স্বেচ্ছায় নির্বাসন
স্বেচ্ছায় নির্বাসন
সময়কে সময় দিয়েছি। চুপচাপ জীবনটা পার করে দিতে চেয়েছি। ভেবেছিলাম, এই জীবনের কষ্টগুলো হয়তো এমনি করেই একদিন মুছে যাবে। কিন্তু আজ নিজেকেই নিজে অসহ্য লাগে। প্রতিনিয়ত মনে হয়—হাফ ছেড়ে বাঁচি!
এ জগত সংসারে যখন কেউ আমাকে বুঝলো না, তখন এত আয়োজন, এত আকুলতা কিসের?
তাই সবকিছু ফেলে আজ নিজের মতো করে, স্বাধীনভাবে নিজের পথ নিজেই হাঁটতে চাই।
এই সিদ্ধান্ত নিতে আমার অনেক সময় লেগেছে। ভেবেছিলাম, একসাথে সবাইকে নিয়ে বাকি পথটা পার করব। যৌবন যেভাবেই কাটুক, অন্তত বার্ধক্যটা নিজের মতো করে সাজাতে পারব।
কিন্তু আমি বড়ই বোকা! কথায় আছে, যার হয় না আটে, তার হয় না আশিতে। আমি যেন সেই মানুষটাই। জন্মেছি ভাঙা বেড়ার ঘরে। চারপাশে ফাঁকফোকর, শিয়াল ডাকলে মা ভয়ে থাকতো—একাকী আমাকে ফেলে কাজেও যেত না।
তবু আমি ভেবেছিলাম—না পাওয়াটা যদি সত্যও হয়, সময় একদিন পাল্টাবেই, মানুষ বদলাবে, তারা বুঝবে।
কিন্তু কিছুই বদলায়নি। আমার ভাবনাগুলো ভাবনাই থেকে গেল।
সব স্বপ্ন দেখা যায় না। আমি হয়তো একটু বেশিই ভেবেছিলাম।
মানুষ তার ইচ্ছেমতো পথ চলতে পারে না। আবেগ দিয়ে সংসার হয় না। সংসার, সমাজ, পৃথিবীর মানুষগুলো বড়ই জটিল।
তুমি যত সহজ করে ভাববে, তারা তত জটিল করে তুলবে তোমার জীবনটাকে।
তোমার প্রয়োজনে তারা তোমাকে মিষ্টি সুরে ডাকবে, স্বার্থ ফুরোলেই ছুঁড়ে ফেলে দেবে—একটুও চিন্তা করবে না।
এই ডিজিটাল যুগে সবাই ব্যস্ত। কেউ কাজ নিয়ে, কেউ দায়িত্ব এড়াতে কাজের অজুহাত নিয়ে।
পুরুষ মানুষ যৌবনে নারীর মূল্য দেয় না, তখন নিজেকে ঘরে-বাইরে উপভোগ করতে চায়।
আর বার্ধক্যে সেই নারীকে আঁকড়ে ধরেই শেষ বেলার সঙ্গী খোঁজে।
বড্ড হিসেবি!
কিন্তু সময়ও যে একদিন দাঁতভাঙা জবাব দিতে পারে—এটা তারা ভুলে যায়।
ভালোবাসা মানে শুধু ভালোবাসা নয়—সেটা শ্রদ্ধা, সম্মান, আন্তরিকতা, ভক্তি, আর গভীর মমতায় গাঁথা এক অনুভব।
মেয়েরা সব কিছু ভাগ করতে পারে, কিন্তু নিজের স্বামীকে না।
কতজন স্বামী সেটা বোঝে? আমার মনে হয়, এক শতাংশও না!
যেদিন সংসারে নিজেকে একা মনে হলো, সেদিন বুঝলাম—হারানো চাওয়া-পাওয়ার কিছুই আমি কখনও ফিরে পাব না।
তাহলে কেন এত অকারণ কষ্ট, চোখের জল, নিজের অসুস্থতা?
সন্তানদের মায়ায় অনেক বছর পার করেছি। এখন তারা অনেক কিছু বোঝে। নিজের মতো থাকতে চায়। ভালোবাসা বা শাসন তাদের দমবন্ধ লাগার মতো লাগে।
তাদের ভাষ্য—"আমরা ভালো-মন্দ বুঝি, আমাদের বোঝাতে আসা বোকামি। নিজেও ভালো থাকো, আমাদেরও শান্তি দাও।"
খাঁচার পাখিও খোলা আকাশে উড়তে চায়।
আমারও এখন তাই মনে হয়।
আমার নামের মতোই আমি একা। কবরে একাই যেতে হবে। সঙ্গীও যাবে না।
তাহলে এত মিথ্যে আকাঙ্ক্ষা, মায়া কেন?
একদিন কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম—একটি বৃদ্ধাশ্রমে একজন সৎ ও পরিশ্রমী কেয়ারটেকার প্রয়োজন। চুপিচুপি কেটে রেখে দিলাম। আজ সাহস করে ফোন করলাম। চাকরিটা হয়ে গেল।
বলে গেলে কেউ যেতে দিত না। তারা ভাবে, তারা আমাকে ভালোবাসে।
না, আসলে সংসারের বোঝাটা কেউ নিতে চায় না বলেই আমায় ছাড়ে না।
তাই, এক কাপড়ে, কিছু দরকারি কাগজপত্র নিয়ে আল্লাহর নাম করে বেরিয়ে পড়লাম।
বের হওয়ার আগে সবার পছন্দমতো রান্না করে খাওয়ালাম।
সবাই খুশি হয়ে খেলো। কেউ জিজ্ঞেস করল না, আমি খেলাম কিনা!
বললে হয়তো আবার আবেগে পড়ে যেতাম—ভালোই হলো, কিছু না বলেই চলে যাওয়া সহজ হলো।
বের হওয়ার সময় বললাম, “একটু হেঁটে আসি।”
সবাই শুনলো, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না।
আমার জন্য ভালোই হলো।
হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো না।
হয়তো দু-তিন দিন মন খারাপ করবে, তারপর ঠিকই আগের মতো চলবে—এটাই নিয়তি।
সব কিছু বাদ দিয়ে আজ আমি নিজেকে সময় দিতে বেরিয়ে পড়লাম।
নিজের মূল্যবোধটুকু ফিরিয়ে আনতে, নিজের মতো করে বাকি পথটা চলতে...
স্বেচ্ছায় নির্বাসন।
ভালো থাকুক আমার প্রিয়জনরা।
ভালো থাকুক আমার সাজানো সংসার।
ভালো থাকুক আমার অশেষ ভালোবাসার সন্তানরা।
