও। আর সবচেয়ে অবাক করার বিষয় ছিল, এই সবকিছু জেনেও সে নীলকে গ্রহণ করত নিঃশর্তভাবে। একটা নির্ভরতার ছায়া ছিল রুমির আচরণে—যেন বলছিল, "তোমার সবটুকুই আমি গ্রহণ করি, তুমিও একদিন বুঝবে।"

এবং হ্যাঁ—রুমির জীবনের প্রথম প্রেম ছিল নীল। সে অনুভব করত, বুঝত, তবু বলত না। নীরব সেই ভালোবাসা গভীর থেকে আরও গভীরতর হতো প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে।

সে সময়টাতে প্রেম শব্দটা নীলের অভিধানে ছিল ধোঁয়াটে, কিন্তু রুমির দিকে তাকালেই তার হৃদয়ে অন্যরকম এক শব্দ গুঞ্জন তুলত—শুদ্ধতা। বন্ধুত্ব আর স্নেহ মিলেমিশে ভালোবাসার যে বীজ রোপিত হয়েছিল তখন, তা নীরবে গভীরে শেকড় ছড়াচ্ছিল।

আর তারা তখনো জানত না—এই সরল সম্পর্ক একদিন হয়ে উঠবে জীবনের সবচেয়ে বড় অঙ্গীকারের পথচলা।


দ্বিতীয় অধ্যায়: দূরত্বে জন্ম নেয় অনুভব

সময় থেমে থাকে না। সময় গড়িয়ে যায়, মানুষও বদলায়, স্থানও। সেই সময়ই একদিন এল, যেদিন নীলকে গ্রাম ছেড়ে শহরের পথে পা বাড়াতে হলো। অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হতে হবে ঢাকার এক বেসরকারি স্কুলে। সে যাত্রার সঙ্গী ছিল না রুমি, তবে বিদায়ের সময় তার চোখে লুকানো অশ্রুর ঝিলিকটা নীল ভুলতে পারেনি কখনো।

রুমি তখনো ছোট, ক্লাস ফোরে পড়ে। তার জীবন সীমাবদ্ধ ছিল স্কুল আর খেলাধুলার মধ্যে, কিন্তু নীলের প্রতি তার একান্ত অনুভবটা প্রতিদিন একটু একটু করে ঘন হতে থাকল।

ঢাকায় গিয়ে নীল শহরের ব্যস্ততায় ডুবে গেলেও, মন মাঝে মাঝেই ফিরে যেত গ্রামে। বিকেলের আলোতে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মনে হতো—এই মুহূর্তে রুমি কী করছে? এমনকি স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থেকেও হঠাৎ মনের ভেতরে একটা নরম কণ্ঠস্বর গুঞ্জন তুলত—"নীল ভাইয়া, তুমি কেমন আছো?"

একবার কলেজের ছুটিতে নীল গ্রামে আসে। খবর পেয়েই রুমি স্কুলে যাওয়ার ছলে ইউনিফর্ম পরে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ে—উদ্দেশ্য, নীলকে একবার দেখা। দেখা হয় না। কিন্তু হাল ছাড়ে না রুমি। টিফিন সময়ে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে সে একরকম পালিয়ে আসে, সোজা চলে আসে নীলের কাছে।

রাস্তার ধারে, গাছের ছায়ায়, ওরা বসে থাকে কিছুক্ষণ। কথার ফাঁকে ফাঁকে হাঁসি, শৈশবের গল্প, আর অদৃশ্য একটা টান যেন জড়িয়ে রাখে তাদের। রুমির মুখে ফুটে থাকা মায়াবী হাসিটা দেখে সেদিন নীলের হৃদয়ে কেমন যেন এক অজানা কাঁপন ওঠে। অনেকদিনের জমে থাকা এক অনুভব যেন ছিঁড়ে পড়ে—সে বুঝতে পারে, এই মেয়েটা শুধু "রুমি আফা" নয়, সে তার জীবনের এক অনিবার্য অংশ হয়ে উঠেছে।

ঢাকা ফিরে যাওয়ার পর, নীলের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। সে যেন নিঃশব্দ হয়ে পড়ে, মনের গভীরে যেই কথা এতদিন জমিয়ে রেখেছিল, তা আর আটকে রাখতে পারে না।

