রক্ত
রক্ত


"তোর লজ্জা করে না অমন একটা পরিবেশে গিয়ে পাঁচটা অচেনা লোকের সঙ্গে লাফালাফি করতে?"
মাসির ফোনটা তুলতেই কথাগুলো পাইয়ের কানে এসে বাজলো। বুঝতে পারল মা-ই ব্যাপারটা পাচার করেছে মাসির কাছে। আজ পাই আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ কেটে দিল ফোনটা। ও জানে মাসি কী ভাবল - অবাধ্য ছিলই মেয়েটা, অসভ্যতাটাও ভাল রপ্ত করেছে।
পাইয়ের বাবা তো আজকের ব্যাপারটা জানতে পারার পর থেকে তার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। মা মাঝেমধ্যে শুধু - খেয়ে নে, চান করে নে, পড়িয়ে তাড়াতাড়ি ফিরবি ইত্যাদি।
অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করেছে পাই। এখন প্রেসিডেন্সি কলেজে মাস্টার্স করছে। পাইয়ের মাথাটা একেবারে ঝকঝকে। ক্লাসমেট অর্পণ মজা করে বলে, "পাই দা গ্রেট, যে ক্লাস নাইনের পর আর কোনও দিন ক্যালকুলেটরে হাত দেয়নি!"
পাইয়ের ভাল নাম পিয়ালী। কলেজে কেউ ওকে ডাকে না ওই নামে। অনার্সের ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম দিন র্যাগিং-এর সময়ে অঙ্কের সূচক পাই-এর ভ্যালুতে দশমিকের পরের খান কুড়ি সংখ্যা গড়গড় করে বলে দিয়েছিল সে। অর্পণ লাস্ট-বেঞ্চে বসে শুনছিল। তারপর সে-ই ‘পাই’ নামটা ছড়িয়ে দিয়েছিল কলেজে। প্রেসিডেন্সিতে একসঙ্গে মাস্টার্স করতে এসেও সে গোটা ক্যাম্পাসে পিয়ালীকে পাই বানিয়ে ছেড়েছে। পাই অবশ্য এতে কিছু মনে করে না। পাই খুব চুপচাপ, সাদামাটা। কারও সাতেপাঁচে থাকে না। নিজের পড়াশোনা করে, কয়েকটা স্কুল-পড়ুয়াকে অঙ্ক করাতে যায় সন্ধ্যেবেলা আর গান শোনে। যে সে গান নয়। রক গান, তাও আবার বাংলা-রক !
পাই নিজেও এককালে গিটার বাজাতো। অনার্স পড়তে, কলেজের ছোটখাটো অনুষ্ঠানে বন্ধুদের সামনে গিটার বাজিয়ে গান গেয়েছে বেশ কয়েকবার। আর কেউ শুনুক না শুনুক অর্পণ ছিল ওর নিত্যদিনের শ্রোতা। অর্পণ চুপচাপ শুনতো শুধু। ভাল খারাপ কিছুই উচ্চারণ করতো না। শুনতো আর দেখতো পাইকে। গান শেষ হয়ে যাওয়ার পরও নিশ্চুপ বসে থাকতো পাইয়ের দিকে চেয়ে।
এখন পাইয়ের গিটারখানা ওর ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো থাকে। ধুলো পড়ে ধূসর হয়েছে সেই গিটার, আর ফসিল হয়েছে ওর রকস্টার হওয়ার স্বপ্ন।
আজ সন্ধ্যের টিউশনিটা ক্যানসেল করে দিয়েছে পাই। বাড়ি থেকে টিউশনির নাম করেই বেরতে পারতো, কিন্তু তা করেনি সে। তার ইচ্ছে করেনি তেমনটা করতে। অর্পণের থেকে আজকের ব্যাপারটা জানতে পেরেই বাড়িতে জানিয়ে দেয়, যে সে আজ যাবে। মায়ের বারণ, বাবার শাসন অনেক পুহিয়েছে পাই।
আলমারি থেকে আজ জিনসের সাথে একটা টি-শার্ট বের করল। টি-শার্ট পড়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে সে। চুলটাও আর ঘাড় অবধি নেমে এসে থেমে নেই এখন, নেই তাতে বাদামি আভা। আসলে সব কিছুই বদলেছে তার জীবনে, কেবল অর্পণ আর কানে গুঁজে গান শোনার ইয়ার-ফোন দুটো ছাড়া। তবে আজকের দিনটা সে ফিরে আসতে দিয়েছে তার জীবনে। আজকের দিনটা পাইয়ের ইচ্ছে।
সাদা টি-শার্টটার উপরে লাল কালিতে লেখা কথাটা পড়লে শোনায় 'রক্ত'। ওপরের লাইনে 'রক', তারপর একটা কমা। নিচের লাইনে 'তো', পাশে একটা জিজ্ঞাসা সূচক চিহ্ন। বছর তিনেক আগে শেষবার এই টি-শার্টটা সে পড়েছিল। সেই দিনটাও ছিল আজকের মতই একটা দিন।
বেরনোর আগে বিছানায় বসে পাই চুপচাপ তাকিয়ে ছিল দেওয়ালে ঝুলন্ত গিটারটার দিকে। হাত বাড়াতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ভাবছিল, লাভ কী? এই পিছিয়ে পড়া সোসাইটিতে বাংলা-রক আর একটা কলেজপড়ুয়া মেয়ে – তেলে জলে মিশ খায় না ঠিক, মিশ খায়নি কোনোদিনও।
মা হঠাৎ ঘরে ঢুকে এসে বলল, "কথা শুনবি না তাহলে! বাবা অফিস থেকে ফিরলে কিন্তু বুঝতেই পারবে কোথায় গেছিস।"
মায়ের মুখের ওপরই পাই বলে উঠল, "হ্যাঁ, তারপর রাতে আমি ফিরলে তুলকালাম হবে। তাই তো? আমি জানি মা, ভবিষ্যৎ দেখতে পাই আমি !"
