রূপান্তর
রূপান্তর
“মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুমটা ভাঙল তনুজার। রাত্রি তিনটে পনেরোয় চৈতির ফোন! ঘুমচোখে রিসিভ করল, “কী রে! এত রাতে ফোন কেন?” বিপরীতে ভেসে আসা কথাগুলো শুনে মুহূর্তের জন্য ওর পায়ের তলার মাটিটা যেন সরে গেল!”
কোনোরকমে রাত পোশাকটা বদলে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ালো তনুজা। নির্জন রাস্তায় তেড়ে আসা কুকুরগুলো আজ সব ভয়ের উর্ধ্বে । স্কুটির গতিটা আজ বোধহয় হাওয়ার চেয়েও বেশি । ফোনে চৈতির বলা কথাগুলো বার বার বাজতে লাগলো কানে তার। হঠাৎ থামলো সে! একটা প্রশ্ন হঠাৎ মাথাচারা দিয়ে উঠলো। " চৈতি কেন? অতনু কি তবে!"
দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আবারও উচ্চগতিতে স্কুটি চালাতে আরম্ভ করল তনুজা। আমরি হাসপাতালে পৌঁছে গাড়িটা কোনোরকমে ফেলে রেখেই ছুটলো ইমার্জেন্সির দিকে।
স্ট্রেচারে শায়িত সাদা কাপড় ঢাকা মানুষটার ঝুলতে থাকা হাতটা যে তার বড় চেনা! হঠাৎ থমকে গেল পা! শত চেষ্টা করেও পা বাড়াতে পারছে না তনুজা! যেন কেউ একশো কেজির পাথর বেঁধে দিয়েছে তার পায়ে। তনুজাকে দেখে এগিয়ে এল চৈতি। কিন্তু তনুজার মনে ওঠা আশঙ্কার ঝড় উড়িয়ে দিতে চাইছে সাদা কাপড়টা। মন বলে চলেছে, " না! না! এএএএ অতনু নয়!" ঠিক তখনই চৈতি এসে জড়িয়ে ধরলো তার ছোটোবেলার প্রাণের বন্ধু তনুজাকে ।
"উল্টোদিক থেকে ট্রাকটা এসে সব শেষ করে দিল রে!" আমি যদি জল নিতে না নামতাম তাহলে হয়তো আমি!" -- কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছে চৈতি।
সাদা কাপড়ের আড়াল সরিয়ে বেরিয়ে আসা রক্তাক্ত মুখটা তনুজাকে পাথর করে দিল। শুধু বললো, " অতনু তুমি কি ভুলে গেলে, আজ আমার জন্মদিন! ঠিক সময়ে ফিরে আসবে বলেছিলে, কিন্তু এভাবে তো বলোনি!"
লাশকাটা ঘরে কাটাছেঁড়া চলছে অতনুর। তনুজার মনে চলছে সম্পর্কের কাটাছেঁড়া ।
পাথর হওয়া বুক চিরে বেরিয়ে এল শাণিত এক প্রশ্ন ।
"অতনু তো অফিস ট্যুরে ব্যাঙ্গালোর গেছিল। তুই ওর সাথে কেন?"-- প্রশ্নটা শুনে প্রথমটা চৈতি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও , পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, আমি ছিলাম
ওর সাথে । আমাকে ক্ষমা করে দে তনু! আমি চাইনি রে তোদের জীবনে আসতে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পারিনি রে।
"কবে থেকে রে?"-প্রশ্ন করে তনুজা।
"বিশ্বাস কর তনু! অতনু তোকেও ভীষণ ভালোবাসতো। আমি সে কারণে বহুবার নিজেকে বোঝাতে চেয়েছি । কিন্তু ওর থেকে কেন জানিনা নিজেকে দূরে রাখতে পারিনি।"-- কেঁদে ফেলে চৈতি।
"ও এমনিই ছিল । ওকে ভালো না বাসাটাই কঠিন কাজ । ঘেন্না করার কথা ভাবনাতেই আনা অসম্ভব ।"
"তুমি ঠিক করলে না অতনু! তুমি কথা দিয়েছিলে ফিরবে।"-- চিৎকার করে কেঁদে ওঠে তনুজা।
অভিযোগ অনুযোগ দূরে সরিয়ে সারা রাত অতনুর স্মৃতির ভিড়ে হারিয়েছে দুই বন্ধুতে।
চুল্লি থেকে বেরিয়ে আসা জটপাকানো ধোঁয়ায় অতনু যখন মিশে যাচ্ছে ঠিক তখনই বেজে উঠলো তনুজার মোবাইল । ওপার থেকে গাইনোকলজিস্ট ডঃ ত্রিধা সান্যাল যখন তনুজার মা হওয়ার খবরটা কনফার্ম করলো, তখন তনুজার চোখ বেয়ে নেমে এল অসহায় মাতৃত্বের যন্ত্রণা ।
চৈতিকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো তনুজা।
"কাঁদিস না তনু! অতনু কথা রেখেছে দেখ। ও ফিরছে! এবার শুধু তোর হয়ে!"
সর্বহারা চৈতির শোক বাষ্পীভূত তনুজার গর্ভের উষ্ণতায়।