রুমি তখন ক্লাস টেন এ পরে SSC এক্সাম ছিলো অতি নিকটে, আর নীল দ্বাদশ শ্রেণিতে। তাদের মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত, ছোট ছোট মেসেজ, অল্পকিছু দেখা, কিন্তু অন্তরে গাঢ় বন্ধনের সূত্র তৈরি হচ্ছিল।
একদিন, নীল ফোনে হঠাৎ বলল,
"রুমি, তোমার সেই মায়াবী হাসির ওপর আমি ক্রাশ খেয়েছি। আমি তোকে ভালোবাসি।"

রুমি বললো  আমি তোমাকে পরে জানাচ্ছি এখন আমার এক্সাম এর প্রিপারেশন চলতেছে, এক্সাম এর পরে যানাব। নীল তো নাছরবান্দা কোন কিছুতেই মানল না, তারপরে,
রুমি কিছুক্ষণ নীরব রইল, তারপর ধীরে ধীরে বলে উঠল,
"আমি তোমার কথাগুলো শুনতে পাই, নীল ভাইয়া।" আমি ও তোমাকে ভালো বাসি।

২৩ নভেম্বর ২০১৮। দিনটা তারা কখনো ভুলবে না। সেদিন, দুইটি হৃদয় নীরবে একটি পথের শুরু করেছিল—প্রতিশ্রুতির পথে, ভালোবাসার পথে।

তৃতীয় অধ্যায়: প্রতিজ্ঞার পবিত্রতা

এমন এক ছোট্ট মুহূর্তে তাদের ভালোবাসার শুরু হল, যেখানে শব্দ কম, অনুভব বেশি ছিল।

এর পর থেকে তাদের সম্পর্ক ছিল বিশ্বাস আর প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। একদিন, রুমি হাতে কোরআন শরীফ নিয়ে নীলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
"নীল ভাইয়া, একটা কথা বলো, আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না।"

নীল বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছাড়াই বলল,
"আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না, রুমি।"

এই প্রতিজ্ঞা ছিল তাদের ভালোবাসার সবচেয়ে বড় ভিত্তি, যা তাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ছাপ ফেলেছিল।



চতুর্থ অধ্যায়: ভুল বোঝাবুঝির দিন

নীল আর রুমির সম্পর্ক যত গাঢ় হচ্ছিল, ততই বাহিরের চোখে নানা সন্দেহ জাগতে শুরু করল। একদিন রাতে, নীল হঠাৎ এক পিকনিকে গেল — কাউকে না জানিয়ে। তার মোবাইল ফোনের চার্জও শেষ হয়ে যাওয়ায় রুমির সঙ্গে যোগাযোগ করাও অসম্ভব হয়ে পড়ল।

রুমি খবর পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। তার মনে এক ভয়াবহ সন্দেহের ছায়া নেমে এল—হয়তো নীলকে কেউ আটকে রেখেছে, হয়তো জোর করে বিয়ে দিয়ে ফেলার প্রস্তুতি চলছে। ভাবনা তাকে শান্তিতে রাখছিল না। রুমি সকালে কাঁদতে কাঁদতে, স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে, সে দ্রুত নীলের গ্রামের পথে রওনা দিল।

রুমির চোখে সেই দিন ছিল অন্ধকারের মতো। তার হৃদয়ের ভেতর আশার লাঠি দগ্ধ হতে লাগল। সে যত দ্রুত পাড়ি দিল, মনে হচ্ছিল সময় থেমে যাবে না।

গ্রামে পৌঁছেই, রুমি নীলকে খুঁজতে লাগল। অবশেষে সে নীলকে দেখে, তার হৃদয় একটু শান্ত হল। কিন্তু আনন্দ খুব তাড়াতাড়ি মিলল না।

নীলকে দেখতে পেয়ে, তার এক কাজিন ফিসফিস করে কানে বলল, “যদি সে সত্যিই ভালোবাসত, তাহলে তোকে না জানিয়ে কোথাও যেত না।”

এই কাজিন ছিল দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালানো এক ব্যক্তি, যার কথাগুলো বিষের মতো রুমির মনকে কাঁপিয়ে দিল।

রুমি নিজেও সন্দিহান হল। তার চোখে জল জমল, মনে হল ভালোবাসা কি এমনই ঝুঁকির?