"অসহ্য কথাবার্তা!" বিরক্তি প্রকাশ করে নিজের ঘরে চলে গেল তার মা।
পাইও বেরিয়ে পড়ল। সন্ধ্যে নামবো-নামবো করছে। মনটা আজ তার ভাল না খারাপ বুঝে উঠতে পারে না সে।
নজরুল মঞ্চের সামনে অর্পণ দাঁড়িয়ে ছিল। নীল রঙের জিন্স আর সেই 'রক্ত' লেখা টি-শার্ট। আসলে টি-শার্ট দুটো একসাথেই কিনেছিল ওরা।
পাইকে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে তাড়াতাড়ি আসতে ইশারা করল অর্পণ। রক-কনসার্ট যে অর্পণের খুব ভাল লাগে তা নয়। বরং ইলেক্ট্রিক-গিটার আর পার্কাশন-এর প্রবল শব্দে কানে ঝিঁঝিঁ ধরে যায়। সে শুধু ভাবে, পাই-এর তো ভাল লাগে, তা-ই অনেক, সেটাই আসল। আজকের কনসার্টের দুটো পাস অনেক ধরে-করে সে-ই জোগাড় করেছে।
পাই চুপচাপ অনুসরণ করে অর্পণকে। স্টেজ থেকে কিছুটা দূরে, ওকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে অর্পণ চট করে কোথায় পালিয়ে যায়।
হঠাৎ একজোট ছেলেমেয়ের কান ফাটানো চিৎকারে কেঁপে ওঠে পাই – "ফসিইইইইইলস!"
ফাঁকা স্টেজে প্রবেশ করে রূপম-দ্বীপ-অ্যালেন-চন্দ্র-তন্ময়। আসলে ওরা পাঁচজন নয়। ওরা পাঁচে মিলে একজন – একটা প্রাণ।
অন্ধকার হয়ে যায় গোটা অডিটোরিয়াম। নীলচে-বেগুনি ধোঁয়ায় ভরে যায় গোটা স্টেজ। সেই মায়াবী ধোঁয়া এসে অদৃশ্যে ছুঁয়ে ফেলে পাইকে। মাইকে ঠোঁট ছুঁয়ে রূপম তার বিখ্যাত মন-খারাপ করা কণ্ঠস্বরে বলে ওঠে, "কেমন আছো শহর?"
ভিড়ের মধ্যে থেকে জোরালো উত্তর ফিরে যায় স্টেজের দিকে, "ভালোওওওওও!"
পাই যদিও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, আর বাড়তে থাকে ওর রক্তস্রোতের গতি।
রূপম আবার বলে, "এই গানটা, ইট ইজ আ স্পেশাল রিকোয়েস্ট ফ্রম এ গ্রেট গাই, অর্পণ। ডেডিকেট করছি পাইকে। পাই তুমি যেখানেই থাকো, এটা তোমার জন্য..."
বাস্তবের ঘোড়দৌড়ে হারিয়ে যাওয়া কাঁটাগুলো আবার গজিয়ে ওঠে পাইয়ের গোটা শরীরে, রোমকূপগুলোর মুখে মুখে।
হঠাৎ পাইয়ের ভাল লাগতে থাকে সবকিছু। মায়ের বকুনি, বাবার শাসন, ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন – সঅঅব। পাই ভাবে, এ সবে খারাপটা কোথায়? আজকের সন্ধ্যেটা তো আছে, আজকের সন্ধেটা তো থেকেই যাবে।
"আরও একবার রাজি আমি...আমি রাজি ঝুঁকি নিতে..."-স্টেজের দিক থেকে ভেসে আসে পাইয়ের ভীষণ চেনা একটা কণ্ঠস্বর। অনেক চেনা একটা সুর। পরের কথাগুলো অবশ্য ঢেকে যায় ফ্যান-দের পাগলা-চিৎকারে। পাই শুধু ভাবে, গিটার হাতে ঝুঁকিটুকুই ৎআর আর নেওয়া হল না!
আর ঠিক তখনই কোত্থেকে উড়ে এসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে অর্পণ বলে ওঠে, "পাই, আমার একটা কথা ছিল-"
"ধ্যাত্তেরি! সবাই জানে সে কথা। কথাটা পাড়ার আর টাইম পেলি না! আই লাভ ইউ টু! এখন জাস্ট জ্বালাস না।" বলে পাই এগিয়ে যায় স্টেজের দিকে। একগাদা উন্মাদ ছেলেমেয়ের ভিড় ঠেলে, অজস্র ধাক্কা সামলে এগিয়ে চলে সে। এখন পাগল হওয়ার সময়।
অর্পণ অপলক চেয়ে থাকে সেদিকে। শেষে একটা পাগল জুটলো কপালে ! - কথাটা মনে হতে হেসে ফেলে সে। ধুমসো সাউন্ড-বক্সে গিটারের কর্ড সি-মেজর থেকে এ-মাইনর হওয়ার ফাঁকে নিজের অজান্তেই সে বলে ওঠে, "জয় রক!"