STORYMIRROR

shireen yesmin

Others

4  

shireen yesmin

Others

সঠিক সিদ্ধান্ত

সঠিক সিদ্ধান্ত

3 mins
10

সঠিক সিদ্ধান্ত?

আমি ছিলাম বাবা-মায়ের অত্যন্ত বাধ্য মেয়ে। কখনো তাঁদের কথায় অবাধ্য হইনি, মনে পড়ে না তাঁদের কখনো কষ্ট দিয়েছি। আমার একটাই "অপরাধ" ছিল—আমি তাঁদের কথা খুব বেশি শুনতাম। বই-পড়া, নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত আর অবসরে বাবা-মাকে সাহায্য করাই ছিল আমার জীবনের নিয়মিত চিত্র।

শরীরটা ছিল দুর্বল—সারা বছর সর্দি-জ্বর, কাশি লেগেই থাকত। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! পরীক্ষা এলেই অসুখ যেন আলিঙ্গন করতে আসত। এমনও হয়েছে—মেডিকেল থেকে রাত ৩টায় ফিরে সকালে পরীক্ষায় বসেছি।

এসএসসি পাস করার দিন আমার বাবা অফিসে বসেই কেঁদে ফেলেছিলেন—আমি প্রথম বিভাগে পাস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আমি চাইলে কলেজে ভর্তি করে দেবেন, না চাইলে কিছু বলবেন না। আমি ভর্তি হয়েছিলাম, পাশও করেছিলাম। সময়ের ব্যবধানে মাস্টার্স শেষ করলাম, একটি স্কুলে চাকরিও পেলাম।

এমন সময় বাবা-মার মনে বিয়ে নিয়ে নানা দুশ্চিন্তা ভর করল। চাকরিজীবী ছেলে আসত না, আসত বিদেশফেরত পাত্র—যা আমাদের পরিবারের কারও পছন্দ ছিল না। বয়স বেড়ে যাচ্ছিল, একসময় এক বিদেশফেরত ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলো।

বিয়ে হলো ঠিকই, কিন্তু ছেলে কেমন, তার পরিবার কেমন—তা যাচাই না করেই। বিয়ের পর বুঝতে পারলাম, পরিবারের কেউ এই বিয়েতে রাজি ছিল না—শুধু ছেলের কারণে আমাকে বিয়ে করা হয়েছে। বিয়ের দিনই টের পেলাম, তাঁর আপন ভাইয়ের স্ত্রী’র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। লজ্জায় কিছু বলতে পারিনি, প্রমাণ ছাড়া কাউকে প্রশ্ন করাও যায় না।

আমি ভাগ্যের উপর ছেড়ে সংসার করতে লাগলাম। কিন্তু মনের সন্দেহটা কখনো দূর হলো না। স্বামী পাশে ছিল ঠিকই, কিন্তু ভালোবাসার আন্তরিকতা ছিল না। কিছু দিনের মধ্যেই আমি মা হতে যাচ্ছিলাম। অথচ বিয়ের শুরু থেকেই তাঁর বাইরে থাকা, রাত করে ফেরা, এবং তাঁর পরিবার ছাড়া কিছু না বোঝা—সব মিলিয়ে নিঃসঙ্গতা গভীর হচ্ছিল।

একবার কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিলাম—ভেবেছিলাম ভালো লাগবে। কিন্তু স্বামী সারা রাত ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল। যেন আমি নতুন বউ নই, যেন আমার শখ বা ভালো লাগার কোনো মূল্যই নেই।
এরপর সে বিদেশ চলে গেল। আমি তাঁর পরিবারের ব্যবহার বুঝে বাবার বাড়ি চলে এলাম।

চুপচাপ থাকা মানুষগুলো অনেক সময় গভীর জলের মাছ হয়। তাদের মন বোঝা কষ্টকর, আর সংসার করা আরও বেশি কঠিন। যে সংসারে বোনের প্রভাব বেশি, যেখানে মা যৌতুকের কথা তোলে, আর স্বামী চোখ বুজে নিজের পরিবারের পক্ষ নেয়—সে সংসারে ভালোবাসা টিকে না।

আমার সন্তান জন্মের পর শুনলাম—তাঁর মা, বোন, ভাই, ভাবী সবাই মিলে তাঁকে বোঝাচ্ছে আমাকে তালাক দিয়ে দিতে, কাবিনের টাকা দিয়ে বাচ্চাসহ আমাকে বিদায় করে দিতে। কিন্তু শ্বশুরের ভালোবাসা আমাকে সেদিন রক্ষা করেছিল। তবু তিনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে নয়, যেন একজন শিক্ষিত গৃহকর্মীর মতো রাখলেন।

রোজার এক রাতে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। রোজা রাখার জন্য উঠতে পারছিলাম না। দরজায় কেউ নক করল। ঘুমচোখে দরজা খুলে দেখি, শ্বশুর দাঁড়িয়ে। মুহূর্তেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। কারণ শ্বশুরের কণ্ঠ স্বামীর মতোই—তাঁর অভাব তখন ভীষণভাবে অনুভব করলাম।

শাশুড়ি আর ভাসুর যৌতুকের খোঁটা দিতেন, কিন্তু বাবা-মাকে কিছু বলার সাহস হতো না—তাঁদের কষ্ট দিতে চাইনি।

৫ বছর পর শুনলাম, সে দেশে এসে আরেকটি বিয়ে করেছে। তাঁর মা ও বোন মিলে করেছে। কিন্তু একজন স্ত্রী কখনো নিজের স্বামীর ভাগ আর কাউকে দিতে চায় না। আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করেছি সততার সঙ্গে। অথচ তার পুরস্কার এভাবে পেলাম।

যেদিন তাঁকে দেশে ফিরে দেখলাম, সবকিছু নিশ্চিত হয়ে গেল। কিছু বললাম না, শুধু সিদ্ধান্ত নিলাম—এই মানুষটির সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।

পরদিন বাবার বাসায় চলে এলাম। আর শ্বশুরবাড়িতে ফেরত যাইনি। তালাক নেই, তবে সম্পর্কও নেই।

বাবা তখন রিটায়ার করেছেন। আমরা এক চেনা শহর ছেড়ে চলে গেলাম নির্জন সমুদ্রকূলের পাশে। যেখানে সকালের সূর্যে বালু ঝলমল করে, আর রাতের সমুদ্রের গর্জন বুকের হাহাকার জাগায়। কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলে না—আমার জীবনের মতোই।

বিয়েতে রাজি হওয়াটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। খোঁজ না নিয়ে, না বুঝে একটা সিদ্ধান্ত—যার মূল্য আজও দিয়ে যাচ্ছি।
সঠিক জীবনসঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি না পারলাম ভুলগুলো শোধরাতে, না পারলাম নতুন করে শুরু করতে।

তবু আমি বিশ্বাস করি—এই অভিজ্ঞতা আমার সন্তানের জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ দেখাবে। আমি যদি ব্যথা সয়ে উঠে দাঁড়াতে পারি, তবে ও নিশ্চয়ই ভালো জীবন গড়তে পারবে।


---


Rate this content
Log in