ঘটনাটি বাড়িয়ে তোলে রুমির পরিবারের সন্দেহ। তারা নীলের দিকে অবিশ্বাসের চোখে দেখল। সকালে যখন নীল আসলো, তখন নীলের বড় ভাই সরাসরি নীলকে প্রশ্ন করল, “তুই কাউকে ভালোবাসিস?”

নীল সাহস করে, ভয়ের সাঁকো পার হয়ে, বলল, “আমি রুমিকে ভালোবাসি, বিয়ে করলে তাকেই করব।”

এই মুহূর্তে নীলের পরিবার অবশেষে রুমির কথাকে স্বীকার করল এবং দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের কথা প্রকাশ পায়।

পরবর্তী দিনগুলো ছিল জটিল—বিভিন্ন ধরনের চাপ, সন্দেহ, সমালোচনা, আর কঠিন কথোপকথন। কিন্তু তাদের ভালোবাসা ছিল মজবুত, যা ধীরে ধীরে সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলল।

পঞ্চম অধ্যায়: তিলে তিলে মৃত্যু, তবুও জয়

রুমির পরিবারের রাজি হতে সময় লেগেছিল অনেকটা। তারা চাইছিল রুমির জন্য ‘ভাল’ পাত্র দেখতে। একের পর এক পাত্র আসত, কিন্তু রুমির মনোভাব যেন জোরালো হয়ে উঠছিল। সে জানত, তার ভালোবাসার মানুষ নীল ছাড়া অন্য কাউকে সে কখনো চাইবে না।

নীলও ভেঙে পড়েছিল একবারে। বারবার মনে হচ্ছিল—সবকিছু হারিয়ে ফেলছে সে। কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল আল্লাহর রহমতে সব বাধা দূর হবে।

দিন গড়িয়ে গেল। অবশেষে দুই পরিবারের মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত হলো। দীর্ঘ মিথস্ক্রিয়া আর অনেক বুঝাইয়ের পর, তারা একমত হলো—রুমি আর নীলের ভালোবাসার জন্যে।

১৩ ডিসেম্বর ২০২১—সেই দিন বিকেল ছিল তাদের জীবনের অন্যতম আনন্দঘন দিন। দুই হৃদয় মিলল বিবাহের বন্ধনে। তাদের বন্ধুত্ব আর প্রেম আজ এক অনিবার্য বাস্তবতায় পরিণত হলো।

এখন তারা একসাথে। সকল কষ্ট, ভুল বোঝাবুঝি পেছনে ফেলে তারা তৈরি হলো নতুন জীবন শুরু করতে। তাদের চোখে ছিল স্বপ্ন, বিশ্বাস আর একে অপরের জন্য অগাধ ভালোবাসা।


ষষ্ঠ অধ্যায়: পূর্ণতার গল্প

রুমি আর নীল এখন একসঙ্গে, নতুন জীবনের শুরুতে। রুমি আগের মতোই ধার্মিক, তার নৈতিকতা ও বিশ্বাস অটুট আছে। কিন্তু এখন সে শুধু সেই ছোট্ট গ্রামবাংলার শ্যাম বর্নের মেয়েটা নয়—সে এখন আগের চেয়ে অনেক সুন্দরী হয়েছে, তার মায়াবী মুখ ট এখন ও আছে। নীল তার দিকে তাকালে সকল কষ্ট ভুলে যায়।

নীলও বদলেছে; তার চোখে আছে দায়িত্ববোধ, আর মন যেন তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে রুমির প্রতি ভালোবাসা ও যত্নে ভরপুর।  তারা একে অপরকে ভালো মানুষ হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

তাদের সম্পর্ক শুধুই ভালোবাসা নয়—এটা বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, এবং একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার গল্প। জীবনের প্রতিটি কষ্ট, প্রতিটি আনন্দে তারা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে।

নীল জানে, যতই পৃথিবী কঠিন হোক, রুমি যদি পাশে থাকে, সবকিছুই সহজ হয়ে যাবে।

এই ছিল তাদের “প্রতিশ্রুতির পথে” চলার গল্প—যে পথ শুধু ভালোবাসার নয়, বরং এক গভীর বিশ্বাস আর সংযমের।


Rate this content
Log in